সভাসদস্যদের সম্মুখে স্বামীর এই উক্তিতে শকুন্তলা প্রথমে স্তম্ভিত হলেও, পরে অপমানে লজ্জায় দুঃখে বিদীর্ণ হয়ে রোষকষায়িত রক্তচক্ষুর দ্বারা অগ্নিবাণ নিক্ষেপ করে বললেন, জেনেশুনেও কেন অসংকোচে প্রাকৃতজনের মতো কথা বলছো জানি না। আমি যা বলেছি তা সত্য কি সত্য নয় সে বিষয়ে তোমার অন্তঃকরণই সাক্ষী। দুষ্মন্ত তখন শকুন্তলার মাতাঁকে অসতী এবং পিতাকে কামুক বলায় শকুন্তলা জ্বলে উঠে বললেন, ‘জন্মের বিচারে আমি তোমার চাইতে অনেক উৎকৃষ্ট। শূকর যেমন মিষ্টান্ন ত্যাগ করে পুরষ গ্রহণ করে, ইতরজন তেমনই সত্যকে ত্যাগ করে মিথ্যার আশ্রয় নেয়। তোমার সহায়তা ছাড়াই আমার পুত্র পৃথিবীর সম্রাট হবে।’
এই সময়ে স্বর্গ থেকে দৈববাণী হলো (যা মহাভারতে সর্ব সময়েই হয়ে থাকে এবং লোকেরা সুবিধেমতো গ্রহণ করে বা করে না), শকুন্তলাকে অপমান করো না, তার সব কথাই সত্য। তার গর্ভজাত স্বীয় পুত্রকে তুমি প্রতিপালন করো। এবং যেহেতু আমাদের অনুরোধে এই পুত্রকে ভরণ করা হলো, তার নাম হোক ভরত। এই নাম থেকে ভরতবংশের উৎপত্তি। এই বংশ নিয়েই মহাভারত রচয়িতা সমস্ত আখ্যানটি রচনা করেছেন। দৈববাণী শুনে অমনি দুষ্মন্ত বললেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, সে তো আমি জানি। কিন্তু হঠাৎ তোমাকে গ্রহণ করলে লোকে আমাকে কী বলতো? এইজন্য এতোক্ষণ বিতণ্ডা করছিলাম তোমার সঙ্গে।”
আসলে শকুন্তলার অনবনত তেজ দেখে দুষ্মন্ত ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। তদ্ব্যতীত, শকুন্তলা বলেছিলেন, ‘আমার পিতা কণ্বমুনি এসব কথা জানতে পারলে তোমার মস্তক বিদীর্ণ হবে।’ এ কথাও বুঝতে পেরেছিলেন, এই মেয়ে কলঙ্কের ভয়ে বা লজ্জায় পিছিয়ে যাবার পাত্রী নয়। এ তাঁকে সহজে ছেড়ে দেবে না। কিন্তু শকুন্তলা যদি আশ্রমকন্যা না হতেন তবে কক্ষনো রাজাকে এ ভাবে শঙ্কিত করতে সাহস পেতেন না। যে বিবাহ দুষ্মন্ত কামবশত সকলের অজ্ঞাতে করে এসে মুখ মুছে বসেছিলেন, সেই বিবাহ কিছুতেই মেনে নিতেন না। কিন্তু শকুন্তলা আশ্রমের স্বাধীনতায় বর্ধিত বলেই আহত হলে আঘাত ফিরিয়ে দেবার মনের জোর তার ছিলো। তাই রাজসভায় দাঁড়িয়ে সভাসদদের সামনে একাধারে স্বামী এবং ওরকম এক পরাক্রান্ত রাজাকে এভাবে স্পষ্ট বাক্যে মিথ্যাবাদী দুরাচারী পাপিষ্ঠ থেকে শুরু করে তার মিথ্যাচারকে শূকরের বিষ্ঠাভক্ষণের সঙ্গে পর্যন্ত তুলনা করে তিরস্কার করতে পেরেছিলেন।
মহাভারতের মহারণ্যে – ১.২
