যদি বলি দুর্যোধন স্বভাবতই কিছুটা সংযত এবং সহিষ্ণু চরিত্রের মানুষ তাহলে শতকরা একশোজনই হয়তো অট্টহাস্য করে উঠবেন। কেননা, কেবলমাত্র শুনে শুনে, প্রচারের মহিমায়, তার উল্টো কথাটাই সকলে বিশ্বাস করে এসেছেন সহস্ৰ সহস্র বছর যাবৎ জন্মমুহূর্ত থেকেই বিদুর বলে আসছেন, কেন দুর্যোধনকে মেরে ফেলা হলো না। পাণ্ডবরা এসে পৌঁছনোমাত্রই বলতে শুরু করছেন, দুৰ্যোধন রাজ্যলোভী, পাপাত্মা অসূয়াবিষে আক্রান্ত, দুর্মুখ অর্থাৎ যাকে আমরা সর্বরকমেই একটা ঘৃণ্য চরিত্র বলে ভাবি, সেইসব বিশেষণেই তাঁকে দ্বৈপায়ণ বিদুরের মুখ দিয়ে বিভূষিত করেছেন। যতোদিন দুর্যোধন অবোধ বালক ছিলেন, এসব উক্তির অর্থ তার বোধগম্য হয়নি। বড়ো হবার পরে যখন বুঝতে পেরেছেন, কী করে সহ্য করেছেন সেটা ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। বিদুর দাসীপুত্র, তিনি রাজপুত্র। বিদুরের স্পর্ধার এবং ঈর্ষার কোনো তুলনা ছিলো না। যখন এসব বিশেষণ দুৰ্যোধনের বুদ্ধির অন্তর্গত হয়েছে, প্রকৃত ক্ষত্রিয় হলে এসব দুর্নামের মূল্য দিতে বিদুরের জিহ্বা তিনি তন্মুহূর্তেই তরবারির আঘাতে চিরদিনের মতো স্তব্ধ করে দিতেন। এসব অকারণ মিথ্যা আখ্যা সহ্য করবার মতো সংযম কোনো মানুষেরই থাকে না, থাকা সম্ভব নয়। জন্মানোমাত্রই কেন মেরে ফেলা হলো না, এমন একটি তীব্র বাক্য যে কোনো মানুষকে বিকৃত করে দিতে পারে। দুৰ্যোধনের পিতা ধৃতরাষ্ট্রই বা কেন প্রতিবাদ করেননি কে জানে! ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ, কিন্তু বধির নন, তথাপি স্বীয় পুত্র বিষয়ে এসব আখ্যা তাঁকে স্পর্শ করেনি কেন? তাহলে বিদুর কখনোই সাহস পেতেন না এই অন্যায় প্রচার চালাতে। ধৃতরাষ্ট্র প্রায় নির্বোধের মতো বিদুরের বুদ্ধি অনুসারে চলতেন, বলতেন। হয়তো পিতার উপর অভিমানবশতই বিদুরকে উচিত শিক্ষা দেবার চাইতে উপেক্ষাই সঙ্গত মনে করেছেন দুর্যোধন।
এই প্রসঙ্গে আরো একটা প্রশ্ন উত্থাপন না করে পারছি না। সেটা হলো ধৃতরাষ্ট্ৰই তো জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা, অন্ধ বিধেয় মাত্রই কিয়ৎকালের জন্য পাণ্ডু রাজা হয়েছিলেন। বহু বৎসর তিনি আর প্রত্যাবৃত হননি। রাজা থাকাকালীনও তাঁর মৃত্যু হয়নি। তবে কী কারণে তার জ্যেষ্ঠ ক্ষেত্ৰজ নামধারী যুধিষ্ঠির রাজা হবেন? রাজত্বভার ধৃতরাষ্ট্রের উপর, তার পুত্রদেরই জনপদবাসী রাজপুত্র হিশেবে গণ্য করেন। তদুপরি, সেই পুত্রেরা তার ঔরসতাজ পুত্র, ক্ষেত্ৰজ নয়।
পরিবারে মহারাজা শান্তনুও জ্যেষ্ঠ ছিলেন না। তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাও রাজত্বের ভার শান্তনুর হস্তেই সমর্পণ করে গৃহত্যাগ করেন। তাদের তিন ভ্রাতার মধ্যে শান্তনু মধ্যম ভ্রাতা। কনিষ্ঠভ্রাতা বল্কীক তার পুত্র পৌত্ৰাদি নিয়ে রাজপরিবারেই বাস করছিলেন। দেবব্রত গঙ্গার অষ্টম গর্ভের সন্তান। নিশ্চয়ই পরিবারের জ্যেষ্ঠ পুত্র নন। কিন্তু সেখানে কনিষ্ঠ ভ্রাতার জ্যেষ্ঠ পুত্রকে সিংহাসনের দাবিদার হিশেবে দেখানো হয়নি। কিন্তু এখানে কেন সেই প্রশ্ন উঠলো?
