আমার শক্তি স্বল্প, তবু এই আট বছর ধরে আমি দেশে দেশে গ্রামে গ্রামে ঘুরে কৃষক-শ্রমিক তরুণদের সংঘবদ্ধ করবার চেষ্টা করেছি – লিখেছি, বলেছি, চারণের মতো পথে পথে গান গেয়ে ফিরেছি। অর্থ আমার নেই, কিন্তু সামর্থ্য যেটুকু আছে, তা ব্যয় করতে কুণ্ঠিত কোনোদিন হয়েছি, এ-বদনাম আর যেই দিক, আপনি দেবেন না বোধ হয়। আমার এই দেশ-সেবার সমাজ-সেবার ‘অপরাধের’ জন্যে শ্রীমৎ সরকার বাবাজির আমার উপর দৃস্টি, অতি মাত্রায় তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে। আমার সবচেয়ে চলতি বইগুলোই গেল বাজেয়াফ্ত হয়ে। এই সেদিনও পুলিশ আবার জানিয়ে দিয়েছে, আমার নব-প্রকাশিত ‘রুদ্র-মঙ্গল’৮ আর বিক্রি করলে আমাকে রাজদ্রোহ অপরাধে ধৃত করা হবে। আমি যদি পাশ্চাত্য ঋষি হুইটম্যানের সুরে সুরে মিলিয়ে বলি৯ :
‘Behold, I do not give a little charity.
When I give, I give myself.’
আপনি সমাজকে ‘পতিত, দয়ার পাত্র’ বলেছেন। আমিও সমাজকে পতিত Demoralized মনে করি – কিন্তু দয়ার পাত্র মনে করতে পারিনে। আমার জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে আমি আমার সমাজকে মনে করি ভয়ের পাত্র। এ-সমাজ সর্বদাই আছে লাঠি উঁচিয়ে ; এর দোষ-ত্রুটির আলোচনা করতে গেলে নিজের মাথা নিয়ে বিব্রত হয়ে পড়তে হয়। আপনি হয়তো হাসছেন, কিন্তু আমি তো জানি, আমার শির লক্ষ করে কত ইট-পাটকেলই না নিক্ষিপ্ত হয়েছে।
আমার কী মনে হয় জানেন? স্নেহের হাত বুলিয়ে এ পচা সমাজের কিছু ভালো করা যাবে না। যদি সেরকম ‘সাইকিক-কিওর’-এর শক্তি কারুর থাকে, তিনি হাত বুলিয়ে দেখতে পারেন। ফোঁড়া যখন পেকে পচে ওঠে তখন রোগী সবচেয়ে ভয় করে অস্ত্র-চিকিৎসককে। হাতুড়ে ডাক্তার হয়তো কখনও আশ্বাস দিতে পারে যে, সে হাত বুলিয়ে ওই গলিত ঘা সারিয়ে দেবে এবং তা শুনে রোগীরও খুশি হয়ে উঠবার কথা। কিন্তু বেচারি ‘অবিশ্বাসী’ অস্ত্র-চিকিৎসক তা বিশ্বাস করে না। সে বের করে তার ধারালো ছুরি ; চালায় সে-ঘায়ে ; রোগী চেঁচায়, হাত পা ছোঁড়ে, গালি দেয়। সার্জন তার কর্তব্য করে যায়। কারণ সে জানে, আজ রোগী গালি দিচ্ছে, দু-দিন পরে ঘা সেরে গেলে সে নিজে গিয়ে তার বন্দনা করে আসবে।
আপনি কী বলেন? আমি কিন্তু অস্ত্রচিকিৎসার পক্ষপাতী। সমাজ তো হাত-পা ছুঁড়বেই, গালিও দেবে ; তা সইবার মতো শক্ত চামড়া যাঁদের নেই, তাঁদের দিয়ে সমাজসেবা হয়তো চলবে না। এই জন্যেই আমি বারেবারে ডাক দিয়ে ফিরছি নির্ভীক তরুণ ব্রতীদলকে। এ-সংস্কার সম্ভব হবে শুধু তাদের দিয়েই। এরা যশের কাঙাল নয়, মানের ভিখারি নয়। দারিদ্র্য সইবার মতো পেট, আর মার সইবার মতো পিঠ যদি কারুর থাকে, তো এই তরুণদেরই আছে। এরাই সৃষ্টি করবে নূতন সাহিত্য, এরাই আনবে নূতন ভাবধারা, এরাই গাইবে ‘তাজা-ব-তাজা’র গান।
