এই উপাখ্যান এখন যেখানে এসে পৌঁছেছে সেখান থেকে যুদ্ধের ময়দান খুব দূরে নয়। কিন্তু কেন এতদূর এলো? কে তাঁর জন্য দায়ী? এই বহিরাগত পঞ্চপাণ্ডব নামধারী মানুষ ক’টি পাণ্ডুর ক্ষেত্ৰজ হিশেবেই গণ্য হয়ে, রাজপুত্রদের সঙ্গেই শিক্ষাদীক্ষা সহবতে মিলিত হয়েছিলো। তাঁর মধ্যে যদি বিদুরের প্রবেশ না ঘটতো, তা হলে হয়তো বা তারা কুরুকুলের ভ্রাতা হয়েই মিলেমিশে থাকতে পারতো। যার মনে যে সন্দেহই থাক, আস্তে আস্তে মুছে যেতো সেটা। বিদুর তো সেজন্য তাদের নিয়ে আসেননি এখানে। এনেছেন পুত্রকে একচ্ছত্র সাম্রাজের অধিপতি করতে। প্রথমেই ঘোষণা করলেন দুর্যোধন সাম্রাজ্যের ভাগ দেবার ভয়ে ওদের সঙ্গে শক্ৰতা করছে। একজন প্রতিপক্ষ দাঁড় করাতে না পারলে বৈপরীত্যের সৃষ্টি হয় না। যেখানে বিষয়-সম্পত্তি নিয়ে ব্যাপার, সেখানে দুর্যোধনকে সহজেই শত্রুপক্ষ হিশাবে বিশ্বাস করানো, এক্ষেত্রে, এই পরিবেশে, খুবই সহজ। সুতরাং, অপপ্রচার জনগণের মনে ধরানোর কার্যটি বিদুর খুব ভালোভাবেই সম্পন্ন করতে পেরেছিলেন। তথাপি, পুরবাসীদের অনেকের মনই কুন্তীর এই পঞ্চপুত্র বিষয়ে নিঃসংশয় ছিলো না। তাঁর পরিচয় পাওয়া গেলো কৃত্রিম যুদ্ধের দিন, যখন দুৰ্যোধন বললেন, ‘তোমাদের কী ভাবে জন্ম তা-ও কিন্তু আমরা জানি।‘ তখন কেউ তাঁর জবাব দিতে সক্ষম হলেন না। পঞ্চভ্রাতাও নয়, বিদুরও নন, গুরুজনেরাও নিঃশব্দ।
ঘটনাগুলো অনুধাবন করলে এখানেও অনেকগুলো বিষয়, যেমন, মহারাজা শান্তনুর মৃত্যুর জন্ম, দুর্যোধন জন্মানোমাত্রই বিদুরের তাকে হত্যা করবার প্রয়াস, স্বীয় অবৈধ পুত্র যুধিষ্ঠিরকে পাণ্ডুর ক্ষেত্ৰজ প্রমাণ করবার জন্য কুন্তীর সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে পাণ্ডুকে ও মাদ্রীকে নিহত করা, পুত্রদের অজ্ঞাতবাসে পাঠিয়ে কোনো ক্ষমতাশালী নির্দিষ্ট রাজার সঙ্গে সম্পর্ক পাতাবার চেষ্টা, বারণাবতে নিজেরা আগুন লাগিয়ে অতোগুলো মানুষকে পুড়িয়ে ধৃতরাষ্ট্র আর তাঁর পুত্র দুৰ্যোধনের নামে চালাবার মিথ্যাচার, একজন কৃতবিদ্য প্রযুক্তিবিদ পাঠিয়ে বিদুরের পাতাল পথ রচনা, সেই পথে হেঁটে দূরবর্তী অন্য এক লোকালয়ে গিয়ে উঠে মাতাসহ পঞ্চপাণ্ডবের আকাশের তলায় দাঁড়ানো এবং অপেক্ষমান পথপ্রদর্শকের সঙ্গে গিয়ে বিদুরের পাঠানো যন্ত্রযুক্ত নৌকায় আরোহণ, অপর তীরে অবরোহণ করে আবার নির্দিষ্টভাবে দক্ষিণ দিকে গমন, চলতে চলতে নির্দিষ্ট স্থানে ব্যাসদেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ, ব্যাসদেবের নির্দেশে প্রথম একমাস একচক্রা নগরে-অবস্থান, তারপরে পুনরায় একমাস পরে ব্যাসদেবের আগমন এবং পাঞ্চাল নগরে ব্রাহ্মণের বেশে দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভায় গিয়ে অৰ্জুনের বীরত্বে দ্রৌপদী লাভ, কুন্তীর চালাকিতে যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে বিবাহ দেবার ধূর্ততা—ষড়যন্ত্র এবং হঠকারিতার নিদর্শন ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু এতোগুলো হঠকারিতার মধ্যে দুর্যোধন কোথায়? অথচ বিবিধ অসাধু কর্মের দায় দুর্যোধনের নামেই চালানো হলো। পড়তে পড়তে দুর্যোধনের জন্য বেদনা অনুভব করাই তো স্বাভাবিক। দুর্যোধনের মুখনিঃসৃত যে দুটি বাক্য লিখিত হয়েছে, তা ঐ কৃত্রিম যুদ্ধের আসরে ভীমের নিম্নশ্রেণীর কলহদীর্ণ ভাষার জবাবে জানানো, ‘হে ভীম! কর্ণকে এভাবে বলা তোমার উচিত নয়।‘ আর বিদুরের প্রচারে যুধিষ্ঠির একেবারে ক্ষমতার তুঙ্গে উঠে তাদের পরাজিত করে সিংহাসন দখল করবার মতো ক্ষমতাশীল হয়ে উঠেছেন শুনে ভীত হয়ে পিতাকে বলা, ‘ওদের যদি কিছুদিনের জন্য অন্যত্র কোথাও পাঠিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে ঐ সময়ের মধ্যে আসন্ন বিপদের হাত থেকে উদ্ধার পাবার একটা ব্যবস্থা করা যেতে পারে।’ বিদুর-কুন্তীসহ এই পাঁচটি ভ্রাতার বিবেকহীন, অসাধু এবং লুব্ধ ব্যবহারের পরিবর্তে দুর্যোধনের সৌজন্য এবং ধৈর্য বরং অনুকরণযোগ্য বলেই মনে হওয়া উচিত।
সত্যবতী যে উদ্দেশ্য নিয়ে এই প্রাসাদের সর্বময়ী কত্রী হয়ে প্রবিষ্ট হয়েছিলেন, এবং যে উদ্দেশ্য সাধন করতে শান্তনুর একমাত্র পুত্র দেবব্রতকে চিরকুমার ব্রহ্মচারী থাকতে বাধ্য করেছিলেন, সেই সংকল্প সাধন করলেন তাঁর নিজের পুত্র বিচিত্রবীর্যের বিধবা পত্নীদ্বয়ের গর্ভে তাঁর অবিবাহিত কালের সন্তান দ্বৈপায়নের দ্বারা সন্তান উৎপাদন করিয়ে৷ তদ্ব্যতীত, বিদুরকে পর্যাপ্ত প্রশ্রয় দিয়ে এমন একটা স্তরে উত্তোলিত করে রেখে বনগমন করলেন যেখান থেকে তাঁর স্থলনের আর কোন সম্ভাবনা রইলো না। আর বিদুরপুত্র যুধিষ্ঠিরের অনার্য অবৈধ রক্ত এতো পরিশ্রত হলো যে শান্তনুর আদি বংশের ক্ষত্রিয় রক্ত আর এক কণাও অবশিষ্ট থাকলো না। বৈরানল তখনি প্রজ্বলিত হলো। যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলো। এই যুদ্ধও সত্যবতীরই অবদান। শান্তনুর প্রাসাদে দ্বৈপায়নের প্রবেশ না ঘটলে বিদুর জন্মাতো না, বিদুর না জন্মালে যুধিষ্ঠিরও জন্মাতো না, যুধিষ্ঠির না জন্মালে রাজত্ব নিয়ে এই প্রমাদও উপস্থিত হতো না।
মহাভারতের মহারণ্যে – ২.০১
দ্বিতীয় পর্ব
১