শান্তনু এবং তাঁর পুত্র দেবব্রত বিষয়েও একটা গল্প তৈরি করেছেন রচয়িতা। শান্তনু যখন গঙ্গার প্রণয়ে মোহাচ্ছন্ন হয়ে তার পাণিপ্রার্থী হলেন, গঙ্গাও একটা শর্ত করেছিলেন বিবাহের পূর্বে। তিনি বলেছিলেন, “আমি যা করবো, তা শুভই হোক, অশুভই হোক, তুমি কখনো জিজ্ঞাসা করতে পারবে না। জিজ্ঞাসা করলেই আমি তোমাকে পরিত্যাগ করে চলে যাবো। শান্তনু তাতেই রাজি হয়েছিলেন। বিবাহের পরে গঙ্গা যখন পুত্রবতী হলেন, জন্মানো মাত্রই সে ছেলেকে তিনি নিজের হাতে গঙ্গায় নিক্ষেপ করে এলেন। দ্বিতীয় পুত্রের বেলায়ও অনুরূপ কাৰ্যই করলেন। তৃতীয় পুত্রের বেলায়ও ঠিক তাই হলো। এক এক করে যখন সাতটি পুত্রকে একই ভাবে তিনি জলাঞ্জলি দিলেন, অষ্টমবারে আর শান্তনু নিজেকে সম্বরণ করতে পারলেন না। বললেন, ‘তুমি কি মানবী না আর কিছু? এভাবে এতোগুলো ছেলেকে জলে ডুবিয়ে মারলে মা হয়ে?”
বলা মাত্রই গঙ্গা শান্তনুকে পরিত্যাগ করে চলে গেলেন। বলে গেলেন, ‘তোমার অষ্টম সন্তানটিকে আমি জলে ফেলবো না, কথা দিলাম।’
আসল উপাখ্যানটি এই। একদা বসুগণ পত্নীসহ বশিষ্ঠের তপোবনে বিহার করতে এসেছিলেন। বশিষ্ঠের কামধেনু নন্দিনীকে দেখে কোনো বসুর পত্নী তাঁকে নিয়ে যান। বশিষ্ঠ আশ্রমে ফিরে এসে দেখেন নন্দিনী নেই। তখন তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে শাপ দেন, যারা আমার ধেনুকে নিয়েছে তারা মর্ত্যে মনুষ্য যোনিতে জন্মগ্রহণ করবেন। বসুরা তখন ব্যাকুল হয়ে অনেক অনুনয় বিনয় করাতে বশিষ্ঠ প্রসন্ন হন, এবং বলেন, ‘ঠিক আছে, তোমরা এক বৎসর পরে শাপমুক্ত হবে, কিন্তু পত্নীর জেদে যে বসু নন্দিনীকে নিয়ে যায়, সে বসু নিজের কর্মফলে দীর্ঘকাল মনুষ্যলোকে বাস করবে।’
গঙ্গা বললেন, “মহারাজ অভিশপ্ত বসুগণের অনুরোধেই তোমাকে বিবাহ করেছি এবং তাদের প্রসব করে জলে নিক্ষেপ করেছি। তবে এই অষ্টম পুত্রটি বেঁচে থাকবে এবং মনুষ্যলোকের অধিবাসী হবে। মৃত্যুর পরে স্বৰ্গলোক প্রাপ্ত হবে।’ এই দেবব্রতই সেই অষ্টম বসু।
