ভীমের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে দুর্যোধন শেষে এই প্রাত্যহিক যন্ত্রণার হাত থেকে নিস্তার পাবার জন্য ভীমের মিষ্টান্নে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে লতাপাতা দিয়ে হাত পা বেঁধে জলের ধারে ফেলে রেখে এলো। হিংসার পরিবর্তে এই তাদের প্রথম প্রতিহিংসা। নচেৎ তারা এই অপরিচিত আগন্তুকদের সঙ্গে অত্যন্ত আহ্লাদিত হয়েই ক্রীড়া করতো। ভীমের নিষ্ঠুর ব্যবহার যখন অসহ্য হয়ে উঠলো তখন তাঁকে রোধ করার কৌশল বার না করলে তারা থাকতোই বা কী করে? অন্য চারজন, যুধিষ্ঠির, অর্জুন, নকুল, সহদেব, এঁরাও তো ভীমের এই অত্যাচার দেখে যথেষ্ট আমোদিত হচ্ছেন। সর্বজ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠির তো অন্তত তার কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে এই ব্যবহার থেকে বিরত করতে পারতো? মহাভারতে ভীমের দেহ এবং শক্তি বিষয়ে যে বর্ণনা আছে তার সঙ্গে একমাত্র একটা হাতির তুলনা হতে পারে। অবশ্য হাতিও বোধহয় তার কাছে বালকমাত্র। ভীম ইচ্ছে করলে একটা বিরাট বৃক্ষকেও উপড়ে তুলে ফেলতে পারে। সে যখন হাঁটে তখন তার জঙ্ঘাপবনে সারা জঙ্গল কম্পিত হতে থাকে। এর সঙ্গে শক্তিতে পাল্লা দিতে যে কোনো মনুষ্যসন্তানই অক্ষম। তদ্ব্যতীত, ধাৰ্তরাষ্ট্রর রাজপুত্র, জন্মাবধি সুখে-সম্পদে লালিত পালিত। নিয়মবন্ধনে যুদ্ধ হলে তারা বীরত্ব দেখাতে সক্ষম, কিন্তু এই সব অশিক্ষিত পটুতা তাদের নেই। পরবর্তী জীবনে এর প্রমাণ দুর্যোধন দিয়েছেন। গদাযুদ্ধে ভীম সর্বদাই দুৰ্যোধনের নিকট পরাজিত হতো। বস্তুত, প্রাকৃতজনের মতো অভব্য মারামারিতে কী করে জয়ী হবে একজন সুখে-লালিত গৃহরক্ষিত শিক্ষিত সন্তান? এঁরা কেউ শিশু নয়, বালকও নয়, বলা যায় কৈশোরও প্রায় উত্তীর্ণ। রীতিমতো যৌবনের চৌকাঠে পা দিতে চলেছে। এই ধরনের খেলার বয়স তাদের ফুরিয়ে গেছে। দুৰ্যোধন দুঃশাসন ইত্যাদি ভ্রাতারা এদের শত্রুপক্ষ ব্যতীত আর অন্য কী ভাবতে পারে? তারা নিজেরাই তো পাঁচটি ভ্রাতা নিজেদের পৃথক করে রেখেছে দুৰ্যোধনদের থেকে। এই যে আক্রমণটা ভীম করে আর অন্য চারটি ভ্রাতা উপভোগ করে, সেখানেই তো একটা মোটা দাগ পড়ে গেলো দুই পক্ষের মাঝখানে। সেই দাগটাকে আরো মোটা করলেন বিদুর। তিনি বলে বেড়ালেন দুর্যোধনের মতো ক্রর পাপাচারী ও ঐশ্বৰ্যলুব্ধ পাপাত্মা ভীমসেনের অপরিমিত পরাক্রম দর্শনে অতিশয় উদ্বিগ্ন হয়েছে। বৃকোদরের শৌর্য দেখে ভেবেছে ভীমকে বধ করতে পারলেই অৰ্জুন আর যুধিষ্ঠিরকে আয়ত্তে আনা সম্ভব হবে। প্রকৃতই অল্প বয়সের অপরিণত বুদ্ধিতে আপদ বিদায়ের এটাই তিনি মোক্ষম অস্ত্র বলে মনে করেছিলেন। এর মধ্যে রাজ্যপ্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির কোনো কুট কৌশল ছিলো কি ছিলো না এসব বিবেচনা বিদুরের নিকট নিরর্থক। যে ছিদ্র তিনি অজস্রবার অন্বেষণ করে করে হতাশ হয়েছেন, পেয়ে গেলেন সেটা। বিদ্যুৎ বেগে বেরিয়ে পড়লেন প্রচার কর্মে রটনা করে বেড়ালেন, দুরাত্মা দুর্যোধন (বেচারা দুৰ্যোধন যে কী করে এই দুরাত্মা আখ্যাটি পেলেন, তার কিন্তু কোনো কারণ এখনো পাওয়া যায়নি) যুধিষ্ঠিরকে রাজত্বের অধিকার দেবার ভয়ে ভীমকে বিষ ভক্ষণ করিয়েছে।
ছেলেদের দেখার ভার সম্ভবত তখন বিদুরের হস্তে অর্পিত। ভীষ্মকে তিনি কেবলমাত্র ধৃতরাষ্ট্রের জীবন থেকেই উচ্ছিন্ন করেননি, ছেলেদের থেকেও করেছেন। নিরপেক্ষ এই ব্যক্তিটির নিকট এই পঞ্চপুত্রকে বেশিদিন ছেড়ে রাখা তার নিরাপদ মনে হয়নি। দুর্যোধনদের অকীর্তির সংবাদ ধৃতরাষ্ট্র এবং ভীষ্ম দুজনেরই শ্রুতিগোচর করা হলো। তারা বিশ্বাস করলেন। দুঃখিত হলেন। বিদুর সকলের নিকটই ধর্মের ধ্বজা। বিদুরের সেই ছদ্মবেশ সকলের কাছেই অভ্রান্ত। কিন্তু এই প্রশ্নটা কেউ তোলেননি, দুর্যোধনের প্রতিপক্ষ তো ভীম নয়, যুধিষ্ঠির যুধিষ্ঠিরকে মারবার চেষ্টা না করে, ভীমকে করা হলো কেন?
