আমার কথাগুলো ‘মরিয়া হইয়া’র মতো শুনাবে, কিন্তু বড়ো দুঃখে দেখে শুনে তেতো-বিরক্ত হয়ে এসব বলতে হচ্ছে। তাই তো বলি যে, ‘বাবা! তোকে রামে মারলেও মারবে, রাবণে মারলেও মারবে। মরতে হয় তো এদেরই একজনের হাতে মর বেশ একটু হাতাহাতি করে ; তাতে সুনাম আছে। কিন্তু ওই হনুমানের হাতে মরিস কেন? হনুমানের হাতে মরার চেয়ে বরং কুম্ভকর্ণকে জাগাতে গিয়ে মরা ঢের ভালো।’ কথাগুলো যখন বলি, তখন লোকে হাততালি দেয়, ‘আল্লাহু আকবর’, ‘বন্দেমাতরম্’ ধ্বনিও করে ; কিন্তু তারপর আর তাদের খবর পাইনে।
আমিও মানি, গড়ে তুলতে হলে একটা শৃঙ্খলার দরকার। কিন্তু ভাঙার কোনো শৃঙ্খল বা সাবধানতার প্রয়োজন আছে মনে করিনে। নূতন করে গড়তে চাই বলেই তো ভাঙি – শুধু ভাঙার জন্যই ভাঙার গান আমার নয়। আর ওই নূতন করে গড়ার আশাতেই তো যত শীঘ্র পারি ভাঙি – আঘাতের পর নির্মম আঘাত হেনে পচা-পুরাতনকে পাতিত করি। আমিও জানি, তৈমুর, নাদির সংস্কার-প্রয়াসী হয়ে ভাঙতে আসেনি, ওদের কাছে নতুন-পুরাতনের ভেদ ছিল না। ওরা ভেঙেছিল সেরেফ ভাঙার জন্যই। কিন্তু বাবর ভেঙেছিল দিল্লি-আগ্রা, ময়ূরাসন-তাজমহল গড়ে তোলার জন্য। আমার বিদ্রোহ ‘যখন চাহে এ মন যা’র বিদ্রোহ নয়, ও আনন্দের অভিব্যক্তি সর্ববন্ধনমুক্তের – পূর্ণতম স্রষ্টার।
আপনার ‘মুসলিম-সাহিত্য’ কথাটার মানে নিয়ে অনেক মুসলমান সাহিত্যিকই কথা তুলবেন হয়তো। ওর মানে কি মুসলমানের সৃষ্ট সাহিত্য না মুসলিমভাবাপন্ন সাহিত্য? যদি সত্যিকার সাহিত্য হয়, তবে তা সকল জাতিরই হবে। তবে তার বাইরের একটা ফর্ম থাকবে নিশ্চয়। ইসলাম ধর্মের সত্য নিয়ে কাব্যরচনা চলতে পারে, কিন্তু তার শাস্ত্র নিয়ে চলবে না। ইসলাম কেন, কোনো ধর্মেরই শাস্ত্র নিয়ে কাব্য লেখা চলে বলে বিশ্বাস করি না। ইসলামের সত্যকার প্রাণশক্তি গণতন্ত্রবাদ, সর্বজনীন ভ্রাতৃত্ব ও সমানাধিকারবাদ।
ইসলামের এই অভিনবত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব আমি তো স্বীকার করিই, যাঁরা ইসলাম ধর্মাবলম্বী নন তাঁরাও স্বীকার করেন। ইসলামের এই মহান সত্যকে কেন্দ্র করে কাব্য কেন, মহাকাব্য সৃষ্টি করা যেতে পারে। আমি ক্ষুদ্র কবি, আমার বহু লেখার মধ্য দিয়ে আমি ইসলামের এই মহিমার গান করেছি। তবে কাব্যকে ছাপিয়ে ওঠেনি সে-গানের সুর। উঠতে পারেও না। তাহলে তা কাব্য হবে না। আমার বিশ্বাস কাব্যকে ছাপিয়ে উদ্দেশ্য বড়ো হয়ে উঠলে কাব্যের হানি হয়। আপনি কী চান তা আমি বুঝতে পারি – কিন্তু সমাজ যা চায়, তা সৃষ্টি করতে আমি অপারগ। তার কাছে এখনও –
আল্লা আল্লা বলো রে ভাই নবি করো সার।
মাজা দুলিয়ে পারিয়ে যাব ভবনদীর পার॥
রীতিমতো কাব্য। বুঝবার কোনো কষ্ট হয় না, আল্লা বলতে এরং নবীকে সার করতে উপদেশও দেওয়া হল, মাজাও দুলল ভবনদী পারও হওয়া গেল! যাক, বাঁচা গেল – কিন্তু বাঁচল না কেবল কাব্য। সে বেচারি ভবনদীর এ পারেই রইল পড়ে। ঝগড়ার উৎপত্তি এইখানেই। কাব্যের অমৃত যারা পান করেছে, তারা বলে – মাজা যদি দুলাতেই হয় দাদা, তবে ছন্দ রেখে দুলাও ; পারে যদি যেতেই হয়, তবে তরি একেবারে কমলবনের ঘাটে ভিড়াও। অমৃত যারা পান করেনি – আর এরাই শতকরা নিরানব্বই জন – তারা বলে, কমলবন, টমলবন জানিনে বাবা, সে যদি বাঁশবন হয়, সেও-ভি আচ্ছা – কিন্তু একেবারে ভবনদীর ঘাটায় লাগাও নৌকা। এ অবস্থায় কী করব বলতে পারেন? আমি ‘হুজ্জতুল ইসলাম’১৯ লিখব, না সত্যিকার কাব্য লিখব?
