একটা সময়ে বিদুরের মনে হলো ভীষ্মই হবেন তার স্বার্থসিদ্ধির প্রধান অন্তরায়। অবশ্য এই চিন্তা বিদুরের নতুন নয়। স্বীয় পুত্র যুধিষ্ঠির এবং অন্য চারটি তরুণকে নিয়ে (অর্থাৎ যে চারটি তরুণ সৰ্বকর্মে যুধিষ্ঠিরকে রক্ষা করবে) যখনই কুন্তী রাজবাটীতে প্রবিষ্ট হলেন, সেই থেকেই শুরু। কেবলমাত্র ভীষ্মই নন, নিজের পিতামহী সত্যবতীর অবস্থানও তখন তার খুব ভালো লাগছিলো না। কেবলই মনে হচ্ছিলো, যে কার্যের জন্য বিদুর এখন অতিমাত্রায় উৎসুক, সে অভিপ্রায়ে সত্যবতীও হয়তো অন্তরায় হবেন। তার কারণ, জন্মসূত্রে সত্যবতী তাঁর অবৈধ পুত্র দ্বৈপায়নকে এনে এই বংশের সমস্ত রক্ত ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে দিয়েছেন, তাঁকে মানুষ করেছেন বিচিত্রবীর্যের ক্ষেত্রজদের সঙ্গে, রাজা শান্তনুর একমাত্র পুত্র দেবব্রত ব্যতীত একটি আর্য সন্তানকেও তিনি তার সংকল্পের সংসারে ঢুকতে দেননি, তথাপি বিদুর যে দাসীপুত্র সেটা তিনি বিস্মৃত হবেন না। কূট বুদ্ধির স্বচ্ছ দর্পণে বিদুর স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলেন রাজত্বের কুঞ্চিকাগুচ্ছ এখন থেকে সত্যবতীর হস্তগত না থাকলেই তার অসাধ্য সাধনের সাধ একদিন পূর্ণ হতে পারে। নচেৎ, কুরুকুলের সিংহাসন বিদুরকুলের হস্তগত হওয়ার পথে বাধা আসা সম্ভব।
কিন্তু সত্যবতীকে বনগমনে পাঠাবেন এবং ভীষ্মকে মাত্রই একজন বৃদ্ধ রাজকর্মচারীতে পরিণত করবেন, তেমন ক্ষমতা বিদুরের নেই। যাঁর আছে তার নাম দ্বৈপায়ন। এতদ্ব্যতীত, ঘুড়ির সুতো এখন আকাশে উড্ডীন, এবার লাটাইটা হাতে পাওয়া প্রয়োজন। যতোদিন সত্যবতী। স্বেচ্ছায় বনগমনে না যাবেন, সেই লাটাই তিনি হস্তান্তরিত করবেন এমন আশা দুরাশা মাত্র। সেটা যাঁর হস্তে দিতে পারেন, অথবা দিতে হয়তো উৎসুকই, তিনি তার অবৈধ পুত্র দ্বৈপায়ন। অতএব সংবাদটি অচিরেই দ্বৈপায়নের শ্রবণে গিয়ে পৌঁছলো, এবং দ্বৈপায়নও অচিরেই এসে পৌঁছলেন। মাতাঁকে বললেন, সময় অতিশয় দারুণ হয়ে উঠেছে, কুরুদের দুর্নীতিপ্রযুক্ত রাজশ্ৰী তাদের পরিত্যাগ করবেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই এঁরা সবংশে কৃতান্তসদনে গমন করবে। এসব দেখার পরিবর্তে বনে গমন করে যোগানুষ্ঠানে যত্ন করুন।’
প্রকৃত পক্ষে সত্যবতীর সংসারে থাকার আর কোনোই যুক্তি ছিলো না। যা তিনি করতে চাইছিলেন, সে কার্য সম্পন্ন করেছেন। এই প্রাসাদের পুত্র পৌত্র সবই এখন তৈরি হয়েছে তার অবৈধ পুত্রের দ্বারা। তাঁর সাফল্যের যান এখন স্টেশন ছাড়িয়ে, হুইসিল বাজিয়ে, অতি দ্রুত চলমান তথাপি তিনি যে পুত্র এসে বলবার পূর্বেই সংসার পরিত্যাগ করেননি, তার কী কারণ থাকতে পারে? স্বামী হারিয়েছেন, পুত্রদ্বয় হারিয়েছেন, পৌত্রকেও হারাতে হলো। সংসার তবে তাঁকে কার টানে ধরে রেখেছিলো? কে সে? এতগুলো মৃত্যুশোক সহ্য করেও সত্যবতী যে সংসার ছাড়তে পারেননি, তার কারণ কি তবে দেবব্রত? যার সান্নিধ্য তাঁকে