আমার মনে হয়, আমাদের নূতন সাহিত্য-ব্রতীদল এর এক-একটা দিক নিয়ে রিসার্চ ও আলোচনার দায়িত্ব নিলে ভালো হয়। আগেই বলেছি, নিশ্চিন্ত জীবনযাত্রার পূর্ণ শান্তি কোনোদিন পাইনি। যদি পাই, সেদিন আপনার এই উপদেশ বা অনুরোধের মর্যাদা রক্ষা যেন করতে পারি – তাই প্রার্থনা করছি আজ।
আবার বলি, যাঁরা মনে করেন – আমি ইসলামের বিরুদ্ধবাদী বা তার সত্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছি, তাঁরা অনর্থক এ-ভুল করেন। ইসলামের নামে যে-সব কুসংস্কার মিথ্যা আবর্জনা স্তূপীকৃত হয়ে উঠেছে – তাকে ইসলাম বলে না-মানা কি ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযান? এ-ভুল যাঁরা করেন, তাঁরা যেন আমার লেখাগুলো মন দিয়ে পড়েন দয়া করে – এ ছাড়া আমার কী বলবার থাকতে পারে?
আমার ‘বিদ্রোহী’ পড়ে যাঁরা আমার উপর বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন, তাঁরা যে হাফেজ-রুমিকে২০ শ্রদ্ধা করেন – এও আমার মনে হয় না। আমি তো আমার চেয়েও বিদ্রোহী মনে করি তাঁদের। এঁরা কি মনে করেন, হিন্দু দেব-দেবীর নাম নিলেই সে কাফের হয়ে যাবে? তাহলে মুসলমান কবি দিয়ে বাংলা-সাহিত্য সৃষ্টি কোনো কালেই সম্ভব হবে না – জৈগুন বিবির পুথি ছাড়া।
বাংলা-সাহিত্য সংস্কৃতের দুহিতা না হলেও পালিতা কন্যা। কাজেই তাতে হিন্দুর ভাবধারা এমন ওতপ্রোতভাবে জড়িত যে, ও বাদ দিলে বাংলা ভাষার অর্ধেক ফোর্স নষ্ট হয়ে যাবে। ইংরেজি-সাহিত্য হতে গ্রিক পুরাণের ভাব বাদ দেওয়ার কথা কেউ ভাবতে পারে না। বাংলা-সাহিত্য হিন্দু-মুসলমানের উভয়েরই সাহিত্য। এতে হিন্দু দেব-দেবীর নাম দেখলে মুসলমানের রাগ করা যেমন অন্যায় হিন্দুরও তেমনই মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবন-যাপনের মধ্যে নিত্য-প্রচলিত মুসলমানি শব্দ তাদের লিখিত সাহিত্যে দেখে ভুরু কোঁচকানো অন্যায়। আমি হিন্দু-মুসলমানের মিলনে পরিপূর্ণ বিশ্বাসী। তাই তাদের এ-সংস্কারে আঘাত হানার জন্যই মুসলমানি শব্দ ব্যবহার করি, বা হিন্দু দেব-দেবীর নাম নিই। অবশ্য এর জন্যে অনেক জায়গায় আমার কাব্যের সৌন্দর্য হানি হয়েছে। তবু আমি জেনে শুনেই তা করেছি।
কিন্তু বন্ধু, এ কর্তব্য কি একা আমারই? আমার শক্তি সম্বন্ধে আপনার যেমন বিশ্বাস, আপনার উপরও আমার সেই একই বিশ্বাস – একই শ্রদ্ধা। আপনিও ‘কামালপাশা’ না লিখে এই হতভাগ্য মুসলমানদের জীবন নিয়ে নাটক লিখতে আরম্ভ করুন না কেন? আমার মনে হয়, ওদিকে আপনার জুড়ি নেই অন্তত আমাদের মধ্যে কেউ। ‘কামাল পাশা’র২১ দরকার আছে জানি, কিন্তু তার চেয়েও দরকার – আমাদের চোখের সামনে আমাদেরই জীবনের এই ট্রাজেডি তুলে ধরা। কবিতা ও প্রবন্ধ-লেখকের আমাদের অভাব নেই। নাটক-লিখিয়ের অভাবও আপনাকে দিয়ে পূরণ হতে পারে। আমাদের সবচেয়ে বড়ো অভাব কথাসাহিত্যিকের। এর তো কোনো আশা ভরসাও দেখছিনে কারুর মধ্যে। অথচ কথাসাহিত্য ছাড়া শুধু কাব্যের মধ্যে আমাদের জীবন, আমাদের আদর্শকে ফুটিয়ে তুলতে কেউ পারবেন না। অনুবাদকের দিক দিয়েও আমরা সবচেয়ে পিছনে। সংগীত, চিত্রকলা, অভিনয় ইত্যাদি ফাইন আর্টের কথা না-ই বললাম।
