চিন্তার বিষয়, সন্দেহ নেই। অশোকবাবুর লেখার কসরত দেখে আমার তাই মনে হয়েছিল বটে, কিন্তু বক্সিং শিখলে যে শক্তিশালী লেখক হওয়া যায়, এর সন্ধান তো আগে আমায় কেউ দেননি। তাহলে আমি আমার লেখার কায়দাটা অশোকবাবুর কাছে দেখেই শিখতাম। আর অশোকবাবু ও তাঁর চেলাচামুণ্ডারা আমায় লিখতে শেখাবার জন্য কীরূপ সমুৎসুক তা তাঁদের আমার উদ্দেশে বহু অর্থব্যয়ে ছাপা বিশেষ সংখ্যা ‘শনিবারের চিঠি’গুলো পড়লেই বুঝতে পারবেন। বাগ্য়দেবী যে আজকাল বাগ্েদিনী হয়ে বীণা ফেলে সজনে কাঠের ঠেঙ্গা বাজাচ্ছেন, তাও দেখতে পাবেন।
আপনাকে আমি চিনি, তাই আমার ভয় হচ্ছিল আপনার কাগজের ইদানিং লেখাগুলো দেখে যে, কোনোদিন বা আপনারও নামের শেষে (B. A. Cantab) দেখে ফেলি। চিঠি মাত্রই প্রাইভেট, এ কথা নীতিবিদ রামানন্দবাবুর বাড়ি থেকে প্রকাশিত না হলে কেউ কি বিশ্বাস করতে পারতেন? ও-রকম লেখা ওই রকম Oxen বা Cantab B.A. ইউরোপ প্রত্যাগত অতিসভ্য ছাড়া বোধ হয় কেউ লিখতে পারেনই না, পড়তেও পারে না। অশোক বনের চেড়ির মার সীতার প্রতি কীরূপ মর্মান্তিক হযে উঠেছিল জানা নেই। কিন্তু সে মার সরস্বতীর উপর পড়লে যে কীরূপ মারাত্মক হয় তা বেশ বুঝছি। আমার ভয় হচ্ছে, কোনো দিন বা শ্রীযুক্ত বলাই চাটুজ্জে লেখা শুরু করে দেন।
শিবের গীত গাইতে ধান ভেনে নিলাম দেখে (‘ধান ভানতে শিবের গীত’নয়) আপনি হয়তো অসন্তুষ্ট হচ্ছেন, কিন্তু আপনাকে মনে করিয়ে দিচ্ছি যে এটা চিঠি, প্রবন্ধ নয়। আর, চিঠিতে যে আবোল-তাবোল বকবার অধিকার সকলেরই আছে তা ‘শনিবারের চিঠি’পড়লেই দেখতে পাবেন। তাই বলে আমার এ রবিবারের উত্তরও নয়। কেননা তাঁরা এত চিঠি লিখছেন আমায় যে, তার উত্তর দিতে হলে আবার গণেশ ঠাকুরকে ডাকতে হয়। এটাকে মনে করে নিন আসল গান গাইবার আগে একটু তারারা করে নেওয়া, যেমন আপনারা তারারা করেছেন ‘গণবাণী’র আলোচনা করতে গিয়ে।
শ্রীযুক্ত তারারা লিখেছেন ‘লাঙল উঠে গিয়ে এটা (অর্থাৎ গণবাণী) নামল’কিন্তু ‘গণবাণী’র কভারে লেখা আছে, এর সাথে ‘লাঙল’একীভূত হয়েছে। যেমন Forward-এর সাথে Indian Daily News প্রভৃতি একীভূত হয়েছে। আসলে ‘লাঙল’উঠে গেল না, সে রয়ে গেল গণবাণীর মধ্যে। এর কারণ দেখিয়েছেন ওর সম্পাদক মুজফ্ ফর আহমেদ। ‘গণবাণীর’কভারের লেখাটা বোধ হয় শ্রীযুক্ত তারারার চোখে পড়ে নাই। অবশ্য আমি এ ইচ্ছা করছি না যে, তার চোখে লাঙল পড়ুক। চোখে খড়কুটো পড়লেই যেরকম অবস্থা হয়ে ওঠে।
