অবশ্য ধৃতরাষ্ট্রকে নিয়ে মস্তিষ্ক ঘৰ্মাক্ত করে লাভ নেই। মহারাজা শান্তনুর প্রাসাদ এখন অনার্য এবং অবৈধ শোণিতেই বিধৌত। এই কঠিন কার্যটি মাতা সত্যবতীই অতি সুচারুরূপে সম্পন্ন করেছেন। সত্যবতীর দুর্দান্ত সাহস ও অনমিত ইচ্ছার শক্তি লৌহ-সদৃশ তথাপি, বিচিত্রবীর্যের ক্ষেত্ৰজ পুত্ররা দ্বৈপায়নের ঔরসে জন্মালেও কুরুবংশের সন্তান বলেই খ্যাত হবে। সে পরিচয়টা নির্মুল করার জন্যই তথাকথিত পাণ্ডবগণের একবিন্দু অনিষ্টের সম্ভাবনাতেও বিদুর এবং তদীয় পিতা দ্বৈপায়ন অস্থির হয়ে ওঠেন। অনেক তথ্য সযত্নে এড়িয়েও যান। অবশ্য সেই ফাকটুকু সব সময়েই তিনি অতি সুন্দর একটি রূপকথা দিয়ে ভরে দেন। কোনো অভাববোধ থাকে না। সেই সময়ে সেই সব উপাখ্যানকে অবিশ্বাস করতেও ইচ্ছে করে না। উপাখ্যানগুলো যেন অলঙ্কার। পড়তে পড়তে মনে হয় একটা স্বপ্নের জগতে এসে উপস্থিত হয়েছি।
যেমন গান্ধারীর গর্ভধারণ। যা আমাদের জানানো হয়েছে তা হলো দুই বৎসর তিনি গর্ভধারণ করেছিলেন। তারপর দেখা গেলো গর্ভে কোনো সন্তান নেই। একটি শক্ত মাংসপিণ্ড বেরিয়ে এসেছে তার পরিবর্তে ব্যাসদেবের আদেশেই গৰ্ভচু্যত মাংসপিণ্ডকে তিনি মৃতপূৰ্ণ শতসংখ্যক কুম্ভ প্রস্তুত করে কোনো গুপ্তস্থানে রেখে তাতে জলসেচন করতে লাগলেন। কিয়ৎক্ষণের মধ্যেই সেইসব মাংপেশী শত খণ্ডে বিভক্ত হয়ে গেলো। তারপর সেইসব খণ্ড অঙ্গুষ্ঠ প্রমাণ হলে গান্ধারী সেই সকল খণ্ড পূর্বপ্রস্তুত কুম্ভগুলোর মধ্যে সুদৃঢ়রূপে স্থাপন করে অতি সাবধানে রক্ষা করতে লাগলেন। অবশেষে আরো দুই বৎসর গত হলে সেইসব কুম্ভ উদঘাটন করে প্রথমে দুৰ্যোধন জন্মালেন। পরে আরো নিরানব্বইটি পুত্র জন্মালো। তার মানে এইসব মানব সন্তানদের পৃথিবীতে পদার্পণ করতে মোট চার বৎসর লাগলো।
এ গল্পটি অবশ্যই কল্পনাজগতের বিশেষ একটি অবদান সন্দেহ নেই। এমন একটা ঘটনা কখনো কি প্রকৃতি ঘটাতে পারে? সমস্ত ব্যাপারটার মূল ভাষ্যটিই হলো যুধিষ্ঠিরকে যে কোনো প্রকারে জ্যেষ্ঠ দেখানো। শুধু তাই নয়, তার জন্য যদি ষড়যন্ত্র করে পাণ্ডু এবং মাদ্রীকে হত্যা করতে হয়, সেটা গোপন করতেও দ্বৈপায়নের চিন্তার প্রয়োজন হয় না। সততারও প্রয়োজন হয় না। যদিও আমরা পাঠকরা জানি তিনি একজন মহৎ, নিষ্কাম, নিরপেক্ষ, ব্রহ্মচারী, যে ব্রহ্মচর্যের মস্তকে পদাঘাত করে যে কোনো নারীর শয্যায় শায়িত হতে তিনি এক মুহুর্ত চিন্তা করেন না। পাণ্ডু বিচিত্রবীর্যের ক্ষেত্ৰজ, কিন্তু বিদুর কোনোভাবেই কুরুবংশের সঙ্গে যুক্ত নন। একজন দাসীর পুত্র ব্যতীত তার অন্য