এত অভাবের কোন্ অভাব পূর্ণ করব আমি একা, বন্ধু! অবশ্য একাই হাত দিয়েছি অনেকগুলি কাজে – তাতে করে হয়তো কোনোটাই ভালো করে হচ্ছে না।
জীবন আমার যত দুঃখময়ই হোক, আনন্দের গান, বেদনার গান গেয়ে যাব আমি, দিয়ে যাব আমি নিজেকে নিঃশেষ করে সকলের মাঝে বিলিয়ে, সকলের বাঁচার মাঝে থাকব আমি বেঁচে। এই আমার ব্রত, এই আমার সাধনা, এই আমার তপস্যা।
আপনার এত সুন্দর, এমন সুলিখিত চিঠির কী বিশ্রী করেই না উত্তর দিলাম। ব্যথা যদি দিয়ে থাকি, আমার গুছিয়ে বলতে না পারার দরুন, তাহলে আমি ক্ষমা না চাইলেও আপনি ক্ষমা করবেন – এ বিশ্বাস আমার আছে।
আপনার বিরাট আশা, ক্ষুদ্র আমার মাঝে পূর্ণ যদি না-ই হয়, তবে তা আমাদেরই কারুর মাঝে পূর্ণত্ব লাভ করুক, আমি কায়মনে এই প্রার্থনা করি।
কাজী নজরুল ইসলাম
গোপাললাল সান্যাল-কে
শ্রীযুক্ত ‘আত্মশক্তি’সম্পাদক মহাশয় সমীপেষু,
বিনয় সম্ভাষণপূর্বক নিবেদন,
আপনার (১৯২৬ খ্রিস্টাব্দের) ২০ আগস্টের ‘আত্মশক্তি’র ‘পুস্তক-পরিচয়’এ নতুন সাপ্তাহিক ‘গণবাণী’র যে পরিচয় দিয়েছেন তৎসম্বন্ধে আমার কিছু বলবার আছে। কারণ ‘গণবাণী’র সাথে আমিও সংশ্লিষ্ট। অবশ্য ‘গণবাণী’পুস্তক নয়, ‘আত্মশক্তি’র পুস্তক-পরিচয়ের সুবিধা নিয়ে পরিচিত হলেও, যেমন আত্মশক্তি আপনার কাগজ হলেও ওই সমালোচনাটা আপনার নয়।
ওই ‘পরিচয়’নিয়ে বলবার কথাটুকু আমারই ব্যক্তিগত, আমাদের কৃষক শ্রমিক দলের নয়। আশা করি, আপনার ঢাউস কাগজের একটুখানি জায়গা ছেড়ে দেবেন আমার বক্তব্যটুকু জানাতে। এ অনুরোধ করলাম এই সাহসে যে, আপনার সম্পাদিত পত্রিকাটি ‘শুক্রবারের আত্মশক্তি’, ‘শনিবারের পত্র’নয়। হঠাৎ এ কথাটা বলার হেতু আছে। কেউ কেউ বলেছিলেন ‘শনিবারের চিঠি’ নাকি একীভূত হয়ে উঠেছে ‘আত্মশক্তি’র সাথে। অবশ্য, আমার একথা বিশ্বাস করতে প্রবৃত্তি হয়নি, যদিও দুতিনবার আমার এইরূপ ভুল ধারণা করিয়ে দিয়েছেন আর কি। এ রকম ধারণার আরও কারণ আছে। হঠাৎ এক দিন কাগজে পড়লাম ইটালির মুসোলিনি আর আফ্রিকার হাব্ সি রাজার ইয়ার্কি চলতে চলতে শেষে কি এক রকম সম্বন্ধ পাকতে চলছে। সেই ইয়ার্কিটা গুজব যে, হাবসি দেশটা ইটালির সাথে একীভূত (Incorporated) হয়ে যাচ্ছে। হবেও বা। অত সাদা Vs অত কালোয়, অত শীত Vs অত গ্রীষ্মের যদি আঁতাত হতে পারে, তবে শনিবারের পত্র আর শুক্রবারের পত্রিকাতেই বা বন্ধুত্ব হবে না কেন, একীভূত না হোক। আমরা আদার ব্যাপারি, অত সব জাহাজের খবর নেওয়া ধৃষ্টতা নিশ্চয়ই। তবে জানেন কি, ‘খোশ খবরকা ঝুটা ভি আচ্ছা’ বলে একটা প্রবাদ আছে, অর্থাৎ ওটাকে উলটিয়ে বললে ওর মানে হয়, ‘বুরা খবরকা সাচ্চা ভি না চা’আপনার ‘অরসিক রায়, প্রবাসীর অশোকবাবুতে যখন কথা কাটাকাটি চলছিল তখন ওটা ইয়ার্কির মতো অত হালকা বোধ হয় নাই, যা দেখে আমারা আশা করতে পারতাম যে ওটা শিগগিরই একটা সম্বন্ধে পেকে উঠবে। ‘ফরেন পলিসি’আমরা বুঝিনে, তবে আমার বন্ধু একদিন বলেছিলেন, এ লেখালেখির শিগগিরই একটা হেস্তনেস্ত হয়ে যাবে। কেননা অশোকবাবুর লেখার ক্ষমতা না থাক, তাঁর মুষ্টি লড়বার ক্ষমতা আছে।