তিনি আরও লিখেছেন এ নামের দল (বঙ্গীয় কৃষক শ্রমিক দল) এদেশে কবে তৈরি হল, কারা করল, কোন ভাতকাপড়ের সংস্থাহীন অনশন অর্ধাশনক্লিষ্ট শ্রমিকরা এর কর্ণধার তা সাধারণকে জানানো উচিত। কোন সাধারণ সভায় এর উদ্াবোধন, সেটাও জানানো দরকার। ‘শ্রীযুক্ত তারারা’’দরিয়া পারে’খবর লেখেন, অনেক কাগজে অনেক রকম কিছু লেখেন, সুতরাং দরিয়ার এপারের দেশি খবরটাও তিনি রাখেন এ বিশ্বাস করা অপরাধের নয় নিশ্চয়। কিন্তু না রাখাটা আপরাধের, অন্তত তাঁর পক্ষে, যিনি রাজনীতি আলোচনা করেন। তিনি আপাত আপনার কাগজে কৃষক-শ্রমিকের খবরাখবর করলেও আহা নিশ্চয় করতেন না। নইলে তিনি ওরকম প্রশ্ন করে নিজেকে লজ্জায় ফেলতেন না। ‘বঙ্গীয় কৃষক-শ্রমিক দল’সম্বন্ধে দু একটা খবর দিচ্ছি ওঁকে, ওঁর ওগুলো জানা থাকলে কাজে লাগবে। গত ফেব্রুয়ারি মাসের ৬ ও ৭ তারিখে কৃষ্ণনগরে নিখিল বঙ্গীয় প্রজা সম্মিলনীর দ্বিতীয় অধিবেশন হয়। যার সভাপতি হয়েছিলেন ডাক্তার নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত। ওই কনফারেন্সের বিবরণী বাংলার ইংরেজি বাংলা প্রায় সব কাগজেই বেরিয়েছিল। লাঙলে তো বেড়িয়েছিলই। অবশ্য ধনিক দলের কাগজ ‘ফরওয়ার্ড’সে বিবরণ ছাপায়নি—শুধু সভার সংবাদটুকু কোনো নারীহরণের মামলার শেষে দেওয়া ছাড়া। এরপর আ্যালবার্ট হল প্রভৃতি স্থানে বঙ্গীয় কৃষক-শ্রমিক দলের যতগুলো সভাসমিতি হয়েছে, তার কোনো সংবাদই ছাপেনি ‘ফরওয়ার্ড’। আমরা দিয়ে আসলেও না। সম্পাদকীয় এই ধর্ম ও সৌজন্যটুকু বাংলার আর কোনো কাগজ অতিক্রম করেনি। অবশ্য ‘ফরওয়ার্ড’বিলেতের ও জগতের আর দেশের শ্রমিকদের কথা লেখে, সুতরাং ও কাগজে বাংলার জঘন্য চাষি-মজুরের কথাও লিখতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। তাতে আবার এ কৃষক-শ্রমিক দলটা তুলসীবাবুর, নলিনীবাবুর মতো ধনিক নেতার গঠিত নয়। গঠন করলে কারা না, যত সব বিভিন্ন জেলার সত্যিকারের মজুর, ক্ষয়কেশে হাড়-চামড়া বের করা, আধ-ন্যাংটা বেগুন সিদ্ধ মৃত মুখওয়ালা চাষা মজুর। আর তাদের নেতাগুলোকে তদ্রূপ—না আছে চাল না আছে চুলো। তাতে বলশেভিক ষড়যন্তর আসামি সব। বোঝো ঠ্যালা।
যাক, ওই প্রজা সম্মিলনের প্রস্তাবসমূহ নবম সংখ্যা লাঙলে বেরিয়েছিল। ওই সম্মিলনের প্রথম প্রস্তাবই হচ্ছে কৃষক-শ্রমিক দল গঠনের প্রস্তাব।
উহার চতুর্থ প্রস্তাব হচ্ছে : ‘লাঙল পত্রিকাকে কৃষক ও শ্রমিকদের মুখপত্ররূপে আপাতত গ্রহণ করা হউক।
