হঠাৎ মুদির প্রসঙ্গটা এসে পড়বার কারণ আছে, বন্ধু! জানেন তো আমরা কানাকড়ির খরিদ্দার। কাজেই ওজনে এতটুকু কম হতে দেখলে প্রাণটা ছ্যাঁক করে ওঠে। মুদিওয়ালার ওতে লাভ কতটুকু জানিনে, কিন্তু আমাদের ক্ষতির পরিমাণ আমরা ছাড়া কেউ বুঝবে না ; – মুদিওয়ালা তো নয়ই। তবু মুদিওয়ালাকে তুল-দাঁড়ি ধরতে দেখলে একটু ভরসা হয় যে, চোখের সামনে অতটা ঠকাতে তার বাধবে ; কিন্তু তার পাঁচসিকে মাইনের নোংরা চাকরগুলো যখন দাঁড়ি-পাল্লার মালিক হয়ে বসে, তখন আর কোনো আশা থাকে না। আগেই বলেছি, আমরা দরিদ্র খরিদ্দার। থাকত বড়ো বড়ো মিঞাদের মতো সহায়-সম্বল, তাহলে এ অভিযোগ করতাম না।
পায়া-ভারি লোকের ভারি সুবিধে। তা সে পায়া-ভারি পায়ে ফাইলেরিয়া গোদ হয়েই হোক, বা ভারগুণেই হোক। এঁদের তুলতে হয় কাঁধে করে, আর কাছে যেতে হয় মাথাটা ভুঁই-সমান নীচু করে। ব্যবসা যারা বোঝে, তারা অন্য দোকানির বড়ো খদ্দেরকে হিংসা ও তদ্জনিত ঘৃণা যতই করুক, তাঁকে নিজের দোকানে ভিড়াতে তার দোকানের সবটুকু তেল তাঁর ভারী পায়ে খরচ করতে তার এতটুকু বাধে না। দরকার হলে তার পুত্র ছোটে তেলের টিন ঘাড়ে করে, সাঁতরে পার হয় রূপনারায়ণ নদ, তাঁর ভারী পায়ে ঢালে তেল, – তা সে পা যতই কেন ঘানি-গাছের মতো অবিচলিত থাক। সাথে সে ভাড়াটে ভাঁড় ও স্তুতি-গাইয়ে নিয়ে যেতেও ভোলে না।
যাক এখন এসব বাজে কথা। অনেক কথার উত্তর দিতে হবে।
আমি আপনার মতো অসংকোচে ‘তুমি’ বলতে পারলাম না বলে ক্ষুণ্ণ হবেন না যেন। আমি একে পাড়াগেঁয়ে স্কুল-পালানো ছেলে, তার উপর পেটে ডুবুরি নামিয়ে দিলেও ‘ক’ অক্ষর খুঁজে পাওয়া যায় না। (পেটে বোমা মারার উপমাটা দিলাম না স্পেশাল ট্রিবিউনালের ভয়ে)। যদি বা ‘খাজা’ বা ইব্রাহিম খানকে ‘তুমি’ বলতে পারতাম, কিন্তু কলেজের প্রিন্সিপাল সাহেবের নাম শুনেই আমার হাত-পা একেবারে পেটের ভেতর সেঁদিয়ে গেছে। আরে বাপ! স্কুলের হেডমাস্টারের চেহারা মনে করতেই আমার আজও জলতেষ্টা পেয়ে যায়, আর কলেজের প্রিন্সিপাল, সে না জানি আরও কত ভীষণ! আমার স্কুল-জীবনে আমি কখনও ক্লাসে বসে পড়েছি, এত বড়ো অপবাদ আমার চেয়ে এক নম্বর কম পেয়ে যে ‘লাস্ট বয়’ হয়ে যেত – সেও দিতে পারবে না। হাইবেঞ্চের উচ্চাসন হতে আমার চরণ কোনোদিনই টলেনি, ওর সাথে আমার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হয়ে গেছিল। তাই হয়তো আজও বক্তৃতামঞ্চে দাঁড় করিয়ে দিলে মনে হয়, মাস্টারমশাই হাইবেঞ্চে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। যার রক্তে রক্তে এত শিক্ষক-ভীতি, তাকে আপনি সাধ্যসাধনা করেও ‘তুমি’ বলাতে পারবেন না, এ স্থির নিশ্চিত।
এইবার পালা শুরু।
