যুধিষ্ঠির ভীমকে এ কথাও বললেন, দ্যাখো, শক্র নির্মিত এই জতুগৃহ দগ্ধ হলে পর পিতামহ ভীষ্ম ও অন্যান্য কুরুবংশীয় মহাত্মারা অতিশয় ক্রোধান্বিত হবেন। বলবেন, “কে এই অধাৰ্মিক কর্ম করালো”? এই বাক্য কটি যুধিষ্ঠির এমন নিশ্চিত ভঙ্গিতে উচ্চারণ করলেন যা থেকে খুব স্পষ্ট ভাবেই বোঝা যায় তিনি জানতেন পুড়ে যারা মরবেন তারা আর যেই হোন, কুন্তীর পঞ্চ পুত্র নন। যারা অগ্নি প্রদানে সেই গৃহ প্রজ্বলিত করবেন, তারাও ধাৰ্তরাষ্ট্রদের কেউ নন। যদি সেই ভয়ই তাঁর থাকতো তবে জেনেশুনে কী করে একথা বললেন, “জতুগৃহ দগ্ধ হলে পিতামহ ভীষ্ম ও অন্যান্য কুরুবংশীয় মহাত্মারা অতিশয় ক্রোধান্বিত হবেন। তারা যদি দগ্ধই হন, তবে কে কী বললো আর না বললো কী এসে যায় তাতে? তদ্ব্যতীত, তাদের দগ্ধ করবার জন্যই যদি দাহ্য পদার্থ দিয়ে বাড়িটি তৈরি হয়, পুরোচনের জন্য যে বাড়ি সে বাড়ি তো অমন দাহ্য পদার্থ দিয়ে তৈরি করবার কোনো প্রশ্ন ছিলো না। যিনি তাদের পোড়াবেন, সঙ্গে সঙ্গে তিনিও কি নিজেকে পুড়িয়ে মারবেন? সহমরণ?
পিতামহ কৃষ্ণদ্বৈপায়নের রচনার চাতুর্য, পিতা বিদুরের কাপট্য আর মাতা কুন্তীর হৃদয়হীনতা, এই তিনটি পাথেয় নিয়েই যুধিষ্ঠির চালিত হচ্ছিলেন কুরুরাজ্য দখলের জন্য। আর এঁদের সকলের দুষ্কর্মের বোঝা বহন করছিলেন হতভাগ্য দুর্যোধন। পুড়ে মরবার জন্যই কি সম্পূর্ণ এক বৎসর ভ্রাতাগণ আর তাদের মাতাকে অপেক্ষা করতে হলো সেখানে? এটা কি সম্ভব? যে করেই হোক নিশ্চয়ই তারা বেরিয়ে পড়তেন সে বাড়ি থেকে। একটা পাতালপথ তৈরি হওয়া তো সহজ ঘটনা নয়, দু-একদিনের ব্যাপারও নয়, দু-একজন মানুষের কর্মও নয়। প্রযুক্তিবিদ্যার উৎকৃষ্ট নিদর্শন এই সুড়ঙ্গ পথ তৈরি হতে সময় লাগলো সম্পূর্ণ একটি বৎসর। এই এক বছর কেন পুরোচন নিশ্চেষ্ট অবস্থায় বসে রইলেন? দাহ্য পদার্থে তৈরি তাঁর বাড়ির ওপর এতোদিন ধরে কী কাজকর্ম হচ্ছে সেটা জানবারও কৌতুহল কি তাঁর হলো না? তাছাড়া, যে মানুষ এতোগুলো বিশেষ লোককে পুড়িয়ে মারবার মতো একটা নৃশংস, গুঢ় অভিসন্ধি নিয়ে একটা বিশেষ হর্ম্য তৈরি করেছেন, তিনি নিশ্চয়ই সদাসতর্ক থাকবেন, অশান্ত থাকবেন, এবং অনুক্ষণই উদ্দেশ্য সাধনের সুযোগ খুঁজে বেড়াবেন। উপরন্তু, দশদিনে তৈরি বাড়ির ওপর দিয়ে এতোগুলো ঋতুই বা বয়ে যেতে দেবেন কেন? দাহ্য পদার্থ তো অনন্তকাল ধরে প্রলেপিত থাকতে পারে না? কখনো তা গ্রীমের প্রচণ্ড দাবদাহে দগ্ধ হবে, কখনো বর্ষার অবিরল বারিপাতে ধৌত হবে। পাণ্ডবরা না হয় পালাবার রাস্তা তৈরি না হলে লুকিয়ে বেরোতে পারছিলেন না। কিন্তু পুরোচনের তো সে ভাবনা নেই, সে অযথা সময় নষ্ট করবে কেন? রাত কি কখনো গভীর হয়নি? পাণ্ডবরা কি ক্লান্ত দেহে নিদ্রাচ্ছন্ন হননি কখনো? আসলে এ বাড়ি আদপেই পুরোচনের তৈরি নয়। অন্তত দাহ্য পদার্থের ব্যবহার তিনি কখনোই করেননি।