প্রস্তাবগুলি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। প্রস্তাবক ও সমর্থক সকলেই বিভিন্ন জেলার কৃষক ও শ্রমিক।
তারপর তারারার সঙ্গীন প্রশ্ন–’কোন কোন ভাত-কাপড়ের সংস্থানহীন অনশন অর্ধাশনক্লিষ্ট শ্রমিকরা এর কর্ণধার’। উত্তরে তারারা মহাশয়কে সানুনয় অনুরোধ জানাচ্ছি তিনি যেন দয়া করে একবার ৩৭, হ্যারিসন রোডের ‘গণবাণী’অফিসে পদধূলি দিয়ে যান। গেলে দেখতে পাবেন বহু হতভাগ্যের পদধূলি ‘গণবাণী’অফিসে স্তূপীকৃত গণবাণীকেও ছাড়িয়ে উঠেছে। সে অফিসে মাদুরের চেয়ে মেঝেই বেশি, চেয়ার টেবিল তো নঞতৎপুরুষ সমাস। মানুষগুলো অধিকাংশই মধ্যপদলোপী কর্মধারয়। অবশ্য খাবার বেলায় বহুব্রীহি। বাজ-পড়া মাথা-ন্যাড়া তালগাছের মতো সব দাঁড়িয়ে রয়েছে। দেখে চোখে জল আসে, বিশেষ করে যখন দেখি ‘গণবাণী’র কর্ণধার হতভাগ্য মুজফ্ ফর আহমদকে। অবস্থা তো ‘ফকির-ফোকরা, হাঁড়িতে ভাত নেই, শানকিতে ঠোকরা। আর শরীরের অবস্থা তেমনই। যেন সমগ্র মানবসমাজের প্রতিবাদ। আমি হলফ করে বলতে পারি মুজফ্রফরকে দেখলে লোকের শুষ্ক চক্ষু ফেটেও জল আসবে। এমন সর্বত্যাগী আত্মভোলা মৌন কর্মী এমন সুন্দর প্রাণ, মন, ধ্যানীর দূরদৃষ্টি, এমন উজ্জ্বল প্রতিভা– সবচেয়ে এমন উদার বিরাট বিপুল মন নিয়ে সে কী করে জন্মাল গোঁড়া মৌলবির দেশি নোয়াখালীতে, এই মোল্লা-মৌলবির দেশ বাংলায় তা ভেবে পাইনে। ও যেন আগুন শিখা, ওকে মেরে নিবৃত্ত করা যায় না। ও যেন পোকায় কাটা ফুল, পোকায় কাটছে তবু সুগন্ধ দিচ্ছে। আজ তাকে যক্ষ্মা খেয়ে ফেলেছে, আর কটা দিন সে বাঁচবে জানি না। ওর পায়ের তলায় বসে শিষ্যত্ব করতে পারে না, এমন অনেক মুসলমান নেতা আজ এই সাম্প্রদায়িক হুড়োহুড়ির ও যুগের হুজুগের সুবিধে নিলে গুছিয়ে নিলে, শুধু মুজফ্েফর দিনের পর দিন অর্ধাসন অনশনে ক্লিষ্ট হয়ে শুকিয়ে মরছে। আমি জানি, এই ‘গণবাণী’বের করতে তাকে দুটো দিন কাঠে কাঠ অনশনে কাটাতে হয়েছে। বুদ্ধু মিয়াঁও আজ লিডার, আর মুজফ্’ফর মরছে রক্ত-বমন করে। অথচ মুজাফ্ফেরের মতো সমগ্রভাবে নেশনকে ভালোবাসতে, ভারতবর্ষকে ভালোবাসতে কোনো মুসলমান নেতা তো দূরের কথা, হিন্দু নেতাকেও দেখিনি। এই সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামার দিনে যদি কারুর মাথা ঠিক থাকে তা মুজফ্,ফরের, ‘লাঙল’ও ‘গণবাণী’র লেখা প্রবন্ধ পড়লেই বুঝতে পারবেন।