এর পরবর্তী আখ্যানটি আরম্ভ করতে হচ্ছে অতি ক্ষমতাশীল রাজা দ্রুপদের অন্তঃপুর থেকে, যে অন্তঃপুরে তিনি যজ্ঞ থেকে উত্থিতা একমাত্র কন্যাকে পাঁচটি ভ্রাতার পাণিস্থ করেছেন এবং ভেবেছেন আমার তুল্য বলশালী রাজা আর কেউ থাকলো না এ জগতে। সেই সময়ে একটি পত্নী নিয়ে পাঁচটি ভ্রাতাও দ্রুপদের অন্তঃপুরে যথেষ্ট আহ্লাদের সঙ্গে দিনযাপন করছিলেন। তবে তাদের পত্নীর মন সেই আহ্লাদের সঙ্গে কতোটা যুক্ত ছিল সে কথা কেউ ভাবেননি। তাঁর নিজের প্রেমিক, যাঁকে সত্যিই তিনি নিজের নির্বাচিত স্বামী হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন, সেই অৰ্জুনকে তখনো পাননি তিনি, তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাই ভোগ করছিলেন কনিষ্ঠ ভ্রাতৃবধূকে। যার যার স্বার্থসিদ্ধির কারণে সকলেই তাঁকে বলিদানের পাঠা হিশেবে ব্যবহার করছিলেন। স্বয়ং ব্যাসদেবই যুধিষ্ঠিরের জন্য সমাজবিরোধী এই কর্মটি করতে নানান ছলে বলে কৌশলে দ্রুপদ রাজা আর তার পুত্রকে প্রাভাবিত করলেন। অর্জুনকে মাল্যদান করবেন বলেই, পিতা-ভ্রাতার প্রতিজ্ঞা লঙ্ঘন করে দ্রৌপদী চেঁচিয়ে উঠেছিলেন, ‘আমি সূতপুত্রকে বিবাহ করবো না।’ অৰ্জুন বিষয়ে দ্রৌপদীর মনে নিশ্চয়ই অনেক স্বপ্ন ছিলো, পিতা-ভ্রাতার ঘোষণা লঙ্ঘন করে বরণও করলেন তাঁকে, কিন্তু রাজনীতির যূপকাষ্ঠে সেইসব স্বপ্নের কোনো ঠাঁই নেই। যে পিতা-ভ্রাতা তাঁদের আদেশ লঙ্ঘন করে কর্ণকে অসম্মান করার জন্য বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না, যেহেতু তাদের নির্বাচিত জামাতা অজুর্নই ছিলেন, সেই পিতা-ভ্রাতাই ব্যাসদেবের পরামর্শে যে আজ্ঞা পালনে বাধ্য করলেন কন্যাকে, সেই বাধ্যতা রক্ষা করা আর মৃত্যু, দুই-ই হয়তো তখন সমতুল্য মনে হয়েছিলো দ্রৌপদীর। তাঁর শ্বশ্রূমাতা কুন্তী স্বেচ্ছায় পাঁচটি পুরুষের অঙ্কশায়িনী হয়েছিলেন। কিন্তু দ্রৌপদীর মতো একটি অনাহত শুদ্ধ চরিত্রের কন্যা পতি হিশাবে অৰ্জুনকে মাল্যদান করে তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার শয্যায় যেতে যে নিজেকে অতিমাত্রায় কলুষিত লাঞ্ছিত বঞ্চিত মনে করেননি তা কি হতে পারে? কুন্তী তাঁকে পদার্থ বললেও সত্যি তো তিনি পদার্থ নন। অর্জুন বস্তুতই আকর্ষণীয় পুরুষ। বীরত্বেও কর্ণ ব্যতীত আর কেউ তাঁর সমতুল্য আছেন কিনা সন্দেহ। সেই ইপ্সিত প্রেম ও বাসনা নিয়ে যখন তাঁর হৃদয় থরোথরো তখনই যেতে হলো অৰ্জুনের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা যুধিষ্ঠিরের শয্যায়। স্বীয় উপভোগান্তে যুধিষ্ঠির সেই পদার্থ নামের দেহটা পাঠিয়ে দিলেন ভীমের শয্যায়। ইতিমধ্যে অর্জুনের নির্বাসনও হয়ে গেল বারো বছরের জন্য, যেহেতু, যুধিষ্ঠির যখন দ্রৌপদীর সঙ্গে ছিলেন তখন নিয়মবিরুদ্ধভাবে কোনো অনিবার্য কারণে অৰ্জুনকে সেই ঘরে ঢুকতে হয়েছিলো। কে জানে কতো নিঝুম রাতের অন্ধকারে চোখের জলে ভেসে গেছে দ্রৌপদীর হৃদয়ের সব স্বপ্ন।