সেই অপরিমিত শোকেও সান্ত্বনা জুগিয়েছে, তার প্রতি যার আনুগত্যের কোনো সীমা ছিলো না? যখন তার গর্ভজাত অবৈধ পুত্র তাঁকে বনগমনে যেতে বাধ্য করলেন, তখন কি তাঁর সপত্নীপুত্রের জীবন থেকে এবং রাজ্যের নিশ্চল প্রতিষ্ঠা থেকে উচ্ছিন্ন হতে বেদনায় বক্ষ বিদীর্ণ হয়েছিলো? পতির মৃত্যুর পরেও, সারাজীবন ধরে যাঁর আনুকূল্যে এতো সুখ, এতো মর্যাদা, এতো সমৃদ্ধি, স্বাধীনতা, স্বেচ্ছাচারিতা, সেই শতপুত্র অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ, মহারাজা শান্তনুর কুলপ্রদীপ, নিখিলশাস্ত্রবিশারদ সত্যব্রত দেবব্রত, সেই জিতেন্দ্রিয় গাঙ্গেয়পুত্র বিরহিত জীবনকে শান্তভাবে মেনে নিতে তার মন কি বিদ্রোহ করেছিলো? অনন্যকৰ্মা হয়ে যে সপত্নীপুত্র তার পুত্রদের আমৃত্যু ব্ৰহ্মচর্য বরণ করে সত্যবতীর দাসানুদাস হয়ে আছেন, যার দাক্ষিণ্যে দ্বৈপায়ন এই আর্যপুরীতে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছেন, স্বীয় পুত্রের একটি ইঙ্গিতেই ঘর ছেড়ে বনগমনে যেতে যেতে, দীর্ঘশ্বাস মোচন করে, কাষায়বস্ত্রে অশ্রু মার্জনা করে, একবার কি তিনি ফিরে তাকিয়েছিলেন তার দিকেই? এতদ্ব্যতীত, অম্বিকার পৌত্রের দৌরাত্যের কথা তিনি তো এর পূর্বে কিছু শোনেননি? ভীষ্মও তো কিছুই বলেননি। তবে দ্বৈপায়ন কার কাছে শুনে অতি দ্রুত এসে অতি দ্রুতই চলে গেলেন? সেই সঙ্গে সত্যবতীকেও পুত্রবধূদ্বয় সহ যেতে হলো বনগমনে।
এখন সত্যবতীর যেমন বয়স হয়েছে, ভীমের তেমনি বয়স বেড়েছে। তাঁর আর্যসুলভ স্বর্ণাভ কেশদাম এখন শ্বেত শুভ্র। মধুর মতো পিঙ্গলবর্ণ তার ত্বক অনেক ঋতুর স্বাক্ষরে রেখাঙ্কিত। এতোদিনে তিনি বিশ্রাম নিলেন তার রাজকার্য থেকে। এতোদিনে তিনি প্রকৃতই পরিণত হলেন মাত্র একজন রাজকর্মচারীতে। বিদুর যা চেয়েছিলেন তাই সর্বতোভাবে পূর্ণ হলো। এবং খুব অল্পদিনের মধ্যেই সংবাদ পাওয়া গেলো সত্যবতী ইহলীলা সংবরণ করেছেন। বৃদ্ধ রাজকর্মচারী পিতামহ ভীষ্ম হয়তো ভাবলেন, কাল কী ভয়ানক বস্তু! পণ্ডিতেরা বলেন, সূর্যের আগুনে দিবারাত্রির ইন্ধনে মাস ও ঋতুর হাতা দিয়ে নেড়ে নেড়ে কাল মহামোহময় কটাহে প্রাণীবৃন্দকে রন্ধন করছে। প্রত্যহ প্রাণীগণের মৃত্যু হচ্ছে তবু মানুষ চিরকাল বাঁচতে চায়। এর চেয়ে আশ্চর্য আর কী আছে? কিন্তু তিনি এখনো বেঁচে আছেন। এখনো তিনি কালের কবলে পতিত হননি। অথচ বক্ষস্থলে শুধুই শূন্যতার হাহাকার।
মহাভারতের মহারণ্যে – ১.৬
আসলে পাণ্ডুর ক্ষেত্ৰজ পরিচয় দিয়ে সাক্ষী-প্রমাণহীন পরিস্থিতিতে পাঁচটি বড়ো বড়ো পাহাড়ি পুত্রকে নিয়ে কুন্তী যেদিন পুনরায় কুরুরাজ্যে প্রত্যাবৃত হলেন, সেদিন থেকেই সেখানে শনির প্রবেশ ঘটলো। কুরুকুলে আশ্রিত পালিত বিদুর নামের গোয়েন্দাটি, বিশেষভাবে দুর্যোধনের সঙ্গে এমন পর্যাপ্ত প্রতিকূল ব্যবহারে লিপ্ত হলেন যার কোনো সীমা রইলো না। বৈরানল তখনই প্রজ্বলিত হলো। দুর্যোধনের অত্যাচারে নয়, বিদুরের কুচক্রে।