কুন্তী বলেছেন তাদের তর্কের শেষ সিদ্ধান্তে মাদ্রীই সহমরণে গেলেন। তারপর মাদ্রী ও পাণ্ডুর সতেরো দিনের গলিত শব নিয়ে পঞ্চপুত্রসহ কুন্তী হস্তিনাপুরে এলেন। মাদ্রী যে সহমরণে অন্তত যাননি সেটা দুটি মৃতদেহ এখানে এসে সৎকৃত হওয়াতেই প্রমাণিত হলো। পতির চিতাঁর অনলে জীবিত অবস্থায় বাপ দেওয়াকে সহমরণ বলে। তবে মাদ্রী কীভাবে মৃত হলেন? হয় তাঁকে আত্মহত্যা করতে হয়, নতুবা কারো হস্তে নিহত হতে হয়। এই দুটি মানুষের মৃত্যুই এমন অবিশ্বাস্যভাবে লিপিবদ্ধ হয়েছে যে প্রত্যয় হয় এই মৃত্যু কোনো ষড়যন্ত্রের দ্বারাই সংঘটিত। যাদের দ্বারা এই ষড়যন্ত্র সাধিত হয়েছিলো মাদ্রী তাদের চিনতেন। সেজন্য মাদ্রীকে নিহত হতে হলো। কুন্তী যে কুন্তী ব্যতীত কোনো দ্বিতীয় প্রাণীকে সেখানে উপস্থিত হতে দেননি তাঁর কারণ সেটা অত্যন্ত গোপনে এবং নিঃশব্দে সাঙ্গ করার প্রয়োজন ছিলো। যিনি এইমাত্র ছিলেন এইমাত্র নেই, এই হঠাৎ-মৃত্যু এমন একটা অবিশ্বাস্য এবং সাংঘাতিক ঘটনা যে কুন্তীর পক্ষেও সেটা সহ্য করা সম্ভব ছিলো না। পাণ্ডুর মৃত্যুতে মাদ্রী যে ভাবে আর্তনাদ করে উঠেছিলেন, কুন্তীর কণ্ঠ থেকেও সেই আর্তনাদই বেরিয়ে আসা স্বাভাবিক ছিলো। কিন্তু ছুটে গিয়ে কুন্তী নিজেও আর্তনাদ করলেন না, মাদ্রীর আর্তনাদও স্তব্ধ করে দিলেন। আর যারা পিতৃহীন হলো, তাদেরও কান্নার অবকাশ হলো না। কেননা কুন্তী তাদেরও সেখানে যেতে দেননি। ঐ স্বজন বিরহিত পর্বতশৃঙ্গে যার পাঁচ-পাঁচটি কিশোর পুত্র বর্তমান, তাদের কাছেও কি এই মৃত্যু গোপন রাখা প্রয়োজন ছিলো? কেন ছিলো? তারাও সেই ঘাতকটিকে চিনতো বলে? অথবা তারা আদৌ পাণ্ডুর ক্ষেত্ৰজ ছিলো না, অন্যত্র বর্ধিত হচ্ছিলো কুন্তী আর বিদুরের ছায়ায়? যুধিষ্ঠিরের বয়স ষোলো, ভীম পনেরো, অৰ্জুন চোদ্দো, নকুল সহদেব তেরো। এঁরা কেউই কি নিবোধ শিশু ছিলো যে পিতামাতার এই মৃত্যু দেখে ভয় ব্যতীত আর কিছু অনুভূতি হবে না? এই পুত্রদেরই তো এই মহাসংকটে মহাসহায় স্বাভাবিক ছিলো। ক্ষেত্ৰজ হলে সেখানে ছুটে যাবার অধিকারও আছে তাদের। তবে এই গোপনতা কেন?