এই গল্প এখানে অবান্তর, তথাপি তখনকার লোকেদের বিশ্বাস যে অতিমাত্রায় সরল ছিলো সেটাই জানানো। অবশ্য এখনো বহু মানুষ অশিক্ষার অন্ধকার হেতু সেই সব বিশ্বাস থেকে যে মুক্তি পেয়েছে তা নয়। তাবিজ কবচ তো আছেই। আর আছে মানুষকে ভগবান বানিয়ে সেই পায়েই নিজেকে উৎসর্গ করা। মহারাজা শান্তনুর পত্নী গঙ্গাকে যে গোপনে তার সাতটি পুত্রকে জলে নিক্ষেপ করতে হয়েছে, বাস্তবানুগ ব্যাখ্যা করলে তার প্রকৃত অর্থ এটাই দাঁড়ায় যে সম্ভবত দেহের কোনো দোষে গঙ্গার সন্তানরা মৃত অবস্থাতেই জন্মাতো। সেটা গোপন করতেই এই গল্পের উৎপত্তি। তখনকার দিনে পুত্রের জন্য যে হাহাকার ছিল (এখনও কম নয়) তাতে কোনো মহিলার সব সন্তানই যদি নষ্ট হয়ে যেতো, তাঁকে অবশ্যই মানবী না বলে পিশাচী বা ডাকিনী যোগিনী বলে হত্যা করা হতো, কিংবা তাড়িয়ে দেওয়া হতো। নিম্নবর্গের মধ্যে এবং আদিবাসীদের মধ্যে এখনো তার চলন ফুরিয়ে যায়নি।
মহাভারতের মহারণ্যে – ১.৪
বিদুর ইতিমধ্যেই ভীমের হাত থেকে ধৃতরাষ্ট্রকে অনেকখানি সরিয়ে আনতে পেরেছেন। ধৃতরাষ্ট্র বিদুরকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। তিন ভ্রাতাই একসঙ্গে একই শিক্ষায় একই সহবতে বড় হয়ে উঠেছেন, ধৃতরাষ্ট্র সকলের চাইতে বড়ো, ভালোবাসাই স্বাভাবিক। তা ব্যতীত, ব্যাসদেবের রচনায় বিদুরকে ধর্মাতা এবং পরম বুদ্ধিমান বলে জানানো হয়েছে। বিদুর যে প্রকৃতই ধর্ম সে বিষয়ে দ্বৈপায়ন একটা গল্পও পাঠকদের উপহার দিলেন। মাণ্ডব্য নামে এক মৌন তপস্বী ছিলেন। একদিন কয়েকজন চোর চুরি করে রাজরক্ষীদের ভয়ে পালিয়ে যেতে যেতে মাণ্ডব্যের আশ্রমে ঢুকে সব ধন-দৌলত সেখানেই লুকিয়ে রাখলেন। রক্ষীরা খুঁজে খুঁজে সেই আশ্রমে এলেন। সেখানে সমস্ত অপহৃত ধন দেখে মাণ্ডব্যকে রক্ষীরা নানা প্রশ্ন করলেন, কিন্তু তিনি মৌনব্রত অবলম্বন করার জন্য কোনো জবাব দিলেন না। তখন চোরেদের সঙ্গে রক্ষীরা মাণ্ডব্যকে ধরে নিয়ে গিয়ে শূলে চড়ালেন। মাণ্ডব্যর কিন্তু তাতে মৃত্যু হল না। শেষে রাজা তার পরিচয় পেয়ে শূল থেকে নামালেন। কিন্তু শূলের অগ্রভাগ ভেঙে দেহে রয়ে গেল। একদিন তিনি ধর্মরাজের কাছে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কোন কর্মের ফলে আমাকে এই দণ্ড দিয়েছেন? ধর্ম বললেন, আপনি বাল্যকালে একটি পতঙ্গের পুচ্ছদেশে তৃণ প্রবিষ্ট করেছিলেন, তারই এই ফল। মাণ্ডব্য বললেন, ‘আপনি লঘু পাপে আমাকে এই গুরু দণ্ড দিয়েছেন। আমার শাপে আপনি শূদ্র হয়ে জন্মগ্রহণ করবেন।’