সেই শাপের ফলেই ধর্ম বিদুররূপে দাসীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছেন। সুতরাং সেই ধর্মের প্রতি ভক্তি থাকা, বিশ্বাস থাকা, কিছু আশ্চর্য নয়। বিদুর যদি সচেষ্ট হন ভীষ্মর হাত থেকে ধৃতরাষ্ট্রকে সরিয়ে আনা কিছু কঠিন কাজ নয়। বস্তুত, ধৃতরাষ্ট্রও যে খুব অনিচ্ছুক ছিলেন তা নয়, তিনি রাজা, অথচ রাজ্য চালাচ্ছেন ভীষ্ম, এই অবস্থাটা তার মনে হয়তো একটা কণ্ঠকের মতো বিধেও থাকতো। প্রজারা ভীমের অধীন, ভীমের প্রতিই তাদের অবিচলিত শ্রদ্ধা। এটা তার রাজার সিংহাসনে বসে ভালো লাগার কথা নয়। ক্রমে ক্রমে হয়তো একটা হীনমন্যতায় ভুগতে শুরু করেছিলেন। ধূর্ত বিদুর সেই সুযোগটা গ্রহণ করে ক্ষণকাল অপেক্ষমাণ না থেকে তৎক্ষণাৎ সেই ক্ষেত্রে বারিসিঞ্চন করতে আরম্ভ করলেন। ধৃতরাষ্ট্র ভীমের সঙ্গে কোনো পরামর্শ অপেক্ষা বিদুরের বুদ্ধিকেই বেশি প্রাধান্য দিতেন। বিদুরও অনবরত কুপরামর্শ দিয়ে দিয়ে দৃষ্টিহীন মানুষটিকে একেবারে দুর্বল করে ফেললেন। স্বীয় স্বার্থের জন্য তার যেভাবে চলা প্রয়োজন, যেভাবে বলা প্রয়োজন, চুম্বকের মতো ধৃতরাষ্ট্রকে সেভাবেই চালাতেন। তাহলে ছবিটা ঠিক এই দাড়ালো যে কুরুকুলের প্রধান শক্ৰ সত্যবতী, অর্থাৎ কলকাঠিটা তিনিই নেড়েছেন, আর সেই শক্রতাঁকে অব্যাহত রাখার প্রধান সহায় তার অবৈধ পুত্রের অবৈধ পুত্র বিদুর আর ভীমের কেন সত্যবতীর প্রতি এই অন্ধ আনুগত্য সেটা অবশ্য গভীর অন্ধকারেই প্রলেপিত হয়ে থাকলো।
কুরুরাজ্যের একটি সুস্থ বংশধর বিষয়ে হত্যার ন্যায় একটি ভয়ঙ্কর শব্দ কী দুঃসাহসে বিদুর উচ্চারণ করতে পেরেছিলেন তার কারণটাও ক্রমশ বোধগম্য হলো। যে কোনো অবৈধ সন্তান, কি আর্য কি অনার্য, সব সমাজেই অপাঙক্তেয়। তাদের অধিকার সীমিত। তিনি যে সিংহাসনের অধিকার পাননি, সেই জ্বালা মেটাবার একটাই মাত্র উপায় ছিলো বিদুরের যুধিষ্ঠিরকে দুৰ্যোধন অপেক্ষা বয়সে বড় দেখানো এবং যুধিষ্ঠির যে পাণ্ডুর ক্ষেত্ৰজ পুত্র সেটা সকলকে জানানো। আর অন্য চারটি পুত্র কার দ্বারা জন্মগ্রহণ করেছে তা না জানলেও, এঁরাই যে যুধিষ্ঠিরকে সর্বপ্রকারে রক্ষা করবে সেটা ঠিক জানেন। সুতরাং, নিজে রাজ্য না পেলেও তাঁর পুত্র তো পাবে। আর পাবে এই চারটি ভ্রাতার সাহায্যেই তিনি তখন রাজার পিতা হয়ে সেই সম্মান ভোগ করবেন, আর কুরুরা হবে তাঁর তাঁবেদার। কিন্তু সেটা নিশ্চয়ই পাণ্ডু আর মাদ্রীর মৃত্যু ব্যতীত সম্ভব নয়।