বাংলার মুসলমান সমাজ ধনে কাঙাল কি না জানিনে, কিন্তু মনে যে কাঙাল এবং অতি মাত্রায় কাঙাল, তা আমি বেদনার সঙ্গে অনুভব করে আসছি বহুদিন হতে। আমায় মুসলমান সমাজ ‘কাফের’ খেতাবের যে শিরোপা দিয়েছে, তা আমি মাথা পেতে গ্রহণ করেছি। একে আমি অবিচার বলে কোনোদিন অভিযোগ করেছি বলে তো মনে পড়ে না। তবে আমার লজ্জা হয়েছে এই ভেবে, কাফের-আখ্যায় বিভূষিত হওয়ার মতো বড়ো তো আমি হইনি। অথচ হাফেজ-খৈয়াম-মনসুর প্রভৃতি মহাপুরুষদের সাথে কাফেরের পঙ্ক্তিতে উঠে গেলাম।
হিন্দু লেখক-অলেখক জনসাধারণ মিলে যে স্নেহে যে নিবিড় প্রীতি-ভালোবাসা দিয়ে আমায় এত বড়ো করে তুলেছেন, তাঁদের সে ঋণকে অস্বীকার যদি আজ করি, তাহলে আমার শরীরে মানুষের রক্ত আছে বলে কেউ বিশ্বাস করবে না। অবশ্য কয়েকজন নোংরা হিন্দু ও ব্রাহ্ম লেখক ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে আমায় কিছুদিন হতে ইতর ভাষায় গালাগালি করছেন এবং কয়েকজন গোঁড়া ‘হিন্দু-সভাওয়ালা’ আমার নামে মিথ্যা কুৎসা রটনাও করে বেড়াচ্ছেন, কিন্তু এঁদের আঙুল দিয়ে গোনা যায়। এঁদের আক্রোশ সম্পূর্ণ সম্প্রদায় বা ব্যক্তিগত। এঁদের অবিচারের জন্য সমস্ত হিন্দুসমাজকে দোষ দিই নাই এবং দেবও না। তাছাড়া আজকালকার সাম্প্রদায়িক মাতলামির দিনে আমি যে মুসলমান এইটেই হয়ে পড়েছে অনেক হিন্দুর কাছে অপরাধ, – আমি যত বেশি অসাম্প্রদায়িক হই না কেন।
প্রথম গালাগালির ঝড়টা আমার ঘরের দিক অর্থাৎ মুসলমানের দিক থেকে এসেছিল – এটা অস্বীকার করিনে ; কিন্তু তাই বলে মুসলমানেরা যে আমায় কদর করেননি, এটাও ঠিক নয়। যাঁরা দেশের সত্যিকার প্রাণ, সেই তরুণ মুসলিম বন্ধুরা আমায় যে ভালোবাসা, যে প্রীতি দিয়ে অভিনন্দিত করেছেন, তাতে নিন্দার কাঁটা বহু নীচে ঢাকা পড়ে গেছে। প্রবীণদের আশীর্বাদ – মাথার মণি হয়তো পাইনি, কিন্তু তরুণদের ভালোবাসা, বুকের মালা আমি পেয়েছি। আমার ক্ষতির খেতে ফুলের ফসল ফলেছে।
এই তরুণদেরই নেতা ইব্রাহিম খাঁ, কাজি আবদুল ওদুদ,৩ আবুল কালাম শামসুদ্দীন৪, আবদুল মনসুর৫, ওয়াজেদ আলি৬, আবুল হোসেন৭। আর এই বন্ধুরাই তো আমায় বড়ো করেছেন, এই তরুণদের বুকে আমার জন্য আসন পেতে দিয়েছেন – প্রীতির আসন! ঢাকা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালি, ফরিদপুরে যারা তাদের গলার মালা দিয়ে আমায় বরণ করল, তারা এই তরুণদেরই দল। অবশ্য এই তরুণের জাত ছিল না। এরা ছিল সকল জাতির।
সকলকে জাগাবার কাজে আমায় আহ্বান করেছেন। আমার মনে হয়, আপনাদের আহ্বানের আগেই আমার ক্ষুদ্র শক্তির সবটুকু দিয়ে এদের জাগাতে চেষ্টা করেছি – সে শুধু লিখে তা নয়, – আমার জীবনী ও কর্মশক্তি দিয়েও।