এখন দেখা যাচ্ছে সমস্ত ঘটনাটাই কেন কণ্টকিত। যেমন, পতির এই আকস্মিক মৃত্যুতে কেন কুন্তীর কষ্ঠে ক্ৰন্দনের রোল উখিত হলো না? কেন দুজন মানুষের মৃত্যু সে এভাবে চাপা দিয়ে নিঃশব্দ রইলো? কেন এই মৃত্যুকে একান্তভাবেই সাক্ষীহীন রাখলো? কেন সাক্ষহীন রাখবার জন্য মাদ্রীকেও মুছে দিলো এই পৃথিবী নামের গ্রহ থেকে? এতোগুলো ‘কেন’র কোনো জবাব দেননি ব্যাসদেব। ‘যার যা ইচ্ছা ভেবে নাও’, অথবা ‘মেনে নাও এভাবেই রচিত হয়েছে সমস্ত ঘটনাটা। অতএব কুন্তী ব্যতীত আর যারা সাক্ষী রইলো, তারা পর্বতশৃঙ্গের নিঃশব্দ নির্জন নিবিড় অরণ্য, আর মাথার উপরে অনন্ত নীল মহাকাশ। আরো একটা প্রশ্ন: যেই মাত্র ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র হলো, তক্ষুনি কি পাণ্ডুর ক্ষেত্ৰজ নেওয়া আবশ্যক হলো? তাঁর আগেও নয়, পরেও নয়? ক্ষেত্ৰজ নিলেও সেটা এতোদিন গোপন রাখবার কী প্রয়োজন ছিলো? পাণ্ডু অবশ্যই নির্বাসনে যাননি, বাড়ির সঙ্গে সংশ্ৰবচ্যুতও ছিলেন না, তথাপি এটা পাণ্ডু-মাদ্রীর মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত গোপন রইলো কেন?
মহাভারতের মহারণ্যে – ১.৭
দুৰ্যোধন বিদুরের কাছে সততই দুরাত্মা, তথাপি কেন দুরাত্মা তার কোনো প্রমাণ তখনো তিনি দিয়ে উঠতে পারেননি। কিন্তু প্রচারে তো কোনো প্রমাণের প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজন শুধু অনৃতভাষণের দুর্যোধনকে যে কোনো প্রকারে নিষ্পিষ্ট করার প্রয়োজন ছিলো বিদুরের। এ বিষয়ে তাঁর একাগ্রতারও অভাব ছিলো না।
এই পাঁচটি পার্বত্য পুত্র জানে কুরুবংশীয় বিপক্ষীয় মানুষগুলোকে যে ভাবে হোক, পাপপুণ্যের প্রশ্ন দূরে সরিয়ে, সম্পূর্ণ উচ্ছেদ করে, সর্বস্ব গ্রাস করাই তাদের একমাত্র কর্তব্য। এই প্রাসাদের এই মানুষগুলোর প্রতি তাদের কোনো আতীয়তাবোধও যেমন নেই, ভ্রাতৃত্ববোধ ততোধিক দূরে। এখানকার কারোকেই যেমন তারা চেনে না, তেমনি পছন্দও করে না। কারো সঙ্গে ভালো ব্যবহারেরও প্রশ্ন নেই মনের মধ্যে। এই বিশাল রাজপুরীতে যে দুটি মানুষকে তারা চেনে জানে ভালোবাসে তাদের একজন অবশ্যই তাদের মাতা, অন্যজন বিদুর। বিদুর কেন? সেখানেই একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন থাকে। বিদুর ধার্তরাষ্ট্রদের অত্যাচার করলে তুষ্ট হন। ধাৰ্তরাষ্ট্ররা যদি সেই অত্যাচারের পরিবর্তে, অর্থাৎ হিংসার পরিবর্তে প্রতিহিংসায় প্রবৃত্ত হয়, তা হলেই তিনি হায় হায় করে ওঠেন। সারা নগরেই আলোড়ন তুলে দেন।
দু-বছর পরে সময় আগত হলে ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করলেন। পুনরায় বিদুরের প্রচার শুরু হয়ে গেল। পাণ্ডবদের প্রতি ধৃতরাষ্ট্রের কর্তব্যে কোনো অবহেলা ছিলো না। কার্যত তিনি কখনো কোনো অন্যায় করেননি পাণ্ডবদের প্রতি দুর্যোধনও কখনো কোনো দ্বেষ বা বৈরিতার প্রকাশ করেছেন বা মন্তব্য করেছেন এমন কথা এই মহাগ্রন্থের অন্য কোথাও নেই। শুধু বলা আছে বিদুরের মুখে। অর্থাৎ দুর্যোধন তাঁর কার্যের দ্বারা দুর্নামের কোনো প্রমাণ তখনো দিতে পারেননি। যুধিষ্ঠিরও তাঁর কার্যের দ্বারা অথবা ব্যবহারের দ্বারা আমাদের জানতে দেননি তিনি মহাত্মা বা পাপাত্মা। ধৈর্যশীল অথবা অসহিষ্ণু। স্থির অথবা অস্থির ঋজু অথবা বক্র৷ সহৃদয় অথবা হৃদয়হীন। ধর্মপরায়ণ অথবা অধাৰ্মিক অমৃতভাষী অথবা সত্যবাদী। যে সমস্ত গুণাবলী শুনে আমরা পাঠকরা মুগ্ধ হই, সেগুলোও সমস্তই বিদুরের ভাষ্য এবং রচয়িতার রচনা।