বেদনা-সুন্দরের পূজা যাঁরাই করেছেন, তাঁদের চিরকাল একদল লোক হুজুগে বলে নিন্দা করেছে। আর, এরাই দলে ভারী। এরা মানুষের ক্রন্দনের মাঝেও সুর-তাল-লয়ের এতটুকু ব্যতিক্রম দেখলে হল্লা করে যে, ও কান্না হাততালি দেওয়ার মতো কান্না হল না বাপু, একটু আর্টিস্টিকভাবে নেচে নেচে কাঁদো! সকল সমালোচনা উপরে যে-বেদনা, তাকে নিয়েও আর্টশালারক্ষী – এই প্রাণহীন আনন্দ-গুণ্ডার কুশ্রী চিৎকারে হুইটম্যানের মতো ঋষিকেও অ-কবির দলে পড়তে হয়েছিল।
আমার হয়েছে সাপের ছুঁচো-গেলা অবস্থা। ‘সর্বহারা’১০ লিখলে বলে – কাব্য হল না ; ‘দোলন-চাঁপা’, ‘ছায়ানট’ লিখলে বলে – ও হল ন্যাকামি! ও নিরর্থক শব্দ ঝংকার দিয়ে লাভ হবে কী? ও না লিখলে কার কী ক্ষতি হত?
‘লিরিক’ নাকি ‘লভ’ এবং ‘ওয়ার’ নিয়ে। আমাদের দেশের যুদ্ধ নাই (হিন্দু-মুসলমান যুদ্ধ ছাড়া) ; কাজেই মানুষের নির্যাতন দেখে তার সেই মর্মব্যথার গান গাইলে এখানে হয় তা ‘বীভৎস বিদ্রোহ-রস’। ওটা দিয়ে নাকি মানুষের প্রশংসা সহজলভ্য হয় বলেই আজকালকার লেখকরা রসের চর্চা করে।
‘আমার লেখা কাব্য হচ্ছে না, আমি কবি নই’ – এ বদনাম সহ্য করতে হয়তো কোনো কবিই পারে না। কাজেই যারা করছিল মানুষের বেদনার পূজা, তারা এখন করতে চাচ্ছে প্রাণহীন সৌন্দর্যসৃষ্টি। এমন একটা যুগ ছিল – সে সত্যযুগই হবে হয়তো – যখন মানুষের দুঃখ আজকের মতো এত বিপুল হয়ে ওঠেনি। তখন মানুষ নিশ্চিন্ত নির্ভরতার সঙ্গে ধ্যানের তপোবনে শান্ত সামগান গাইবার অবকাশ পেয়েছে। কিন্তু যেইমাত্র মানুষ নিপীড়িত হতে লাগল, অমনি সৃষ্টি হল বেদনার মহাকাব্য – রামায়ণ, মহাভারত, ইলিয়াড প্রভৃতি। আর তাতে সমাজের আজকালকার বেঁড়ে-উস্তাদ সমালোচকদের তথাকথিত ‘বীভৎস বিদ্রোহ বা রুদ্র রসের’প্রাধান্য থাকলেও – তা কাব্য হয়নি. এমন কথা কেউ বলবে না।
এই বেদনার গান গেয়েই আমাদের নবীন সাহিত্য-স্রষ্টাদের জন্য নূতন সিংহাসনগড়ে তুলতে হবে। তারা যদি কালিদাস১১, ইয়েটস১২, রবীন্দ্রনাথ১৩ প্রভৃতি রূপস্রষ্টাদের পাশে বসতে নাই পায়, পুশকিন১৪, দস্তয়ভ্স্কি১৫, হুইটম্যান১৬, গর্কি, জোহান বোয়ারের১৭ পাশে ধূলির আসনে বসবার অধিকার তারা পাবেই। এই ধূলির আসনই একদিন সোনার সিংহাসনকে লজ্জা দেবে ; এই তো আমাদের সাধনা।
দুঃখী বেদনাতুর হতভাগাদের একজন হয়েই আমি বেদনার গান গেয়েছি, – সে-গানে হয়তো রূপ-রং ফুটে ওঠেনি আমি ভালো রংরেজ নই বলে ; কিন্তু সেই বেদনার সুরকে অশ্রদ্ধা করবার মতো নীচতা মানুষের কেমন করে আসে। অথচ এইসব গালাগালির বিপক্ষে কোনো প্রতিবাদও তো হতে দেখিনি।