কোনো পরিচয় নেই। কিন্তু যুধিষ্ঠির বিদুরের পুত্র। এই যুধিষ্ঠিরকে শান্তনুর সিংহাসনে বসাতে হলে পাণ্ডুর ক্ষেত্ৰজ হিশাবে পরিচিতি করাবার প্রয়োজন আছে। যে কারণে বিদুর রাজত্ব পাননি, যুধিষ্ঠির পাণ্ডুর ক্ষেত্ৰজ না হলে সেই একই কারণে রাজত্বের অধিকারী হতে পারবেন না। সেজন্যই পাণ্ডুর ইহলীলা সম্বরণ করার প্রয়োজন ছিলো। তা যদি তিনি স্বাভাবিক উপায়ে না করেন সে ব্যবস্থাও বিদুর করবেন। কিন্তু সাক্ষী-প্রমাণ লুপ্ত করবার জন্য মাদ্রীকেও পৃথিবী থেকে মুছে না দিলে চলবে কেন? পতিবিয়োগে কুন্তী কাঁদেননি। কাঁদলেন, যখন সর্বসমক্ষে মৃতদেহ দুটি ভৰ্ম্মে পরিণত হলো এবং তিনি নির্দোষ বলে পরিগণিত হলেন। রচয়িতা আমাদের জানিয়ে দিলেন কুন্তীর ক্ৰন্দনে বনের পশুপাখিও ব্যথিত হয়ে পড়েছিলো। অথচ, অকস্মাৎ দু-দুজন মানুষ যখন মৃত্যুমুখে পতিত হলেন, স্বতঃই যখন মানুষের বক্ষ থেকে পাজরভাঙা ক্ৰন্দন উত্থিত হয়, তখন তিনি নিঃশব্দ। কেন? এই জিজ্ঞাসারও কি কোনো জবাব আমরা পেয়েছি?
মহাভারতের মহারণ্যে – ১.৫
ভীমের অনুজ্ঞাক্ৰমে কুন্তীর পঞ্চপুত্র যখন পাণ্ডুপুত্র হিশাবেই গৃহীত হয়ে ভীমেরই যত্বে রাজবাটীর ভোগ-উপভোগের দ্বারা পরম সুখে দুর্যোধনাদি ভ্রাতাদের সঙ্গে একই ভাবে বর্ধিত হতে লাগলেন, তখন কখনো শোনা যায়নি দুর্যোধন ঐ পাঁচটি আগন্তুকের সঙ্গে কোনো কলহে বৃত হয়েছেন। দোষ বার করার অনেক চেষ্টা করেও এই মিথ্যা উক্তিটি লিপিবদ্ধ করতে পারেননি রচয়িতা। কিন্তু ভীমের অসহ্য অকথ্য নিষ্ঠুর ব্যবহারে এবং তার অন্য চারটি ভ্রাতার সেই অমানবিক নিষ্ঠুরতার পৃষ্ঠপোষকতা দেখে দুৰ্যোধনাদিরা প্রকৃতই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। মহাভারতের একটি অংশের উল্লেখ করছি। ‘ধার্তরাষ্ট্ররা যখন আহ্লাদিত হয়ে খেলতো ভীম সততই ধৃতরাষ্ট্র পুত্রদের মাথায় মাথায় ঠোকাঠুকি করে রক্ত বার করে দিতো, সজোরে মাটিতে ফেলে দিয়ে চুল ধরে টেনে এমন বেগে আকর্ষণ করতো যে তারা কেউ ক্ষতজানু ক্ষতমস্তক ক্ষতস্কন্ধ হয়ে আর্তস্বরে চিৎকার করতো। জলে সাঁতার কাটবার সময়ে জলে ডুবিয়ে প্রায় মৃতকল্প করে ছাড়তো বৃক্ষে আরোহণ করলে গাছ নাড়িয়ে তাদের মাটিতে ফেলে দিতো।’