শকুন্তলার আরো কয়েক প্রজন্ম পরে পুনরায় যে রমণী সেই বংশে বিবাহিত হয়ে এসে খ্যাতির আসনে উপবিষ্ট হলেন তিনি সত্যবতী। শকুন্তলার পুত্র ভরত থেকে যে বংশ ভরতবংশ নামে খ্যাত তার একচ্ছত্র সম্রাজী সত্যবতীর মানসতাও শকুন্তলার সমগোত্রীয়, জন্মরহস্যও। সাহস এবং ব্যক্তিত্বের কোনো অভাব ছিলো না সত্যবতীর। যা চেয়েছিলেন তা সম্পন্ন করেই সংসার ত্যাগ করেছিলেন। দ্বৈপায়ন ওই একটি চরিত্রের উপর যথাসম্ভব কম আলো ফেললেও তিনি জানতেন ইনিই এই আখ্যায়িকার আসল নায়িকা, আর তিনি নিজে তার প্রধান পুরোহিত। নামত ভরতবংশের কাহিনী হলেও, আসল আখ্যানের কেন্দ্রবিন্দুতে সত্যবতী-দ্বৈপায়নই রয়েছেন।
রাজা শান্তনু সত্যবতীকে দেখে মুগ্ধ হয়ে তার পাণিপ্রার্থী হয়েছিলেন। এবং তা তিনি হতেই পারেন। তবে অবশ্যই তিনি তাঁকে ধীবরপল্লীতে দেখেননি। ধীবরপল্লী কখনো রাজামহারাজাদের ভ্রমণস্থল হতে পারে না। এখানে রচয়িতা পুনরায় একটি রূপকথার আবরণ ব্যবহার করেছেন। তিনি বলেছেন, একদা পরাশর মুনি নৌকা পার হবার সময়ে সত্যবতীর দেহের প্রতি আকৃষ্ট হন। তিনি ধীবরকন্যার দেহ থেকে সঙ্গমের পূর্বে মৎস্যগন্ধ দূর করে নিয়েছিলেন। সত্যবতীর দেহ তখন সুগন্ধে পরিপুত হয়। এবং সেই সুগন্ধ চিরস্থায়ী হয়। সুগন্ধ এমন যে বহুদূর থেকেও বাতাসে ছড়িয়ে পড়তো।
একদিন শিকার করতে বেরিয়ে মহারাজা শান্তনু যমুনাতীরে এসে বাতাসে ভেসে আসা এক অতি সুগন্ধে আকৃষ্ট হয়ে সহসা সত্যবতীকে দেখতে পান এবং সেই সুগন্ধে যতো আকৃষ্ট হয়েছিলেন, ততোধিক আকৃষ্ট হন সত্যবতীকে দেখে। শান্তনুর মতো একজন সৎচরিত্র রাজা, যিনি তার প্রথমা পত্নী গঙ্গাকে হারিয়ে সর্বস্ব ত্যাগ করে ছত্রিশ বছর বনে বনে ঘুরে বেরিয়েছেন, যিনি পরম প্রাজ্ঞ, পরম ধার্মিক, পরম ধীমান বলে বর্ণিত, যিনি দেবর্ষি ও রাজর্ষিগণের সম্মানভাজন, যার ধাৰ্মিকতা দেখে অন্যান্য নৃপতিরা তাঁকে সম্রাটপদে অভিষিক্ত করেছিলেন, সমগ্র পৃথিবীর যিনি অধিপতি হবার যোগ্য সেই বিশুদ্ধ কুলীন কুরুপতির পক্ষে মুহুর্তে সত্যবতীর প্রতি এতোটা আকৃষ্ট হওয়া যেমন আশ্চর্য, তার চেয়ে বেশি আশ্চর্য ঘটনা সেই কন্যার পাণিপ্রার্থী হয়ে সেই ধীবরের কুটিরপ্রাঙ্গণে গিয়ে দাড়ানো। ধীবর মানেই নিষাদ। সুতরাং অন্ত্যজ ও অস্পৃশ্য। নীচজাতি বা অন্ত্যজদের প্রতি উচ্চজাতির কী ধরনের মনোভাব ছিলো তা শাস্ত্রে, মহাপুরাণে, মহাকাব্যে, কোথাও অপ্রকট নয়। সেই জন্যই বিস্মিত হতে হয়, কেবলমাত্র সুগন্ধই তাঁকে এই আঙিনায় এসে দাঁড় করিয়ে দিলো?
যে করেই হোক, সত্যবতী তাঁকে যে যথেষ্ট সম্মোহিত করতে পেরেছিলেন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। একজন ধীবরের পাটনী কন্যার জন্য স্বয়ং সম্রাট এসে দাঁড়িয়েছিলেন এর চেয়ে বড়ো সৌভাগ্য সেই পরিবার আর কী ভাবতে পারে! কিন্তু তারা তা পারলেন, এবং সত্যবতীর পিতা তৎক্ষণাৎ একটি শর্ত রক্ষার দাবী রাখলেন। সেই শর্ত রক্ষায় রাজি না হতে পারায় শান্তনুকে প্রত্যাখ্যানও করলেন।