যদি তাই হয়, তবে এমন হওয়া কি অসম্ভব যে এই পুত্রদের বিষয়ে পাণ্ডু কিছুই জানতেন না, অর্থাৎ তিনি ক্ষেত্ৰজ পুত্র গ্রহণ করেননি? সেজন্যই তাদের অস্তিত্ব প্রকাশিতব্য ছিলো না? দুৰ্যোধনের জন্মের পরে যে জ্বালা যন্ত্রণা প্রতিহিংসা বিদুরকে প্রায় উন্মত্তের মতো তাঁকে হত্যা করবার জন্য দিশাহারা করে তুলেছিলো। সেই অনুভূতি পুনরায় তাঁর মনকে গ্রাস করলো। কুন্তী কুমারী জীবনে যেমন কর্ণের জন্মদাত্রী হয়েছিলেন, যুধিষ্ঠিরের জন্মদাত্রীও ঠিক একইভাবে হয়েছিলেন। যুধিষ্ঠিরের পরে যে কুন্তী আরো দুটি সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন তাদের কোনো পিতৃপরিচয় অনুমান করা শক্ত, তবে এটা অনুমান করা যায় পাণ্ডু তার প্রথমা পত্নী অপেক্ষা মাদ্রীর সঙ্গেই বেশি সময় কাটাতেন। কুন্তীরও স্বামীকে সাহচর্য দেবার মতো সময় থাকতো না।
ধৃতরাষ্ট্রের তখন বিদুরের চক্ষুই তাঁর চক্ষু, বিদুরের শ্রবণই তাঁর শ্রবণ, বিদুরের বুদ্ধিই তাঁর বুদ্ধি, বিদুরের বাক্যই তার বাক্য। দুর্যোধন বিষয়ে তাঁর পিতৃস্নেহ প্রকৃতিগত ভাবে থাকলেও, তিনিও জানেন তার ছেলে অত্যন্ত দুরন্ত। দুর্যোধনের মাতা কে তা যেমন আমরা জানি না, মনে হয় দুৰ্যোধনও জানেন না। অতএব মাতৃস্নেহ, পিতৃস্নেহ, দুই-ই তার নিকট প্রায় শূন্য। পাঁচটি পুত্রের জন্য কুন্তীর মাতৃস্নেহ দেখতে দেখতে এমন হতে পারে, এই অভাববোধ তাঁকে কষ্ট দিতো। তবে ভ্রাতারা তাঁকে শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে, সেখানেই তার অনেক অভাব পূরণ হয়ে যায়। ধৃতরাষ্ট্র পিতা সেটা ঠিক, কিন্তু কার গর্ভে জন্মেছিলেন সেটা ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না। একশোজন ভ্রাতা, কোন ভ্রাতা কোন মায়ের গর্ভজাত সন্তান সেটা মুছে দেওয়া হয়েছে শিশুকাল থেকেই। বীজ যার বৃক্ষও তার, এই নীতিই পালিত হয়েছে সেখানে পুত্রের প্রয়োজন, পুত্র পেলেই হলো। কোন ক্ষেত্রের বৃক্ষ সেটা বড়ো কথা নয়, কার ক্ষেত্রের বীজ সেটাই আসল। মাতারা প্রয়োজন ফুরোলেই অনাবশ্যক হিশেবে পরিত্যক্ত। সত্য ঘটনাটা আর উদঘাটিত হয় না। সেটা উহ্য।
জানাবার প্রয়োজন না থাকলেই সেটা উহ্য। রাজা-মহারাজারা ইচ্ছেসুখ নারীসংগম করতে পারতেন। সমাজ সেটাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। অবশ্য সেই স্বীকৃতি নরজাতীয় সব মানুষের বেলাতেই অটুট, এখনো অটুট। তবে রাজাদের বেলায় সামান্য পার্থক্য এই যে পতি যার গর্ভেই সন্তান উৎপাদন করুন না কেন, মাতা হবেন তার বিবাহিতা পত্নী। অথাৎ পতি পরমগুরুর এই সব দুস্কৃতিকেও হতভাগ্য রমণীটিকে মান্য করতে হবে। সেই হিশেবেই গান্ধার তাদের মাতা। অনুমিত হয় গান্ধারী যখন পেটে টিউমার নিয়ে দু বছর অসুস্থ ছিলেন, ধৃতরাষ্ট্র তখনই বিভিন্ন রমণীসঙ্গ করে এতোগুলো মানবসন্তানকে পৃথিবীতে এনেছিলেন। আমরা গান্ধারকেই ধৃতরাষ্ট্রের একমাত্র মহিষী বলে জানি, কিন্তু মহাভারতের অনেক স্থলে উল্লেখ আছে ধৃতরাষ্ট্রের পত্নীগণের। তবে সেইসব পত্নীগণকে আমরা প্রত্যক্ষ করি না। দুৰ্যোধনও করেন না। পৈতৃক অধিকারে গান্ধারকেই মাতা হিশেবে গ্রহণ করলেও, পুত্রদের প্রতি কুন্তীর যে স্নেহ, যে মাতৃভাব, গান্ধারীর নিকট সেটা তিনি পাননি।