এই অদ্ভুত হিংস্র ব্যবহার একমাত্র কুরুভ্রাতাদের উপরেই করতো কিন্তু স্বীয় ভ্রাতাদের প্রতি নয়। যুধিষ্ঠির, অর্জন, নকুল, সহদেবের সঙ্গেও যদি ভীম এই একই খেলা খেলতো, তাহলে মনে হতো অতিকায় বলবান জীবের ন্যায় চেহারা ও চরিত্রের দরুণ এই খেলাই তার স্বাভাবিক। কিন্তু যখন কেবলমাত্র দুর্যোধনদের প্রতিই এরকম একটা শক্রসুলভ অত্যাচার চালাতো, তখন মনে হতো এই পার্বত্য পুত্ৰকটিই এই রাজপ্রাসাদের আজন্ম অধিকারী, ধৃতরাষ্ট্র পুত্ৰগণ-সহ গদি জবরদখল করে বসে আছেন। অতএব এভাবেই হোক, যেভাবেই হোক, তাদের উচ্ছিন্ন করাই একমাত্র উদ্দেশ্য। কে জানে কুন্তী এবং বিদুর তাদের কী বুঝিয়ে কী বলে নিয়ে এসেছেন এখানে। এদের প্রতিহিংসাপরায়ণ জিঘাংসা কখনো কখনো এমন ভয়াল মূর্তিতে প্রকাশিত হতো যেটা এই পুরীর, এই বংশের যে কোনো পুত্রের পক্ষেই একটা বিভীষিকা। এঁরা এখানকার কারো সঙ্গেই মেলামেশা করতো না, ভ্রাতা বলে জানতো কিনা তা-ও বোঝা যেতো না। তবে মানতো না, সেটা সত্য। পরন্তু, বিদুরের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সর্বদাই সম্ভবত ভাবতো, এই শত্রুনিধন কার্যের জন্যই তারা তাদের গিরিগুহা প্রস্রবণের স্বাধীন স্বচ্ছন্দ বিহার থেকে এখানে আগত হয়ে বন্দী হয়েছে। অন্তত জান্তব চরিত্র নিয়ে পৰ্বত-প্রমাণ মনুষ্যাকৃতি ভীম যে সেটাই ভাবতো তাতে কোনো সংশয় নেই। ভীমের চরিত্রও তার আকৃতির তুল্যই ভয়ংকর। সে ক্ষমা করতে জানে না, শক্রকে ভোলে না, পরিহাসচ্ছলেও হাসে না; বক্রভাবে তাকায়, অস্পষ্টভাবে কথা বলে। সে উদ্ধত এবং বহুভোজী, তার চোখের রং পিঙ্গল, এবং মুখমণ্ডল শাশ্রুবিহীন। আসলে পাহাড়ে-পর্বতে জলে-জঙ্গলে শৈশব-কৈশোর কাটিয়ে স্বভাবতই এই বালকেরা কিছুটা হিংস্র চরিত্র নিয়ে বেড়ে উঠেছে। তদ্ব্যতীত, পিতার মৃত্যুতে তারা বিন্দুমাত্র বিচলিত নয়। পিতার জন্য তারা কাঁদেনি, একবারও তাদের মুখ থেকে পিতার নাম উচ্চারিত হয়নি। পাণ্ডু যদি এদের পিতা হতেন, যদি জ্ঞানেন্মেষের সঙ্গে সঙ্গেই পাণ্ডুকে পিতা বলে জানতো এঁরা, তা হলে তাদের পিতৃশোক নিয়ে রচয়িতা একটা দুটো লাইন লিখেই কর্তব্য সম্পন্ন করতেন না। নকুল সহদেব যদি মাদ্রীর পুত্র হতো, তবে তাদের মাতৃশোকও মাত্রই সতেরো দিনে অবসিত হতো না। কুন্তী-বিদুর ব্যতীত বস্তুতই তারা পাণ্ডু-মাদ্রী নামের কোনো মানুষকে কখনো দেখেছে বলে মনে হয় না। কুন্তী-বিদুর নামে চেনা মানুষ দুটি তাদের খুব ভালো করে বুঝিয়ে এনেছেন, এবং অনবরত বোঝাচ্ছেন, এই সিংহাসনের অধিকারী তারা, সুতরাং দখল নিতে হলে ধাৰ্তরাষ্ট্রদের সঙ্গে লড়াই ব্যতীত অন্য কোনো রাস্তা নেই। সে জন্যই ভীমের অত্যাচারের কোনো সীমা ছিলো না, এবং অন্য চারটি ভাইয়েরও এই অত্যাচার উপভোগের আনন্দ ছিলো অসীম। আক্রোশের বীজ বিদুর রন্ধে রন্ধে প্রবিষ্ট করিয়েই এদের নিয়ে এসেছেন এখানে।