তাঁর উপরে অর্জুনকে এই নির্বাসন! এই নির্বাসন মেনে নিতে অৰ্জুনেরও কি কোনো কষ্ট হয়নি? হয়েছে। তিনি ইচ্ছাক্রমে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার ঘরে যাননি। কোনো মানবিক কারণে একজনকে রক্ষা করা নিতান্তই প্রয়োজন ছিলো বলে গিয়েছিলেন। অবশ্য অর্জুনের নির্বাসন বা দ্রৌপদীর অৰ্জুনকে না পাওয়া নিয়ে ব্যাসদেব একটি লাইনও লিখে সময় নষ্ট করেননি। এটা ধরেই নিতে বলেছেন, কুন্তীর আদেশ পূর্ণ না করলে কুন্তীকে অমৃতভাষণের দায়ে পড়তে হয়, এবং পূর্বজন্মে দ্রৌপদী পাঁচবার বর চেয়ে এ জন্মে পঞ্চপতির পত্নী হয়েছেন।
এদিকে বিদুর যেই জানলেন দুৰ্যোধন আর কর্ণ সেই স্বয়ংবর সভা থেকে হতদৰ্প হয়ে প্রত্যাবৃত হয়েছেন, আনন্দ আর ধরে না। ধৃতরাষ্ট্রকে দুঃখ ও হতাশায় জর্জরিত করতে তখুনি ছুটলেন খবর দিতে। গিয়ে ভালোমানুষের মতো বললেন, ‘মহারাজ! ভাগ্যবলে কৌরবেরাই জয়ী হয়ে ফিরেছেন।‘ সংবাদ শুনে ধৃতরাষ্ট্র পরম সন্তুষ্ট হয়ে বলতে লাগলেন, ‘বিদুর, তুমি আজ আমাকে কী শুভ সমাচারই না প্রদান করলে। আসলে বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে অতিমাত্রায় জব্দ করার মানসেই ‘কৌরবেরা’ বলেছিলেন। বিদুরের জালে মাছের মতো আবদ্ধ ধৃতরাষ্ট্র সেই ‘কৌরবেরা’ শুনে মনে করলেন তাঁর পুত্র দুর্যোধনই জয়ী হয়েছে। চতুর বিদুর এই অন্ধ অনুগত রাজটিকে নিয়ে কতো খেলাই না করেছেন। ধৃতরাষ্ট্র উৎসাহিত এবং উত্তেজিত হয়ে আজ্ঞা প্রদান করলেন, যেন দুর্যোধন দ্রৌপদীকে বহুবিধ ভূষণে ভূষিত করে তাঁর সম্মুখে আনয়ন করেন।
অর্থাৎ ধৃতরাষ্ট্র বিদুরের জালে ধরা দিলেন। ছটফটে মাছের মতোই আনন্দ ও উত্তেজনায় অস্থির হয়ে গেলেন। এই সময় বিদুর বললেন, ‘মহারাজ। বরমাল্য পাণ্ডবেরাই প্রাপ্ত হয়েছেন।‘ ভয় দেখাবার জন্য বললেন, ‘সেই স্বয়ংবর প্রদেশে তুল্যবলশালী অনেকানেক বন্ধুবান্ধব এসে তাদের সঙ্গে মিলিত হয়েছেন।‘
ধৃতরাষ্ট্র যতোটা ভেঙে পড়বেন বলে ভেবেছিলেন, ঠিক সেই রকম কোনো প্রতিক্রিয়া তাঁর হলো না। বরং বললেন, ‘দ্রুপদের সঙ্গে মিত্রতা করে কোন ক্ষত্রিয় কৃতকার্য হতে বাসনা করে না? আমার বিলক্ষণ প্রতীতি হচ্ছে যে আমার দুরাত্মা পুত্রদিগের আর নিস্তার নেই।’
অনন্তর, দুৰ্যোধন এবং কর্ণ ধৃতরাষ্ট্রের নিকট আগমনপূর্বক নিবেদন করলেন, ‘তাত, বিদুরের সন্নিধানে আমরা কোনো প্রকার দোষ কীর্তন করতে পারবো না, এ আপনার কীদৃশ ইচ্ছা? বিপক্ষের বুদ্ধি আপন বুদ্ধি বলে মনে করছেন। বিদুরের নিকট সপত্নদের স্তুতিবাদ করছেন। এবং কর্তব্য কর্মে মনোযোগ দিচ্ছেন না। হে তাত শত্রুদিগের বল বিঘাত করা সর্বতোভাবে কর্তব্য হয়েছে। এখন আমাদের এমন একটি মন্ত্রণা করা আবশ্যক যাতে তারা আমাদের সর্বস্ব গ্রাস করতে না পারে। যেন আপনাকে উচ্ছেদ না করে।’
এরপরে একটি মন্ত্রণা সভা বসলো। ভীষ্ম দ্রোণ ইত্যাদির সমতুল্য বোধে ধৃতরাষ্ট্র সেই মন্ত্রণা সভায় বিদুরকেও আমন্ত্রণ না করে পারলেন না। ভীষ্ম দুর্যোধনকে বললেন, ‘পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধ করা আমার অনভিমত। যেমন তুমি ধর্মত রাজ্যলাভ করেছো, তারাও ইতিপূর্বে সে রকম রাজ্যাধিকার প্রাপ্ত হয়েছিলেন। অতএব বিবাদে প্রয়োজন নেই, সৌহার্দ্যপূর্বক তাদের রাজ্যাৰ্ধ প্রদান করলেই উভয়পক্ষের মঙ্গল।‘