আজ কিন্তু মনে হচ্ছে, শত্রুর নিক্ষিপ্ত বাণে এতটা বিচলিত হওয়া আমার উচিত হয়নি। আমার দিনের সূর্য ওদের শরনিক্ষেপে মুহূর্তের তরে আড়াল পড়লেও চিরদিনের জন্য ঢাকা পড়বে না – আমার এ বিশ্বাস থাকা উচিত ছিল। কিন্তু এর জন্য দুঃখও করিনে। অন্তত আমি তো জানি, আমার এই তো জানি, আমার এই তো চলার আরম্ভ, আমার সাহিত্যিক জীবনের এই তো সবেমাত্র সেদিন শুরু। আজই আমি আমার পথের দাবি ছাড়ব কেন? ওদের রাজপথে ওরা চলতে যদি নাই দেয়, কাঁটার পথেই চলব সমস্ত মারকে সহ্য করে। অন্তত পথের মাঝ পর্যন্ত তো যাই। আমার বনের রাখাল ভাইরা যে মালা দিয়ে আমায় সাজাল, সে-মালার অবমাননা-ই বা করব কেমন করে? ঠিক বলেছ বন্ধু এবার তপস্যাই করব – পথে চলার তপস্যা।
‘বিদ্রোহী’র১৮ জয়-তিলক আমার ললাটে অক্ষয় হয়ে গেল আমার তরুণ বন্ধুদের ভালোবাসায়। একে অনেকেই কলঙ্ক-তিলক বলে ভুল করেছে, কিন্তু আমি করিনি। বেদনা-সুন্দরের গান গেয়েছি বলেই কি আমি সত্য-সুন্দরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছি? আমি বিদ্রোহ করেছি – বিদ্রোহের গান গেয়েছি অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে, – যা মিথ্যা, কলুষিত, পুরাতন, – পচা সেই মিথ্যা-সনাতনের বিরুদ্ধে, ধর্মের নামে ভণ্ডামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। হয়তো আমি সব কথা মোলায়েম করে বলতে পারিনি, তলোয়ার লুকিয়ে তার রুপার খাপের ঝকমকানিটাকেই দেখাইনি – এই তো আমার অপরাধ। এরই জন্য তো আমি বিদ্রোহী। আমি এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছি, সমাজের সকল কিছু কুসংস্কারের বিধি-নিষেধের বেড়া অকুতোভয়ে ডিঙিয়ে গেছি, এর দরকার ছিল মনে করেই।
যাক আগেই বলেছি, এ কুম্ভকর্ণ-মার্কা সমাজকে জাগাতে হলে আঘাত দিয়েই জাগাতে হবে। একদল প্রগতিশীল বিদ্রোহীর উদ্ভব না হলে এর চেতনা আসবে না। কুম্ভকর্ণের পায়ে সুড়সুড়ি দিয়ে বা চিমটি কেটে এর ঘুম ভাঙাবার যে সব পলিসির উল্লেখ আছে, তা একেবারে মোলায়েম নয়। সেই পলিসিই একবার একটু পরখ করে দেখুকই না ছেলেরা! এতে কী আর এমন হবে! আপনি বলবেন, কুম্ভকর্ণ না হয় জাগল ভায়া, কিন্তু জেগে সে যেরকম হাঁ-টা করবে, সে হাঁ তো সংকীর্ণ নয়, তখন! আমি বলি কী, তখন কুম্ভকর্ণ তাদেরই ধরে ‘জলপানি’ করবে, যারা তার ঘুম ভাঙাতে গিয়েছিল।
এতই তো মরছে, না হয় আরো দু-দশটা মরবে! আপনি বলবেন, ভয় তো ওইখানেই বন্ধু : বেড়ালের গলার ঘন্টা বাঁধতে এগোয় কে? আমি বলি, সে দুঃসাহস যদি আমাদের কারুর না থাকে, তাহলে নিশ্চিন্ত হয়ে নাকে সর্ষের তেল দিয়ে সকলে ‘আসহাব কাহাফে’র মতো রোজ-কিয়ামত তক ঘুমোতে পারেন। সমাজকে জাগাবার আশা একেবারেই ছেড়ে দিন! কারুর পান থেকে এতটুকু চুন খসবে না, গায়ে আঁচড়টি লাগবে না ; তেল-কুচকুচে নাদুস-নুদুস ভুঁড়িও বাড়বে এবং সমাজেও সাথে সাথে জাগতে থাকবে – এ আশা আলেম সমাজ করতে পারেন, আমরা অবিশ্বাসীর দল করিনে।