আপনি হয়তো আমায় এদেরই অগ্রনায়ক হতে ইঙ্গিত করেছেন। কিন্তু আপনার মতো আমিও ভাবি, আজও ভাবি যে, কে সে ভাগ্যবান এদের অগ্রনায়ক। আমার মনে হয়, সে ভাগ্যবান আজও আসেনি। আমি অনেকবার বলেছি, আজও বলছি – সে ভাগ্যবানকে আমি দেখিনি, কিন্তু দেখলে চিনতে পারব। আমি বাণী – তাঁরই আগমনি-গান। আমি তাঁরই অগ্রপথিক তূর্যবাদক। আমার মনে হয়, সেই ভাগ্যবান পুরুষেরই ইঙ্গিতে আমি শুধু গান গেয়ে চলেছি। – জাগরণী গান। আঘাত, নিন্দা. বিদ্রুপ, লাঞ্ছনা দশদিক হতে বর্ষিত হচ্ছে আমার উপর, তবু আমি তাঁর দেওয়া তূর্য বাজিয়ে চলেছি। এ-বিশ্বাস কোথা হতে কী করে যে আমার মাঝে এল, তা আমি নিজেই জানিনে। আমার শুধু মনে হয়, কার যেন আদেশ – কার যেন ইঙ্গিত আমার বেদনারও রন্ধ্রপথে নিরন্তর ধ্বনিত হয়ে চলেছে। তাঁর আসার পদধ্বনি আমি নিরন্তর শুনছি আমার হৃৎপিণ্ডের তালে তালে, আমার শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রতি আক্ষেপে।
তবে এও আমি বিশ্বাস করি, সেই অনাগত পুরুষের আমাদের যে কারুর মধ্যে মূর্তি পরিগ্রহ করা বিচিত্র নয়।
আমি এতদিন তাঁকে খুঁজেছি আমারও ঊর্ধ্বে। তাঁকে আমারই মাঝে খুঁজতেও হয়তো চেয়েছি। দেখা তাঁর পেয়েছি এমন কথা বলব না, তবে এ-কথা বলতেও আমার আজ দ্বিধা নেই যে, আমি ক্রমেই তাঁর সান্নিধ্য অনুভব করছি। এমনও মনে হয়েছে কতদিন, যেন আর একটু হাত বাড়ালেই তাঁকে ধরতে পারি।
আপনার ‘হাত-বাড়াবে কি?’ কথাটা আমায় সত্যিই ভাবিয়ে তুলেছে। তাই আমি খুঁজে ফিরছি নিরাশ-হতাশ্বাসে সেই নিশ্চিত শান্তি – যার ধ্যান-লোকে বসে আমি তপস্যা-প্রোজ্জ্বল নেত্রে আমার অবহেলিত আমাকে খুঁজে দেখবার অবকাশ পাব। এ-শান্তি আমার এ জীবনে পাব কি না জানি না ; যদি পাই – আপনার জিজ্ঞাসার শেষ উত্তর দিয়ে যাব সেদিন।
আপনার কয়েকটি মৃদু অভিযোগের উত্তর দিতে চেষ্টা করব এইবার।
আপনি আমার যে-দায়িত্বের উল্লেখ করেছেন, সে-দায়িত্ব আমার সত্যিকার কাব্যসৃষ্টির, না সমাজ-সংস্কারের? আমি আর্টের সুনিশ্চিত সংজ্ঞা জানিনে জানলেও মানিনে। ‘এই সৃষ্টি করলে আর্টের মহিমা অক্ষুণ্ণ থাকে, এই সৃষ্টি করলে আর্ট ঠুঁটো হয়ে পড়ে’ – এমনিতরো কতকগুলো বাঁধা নিয়মের বলগা কষে কষে আর্টের উচ্চৈঃশ্রবার গতি পদে পদে ব্যাহত ও আহত করলেই আর্টের চরম সুন্দর নিয়ন্ত্রিত প্রকাশ হল – এ কথা মানতে আর্টিস্টের হয়তো কষ্টই হয়, প্রাণ তার হাঁপিয়ে ওঠে। জানি, ক্লাসিকের কেশো রোগীরা এতে উঠবেন হাড়ে হাড়ে চটে, তাঁদের কলম হয়ে উঠবে বাঁশ। এরই মধ্যে হয়েও উঠেছে তাই। তবু আজ এ-কথা জোর গলায় বলতে হবে নবীনপন্থীদের। এই সমালোচকদের নিষেধের বেড়া যাঁরাই ডিঙিয়েছেন, তাঁদেরই এদের গোদা পায়ের লাথি খেতে হয়েছে, প্রথম শ্রেণি হতে দ্বিতীয় শ্রেণিতে নেমে যেতে হয়েছে।