বিদুর বললেন, ‘মহারাজ! পাণ্ডব-জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরকে রণে সহ্য করে এমন লোক ত্ৰিজগতে লক্ষ্য হয় না। যে মহতী অকীর্তি লোকবিদিত হয়েছে, সেটা স্থলন করুন। আমি তো আপনাকে পূর্বেই বলেছি দুৰ্যোধনের অপরাধে এই সুবিস্তীর্ণ রাজবংশ উচ্ছিন্ন হবে।’
আমরা পাঠকরা এ-কথাটা অবশ্যই বলতে পারি, দুর্যোধনের জন্যই বিদুর নামক পাপিষ্ঠটি অন্ধ দুর্বল ধৃতরাষ্ট্র নামের রাজ্যটিকে, এবং তাঁর রাজ্যটিকে, খুব সহজে গ্রাস করতে পারছিলেন না। কেননা রাজা হিশাবে দুর্যোধন প্রকৃতই একজন শ্রেষ্ঠ পুরুষ। তাঁকে হটানো যে সহজ নয় সে বুদ্ধিটুকু বিদুরের ছিলো। প্রকৃতপক্ষে, দুর্যোধন তাঁর রাজ্য স্বীয় বুদ্ধিতে স্বীয় চেষ্টায় অনেক বাড়িয়ে ফেলেছিলেন। রাজন্যবর্গের মধ্যে তিনি অত্যন্ত সম্মানিত রাজা। বিদুরের জীবনে দুৰ্যোধন এজন্যই সবচেয়ে বড় শত্রু। এই শক্রর জন্যই তিনি যা চান সেটা সহজে করতে পারেন না। সেই কারণেই দুর্যোধনের প্রতি তাঁর ক্রোধ তাঁকে মুহুর্তের জন্যও শান্তিতে জীবনধারণ করতে দিচ্ছিলো না। বিদুরকে সবাই ধর্ম বলে জানে, বিদুর যখন যা বলেন এবং করেন সেটা ন্যায্য বলে সকলে ভাবতে অভ্যস্ত। মাঝখান থেকে এই দুৰ্যোধনই তাঁকে চূড়ান্ত অবিশ্বাসী জেনে অত্যন্ত সন্দেহের চোখে দেখেন।
শেষ সিদ্ধান্তে ভীষ্মও যা বললেন, দ্রোণও তাই বললেন। ধৃতরাষ্ট্র বললেন, ‘হে বিদুর তা হলে তুমি যাও। সৎকার প্রদর্শন পূর্বক কুন্তী ও দ্রৌপদী সমভিব্যাহারে পাণ্ডবদের আনয়ন করো।’
সবচেয়ে আশ্চর্য, এই সভায় কিন্তু এরকম কোনো কথাই কেউ বললেন না, যে এক কন্যাকে পাঁচটি পুরুষ যেখানে বিবাহ করেছে, সেই বিবাহ সঙ্গত বলে আমরা মানি না। অন্তত ভীষ্মের বলা উচিত ছিলো। তিনি তো ভয় পাবার পাত্র নন। দ্রুপদরাজ যতোই বলশালী রাজা হোন না কেন, ভীষ্ম যুদ্ধে প্রবৃত্ত হলে সে বল নিমেষেই দুর্বল হয়ে যাবে। এই ভীষ্মই পাণ্ডুকে দ্বিতীয়বার বিবাহ দিয়েছিলেন, যেহেতু তিনি স্বয়ংবর সভায় কুন্তীর মাল্যদান গ্রহণ করে বিবাহিত হয়ে এসেছিলেন। ভীষ্মের বংশ এই বিবাহকে শুদ্ধ বিবাহ বলে গণ্য করে না। কন্যাকে স্বভবনে এনে অনুষ্ঠান করতে হয়। বংশের মাত্র এইটুকু নিয়মের ব্যতিক্রমেই যিনি অতো বিচলিত হয়েছিলেন, এই বিবাহ তো তাঁর বিবাহ বলেই বোধ হওয়া সম্ভব নয়। তাদের পূর্বপুরুষেরা কখনো এক কন্যার পঞ্চপতি ধর্মসংগত বিবাহ হিশেবে ধার্য করেছেন তাঁর কোনো নজির নেই। কিন্তু ঐ সভায় এ বিষয়ে কোনো কথাই উঠলো না। কেন? কুন্তীর মুখনিঃসৃত অনুদেশ নেহাৎ ভুল বোঝাবুঝির ফল। তাঁকে ‘বেদবাক্য’ মানবারও কারণ বোঝা যায় না। ব্যাসদেব পাণ্ডবদের বিষয়ে এমন কোনো কথা কোথাও লেখেননি যেটা তাদের বিরুদ্ধে যায়। এই ‘নিষ্কাম’ ব্রহ্মচারীটি শুধু যে নিষ্কাম ছিলেন না তাই নয়, নিস্পৃহও ছিলেন না। পাণ্ডবরা কে, কার দ্বারা জন্মগ্রহণ করেছে, সত্যিই পাণ্ডুর ক্ষেত্ৰজ কিনা, সবই জানতেন খুব ভালোভাবে। গোপনীয়তার আশ্রয় নিতেও দ্বিধা করতেন না। বলেও ছিলেন, “তোমাদের অধিক স্নেহ করি। তোমরা যা চাও তাই হবে।’