এরা যে শুধু হুজ্জতুল ইসলামই পড়ে, এ আমি বলব না ; রসজ্ঞানও এদের অপরিমিত। আমি দেখেছি, এরা দল বেঁধে পড়ছে –
‘ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ হাঁটিয়া চলিল।’
অথবা
‘লাখে লাখে ফৌজ মরে কাতারে কাতার
শুমার করিয়া দেখি পঞ্চাশ হাজার॥’
আর এই কাব্যের চরণ পড়ে কেঁদে ভাসিয়ে দিয়েছে। উম্মর-উম্মিয়ার প্রশংসায় রচিত –
‘কাগজের ঢাল মিয়াঁর তালপাতার খাঁড়া
আর লগির গলায় দড়ি দিয়ে বলে চল হামারা ঘোড়া।’
পড়তে পড়তে আনন্দে গদগদ হয়ে উঠেছে।
বিদ্রুপ আমি করছিনে, বন্ধু – এ আমার চোখের জল-মেশানো হাসির শিলাবৃষ্টি। সত্য সত্যই আমার লেখা দিয়ে যদি আমার মুমূর্ষু সমাজের চেতনা সঞ্চার হয়, তাহলে তার মঙ্গলের জন্য আমি আমার কাব্যের আদর্শকেও না হয় খাটো করতে রাজি আছি। কিন্তু আমার এ ভালোবাসার আঘাতকে এরা সহ্য করবে কিনা সেটাই বড়ো প্রশ্ন। হিন্দু লেখকগণ তাঁদের সমাজের গলদ-ত্রুটি-কুসংস্কার নিয়ে কী না কশাঘাত করেছেন সমাজকে ; – তা সত্ত্বেও তাঁরা সমাজের শ্রদ্ধা হারাননি। কিন্তু এ হতভাগ্য মুসলমানের দোষ-ত্রুটির কথা পর্যন্ত বলবার উপায় নেই। সংস্কার তো দূরের কথা, তার সংশোধন করতে চাইলেও এরা তার বিকৃত অর্থ করে নিয়ে লেখককে হয়তো ছুরিই মেরে বসবে। আজ হিন্দুজাতি যে এক নবতম বীর্যবান জাতিতে পরিণত হতে চলেছে, তার কারণ তাদের অসমসাহসিক সাহিত্যিকদের তীক্ষ্ণ লেখনী।
আমি জানি যে, বাংলার মুসলমানকে উন্নত করার মধ্যে দেশের সবচেয়ে বড়ো কল্যাণ নিহিত রয়েছে। এদের আত্ম-জাগরণ হয়নি বলেই ভারতের স্বাধীনতার পথ আজ রুদ্ধ।
হিন্দু-মুসলমানের পরস্পরের অশ্রদ্ধা দূর করতে না পারলে যে এ পোড়া দেশের কিছু হবে না, আমিও মানি। এবং আমিও জানি যে, একমাত্র সাহিত্যের ভিতর দিয়েই এ-অশ্রদ্ধা দূর হতে পারে। কিন্ত ইসলামের ‘সভ্যতা-শাস্ত্র-ইতিহাস’ এ সমস্তকে কাব্যের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করা দুরূহ ব্যাপার নয় কি?