যেদিন পাতালপথ সম্পূর্ণ হলো, এবং যুধিষ্ঠির মনে করলেন সময় উপস্থিত হয়েছে, সেদিন চারিদিক নিঃঝুম হলে তিনি বললেন, ‘এবার আগুন দাও। প্রথমে পুরোচনের গৃহ ভস্ম করো, তারপর আরো ছয়জনকে এখানে রেখে পুড়িয়ে আমরা অলক্ষিতে পলায়ন করবো।’
ছয়জন সেখানে কারা থাকবেন? দয়ার অবতার মহাত্মা যুধিষ্ঠির আর যুধিষ্ঠিরের দয়ার্দ্রচিত্ত মাতা কুন্তী সে ব্যবস্থাও ঠিক করে রেখেছেন। কুন্তী চালাকি করে সেদিন সন্ধ্যায় কয়েকজন ব্রাহ্মণব্ৰাহ্মণীকে নিমন্ত্রণ খাওয়ালেন। তারা চলে যাবার পর একজন ক্ষুধার্ত নিষাদ মাতাঁকে তাঁর পাঁচপুত্রসহ এতো অধিক পরিমাণে পান ভোজন করালেন যে তারা হতজ্ঞান ও মৃতকল্প হয়ে সেখানে পড়ে রইলো। জ্যেষ্ঠের আদেশে ভীম প্রথমেই পুরোচনের গৃহে (এখানেই প্রমাণিত হলো পুরোচনের গৃহ আলাদা ছিলো এবং দাহ্যপদার্থে প্রলেপিত ছিলো) আগুন দিলেন, পরে জতুগৃহের চারিদিকে অগ্নিপ্রদান করে যখন দেখলেন অগ্নি সর্বত্র প্রজ্বলিত হয়েছে, তখন মাতা ও ভ্রাতৃগণসহ সেই পাতাল পথে নিষ্ক্রান্ত হলেন।
ভেবে দেখুন কতদূর লোভী হলে, পাপিষ্ঠ হলে মানুষ এভাবে একটি নির্দোষ দুঃখী রমণীকে তারা পাঁচ পাঁচটি পুত্রসহ পুড়িয়ে মারতে পারে। অন্যের রাজ্য কেড়ে নেবার লোভে যদি যুধিষ্টির এই ভয়ঙ্কর কর্মে প্রবৃত্ত হন, তবে দুৰ্যোধন তাঁর পিতাকে উচ্ছিন্ন করে, তাঁকে বঞ্চিত করে যারা সেই সিংহাসনের দখল চায়, তাদের প্রতিবন্ধক হলে তাঁর অপরাধটা কোথায়? তিনি নিশ্চয়ই তাঁর পিতাকে রক্ষা করবেন, নিজের স্বার্থ দেখবেন। সেটাই তো তাঁর ধর্ম, তাঁর কর্তব্য। যদিও দুৰ্যোধন তাঁর সারাজীবনে কখনো ততোটা নীচে নামবার কথা ভাবেননি, যতোটা নীচে পাণ্ডব নামধারী যুবক ক’টিকে বিদুর এবং দ্বৈপায়ন নামাতে পেরেছেন। এই নারকীয় হত্যাকাণ্ড সমাপ্ত করতে কুন্তীর চোখের পাতাটি নড়লো না। পাঁচটি পুত্রেরও একবিন্দু বিবেক দংশন হলো না।
আর একদিকে হুতাশনের অগ্নিতাপ যখন প্রবল আকার ধারণ করলো, বিদুরের কৃপায় সমস্ত পুরবাসীগণ অতিশয় দুঃখিত হয়ে বলতে লাগলেন, ‘দ্যাখো, দুরাত্মা পুরোচন পাণ্ডবদ্বেষী কুরুকলঙ্ক পাপাত্মা দুর্যোধনের আদেশানুসারে, নিরপরাধ সুবিশ্বস্ত সমাতৃক পাণ্ডবগণকে দগ্ধ করবার জন্য যে গৃহ নিৰ্মাণ করেছিলো, এখন তাতে অগ্নিপ্রদান করে স্বীয় মনস্কামনা সিদ্ধ করলো। ধর্মের কি অনির্বচনীয় মহিমা! দুরাত্মা নিজেও এই প্রদীপ্ত হুতাশনে দগ্ধ হলো। দুরাত্মা ধৃতরাষ্ট্রকে ধিক, কী দুৰ্বদ্ধি ঐ দুরাত্মা পরমাতীয় ভ্রাতুপুত্রগণকে শক্রর মতো অনায়াসে দগ্ধ করলো।‘ যে কথা যুধিষ্ঠির তাঁর ভ্রাতাদের পূর্বে বলেছিলেন ঠিক তাই হলো। কিন্তু এঁরা এটা জানলো কী করে যে ধৃতরাষ্ট্র এদের পুড়িয়ে মারবার জন্যই এখানে পাঠিয়ে দিয়েছেন? এটা তো এই দেশবাসীদের জানবার বা ভাববার প্রশ্নই নেই। বিদুরের প্রচারমহিমা এখানেও কার্যকরী হলো।