দ্বৈপায়ন পুনরায় একটি চমৎকার গল্প উপহার দিলেন পাঠকদের বিষ খেয়েও ভীম না মরে যখন লম্বা একটি নিদ্রা সেরে, জৃম্ভণ তুলে, হস্তপদদ্বয়ের বন্ধন ছিন্ন করে গৃহে প্রত্যাবর্তন করলেন, তখন বিদুরের পিতা রচনা করলেন আর এক রূপকথা। ভীম বিষ খেয়ে জলমগ্ন হয়ে একেবারে নাগলোকে পৌঁছে গিয়েছিলেন। সেখানে বিষধর সর্পকুল তাঁকে ভীষণভাবে দংশন করায় সেই সাপের বিষেই ভীমের শরীরের বিষক্রিয়া তিরোহিত হয়। আর নাগরাজ বাসুকি ভীমকে কুন্তিভোজের দৌহিত্র বলে চিনতে পেরেই প্রতিপ্ৰসন্ন চিত্তে আদর সমাদর করে প্রভূত ধন-রত্ন তো দিলেনই, আবার অমৃতও খাইয়ে দিলেন। তখন ভীম জলের তলা থেকে উঠে বাড়ি ফিরে এলো।
কী আশ্চর্য! ভীমেরা সব এতো পুণ্যবান যে তারা জলেও ডোবে না, বিষেও মরে না। মাত্রই পনেরো-ষোলো বছর বয়সের একটি কিশোরের এই বালকোচিত প্রতিহিংসা নিয়ে বিদুর এমন ষড়যন্ত্র পাকাতে বসলেন কুন্তীর সঙ্গে যেন একটা খুন হয়েছে। এবং সত্যি সত্যি দুটি প্রকৃত খুনী স্ত্রী-পুরুষ যুধিষ্ঠিরকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে কী বললেন, কী চক্রান্ত করলেন, আখেরে দেখা গেলো যুধিষ্ঠিরের চলাফেরা, কথা বলা, সব কিছুই বিদুরের নির্দেশে চলছে। ঝগড়া হলো ভীমের সঙ্গে, সাবধান করলেন যুধিষ্ঠিরকে। যা ঘটাতে চান, যা রটাতে চান, সমগ্র নগরের ঘরে ঘরে তা জানিয়ে দিলেন। রাজপুরীর সদস্যদেরও জানাতে বাকি রাখলেন না।
বিদুরের পিতা রচনার দ্বারা জানিয়েছেন বিদুর হচ্ছেন স্বয়ং ধর্ম। সামান্য অপকর্মের ফলে মর্ত্যভূমিতে জন্ম নিয়েছেন। আর দুর্যোধন ধর্মহীন অসূয়াপ্ৰমত্ত এক অতিপাপাত্মা মানব উল্টোদিকে, বিদুর আর দ্বৈপায়নের দ্বারা যুধিষ্ঠিরকে মহাত্মা প্রতিপন্ন করার চেষ্টাও নিয়ত চলতে লাগলো, কারণ দুর্যোধনই যুধিষ্ঠিরের প্রধান প্রতিযোগী, তার শিক্ষ-দীক্ষা ভীমের প্রতিফলনে সমৃদ্ধ। দুৰ্যোধনকে বিদুর অবিশ্রান্ত অবিরাম শাপশাপান্ত করছেন, প্রচার চালাতে চালাতে রাজ্যবাসীদের মনে বিষ ধরিয়ে দিচ্ছেন, যার ফলে সহস্ৰ সহস্র বছর পেরিয়ে আজও মানুষের মন থেকে সেই ভ্রান্ত বিশ্বাস উৎপাটিত নয়। ভাগ্যের করুণা যে কখন কার ওপর বর্ষিত হয় বোঝা দায়। কপটতার মুখোশ পরে জনগণকে ধোঁকা দিয়ে বোকা বানাতে সব পলিটিশিয়ানই পটু। বিদুর এক শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিক, ক্ষমতালোভী চতুর মহামন্ত্রী।