বাকি উৎসবের জন্য যত শিগগির পারি বন্দোবস্ত করব। বাড়ির সকলকে দস্তুর মতো সালাম-দোওয়া জানাবেন। অন্যান্য যাদের কথা রাখতে পারিনি, তাদের ক্ষমা করতে বলবেন। তাকেও ক্ষমা করতে বলবেন, যদি এ ক্ষমা চাওয়া ধৃষ্টতা না হয়! আরজ – ইতি
চিরসত্য স্নেহসিক্ত –
নুরু
ইব্রাহিম খাঁ-কে
শ্রদ্ধেয় প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খান সাহেব!
আমাদের আশি বছরে নাকি স্রষ্টা ব্রহ্মার একদিন। আমি অত বড়ো স্রষ্টা না হলেও স্রষ্টা তো বটে, তা আমার সে-সৃষ্টির পরিসর যত ক্ষুদ্র পরিধিই হোক, কাজেই আমারও একটা দিন অন্তত তিনটে বছরের কম যে নয়, তা অন্য কেউ বিশ্বাস করুক চাই না করুক, আপনি নিশ্চয়ই করবেন।
আপনার ১৯২৫ সালের লেখা চিঠির উত্তর দিচ্ছি ১৯২৭ সালের আয়ু যখন ফুরিয়ে এসেছে তখন।১ এমনও হতে পারে ১৯২৭-এর সাথে সাথে হয়তো বা আমারও আয়ু ফুরিয়ে এসেছে, তাই আমিও আমার অজ্ঞাতে কোনো অনির্দেশের ইঙ্গিতে আমার শেষ বলা বলে যাচ্ছি আপনার চিঠির উত্তর দেওয়ার সুযোগে২। কেননা, আমি এই তিন বছরের মধ্যে কারুর চিঠির উত্তর দিয়েছি, এত বড়ো বদনাম আমার শত্রুতেও দিতে পারবে না – বন্ধুরা তো নয়ই। অবশ্য আয়ু আমার ফুরিয়ে এসেছে – এ সুসংবাদটা উপভোগ করবার মতো সৎসাহস আমার নেই, বিশ্বাসও হয়তো করিনে ; কিন্তু আমার স্বজাতি অর্থাৎ বিজাতীয় অনেকেই এ বিশ্বাস করেন এবং আমিও যাতে বিশ্বাস করি তার জন্যে অর্থ ও সামর্থ্য ব্যয় যথেষ্ট পরিমাণেই করছেন। কিন্তু আমার শরীরের দিকে তাকিয়ে তাঁরা যে নিশ্বাস মোচন করেন, তা হ্রস্ব নয় এবং সে নিশ্বাস বিশ্বাসীরও নয়! হতভাগা আমি, তাঁদের এই আমার প্রতি অতি মনোযোগ নাকি প্রসন্নচিত্তে গ্রহণ করতে পারিনে – মন্দ লোকে এমন অভিযোগও করেছে তাঁদের দরবারে।
লোকে বললেও আমি মনে করতে ব্যথা পাই যে, তাঁরা আমার শত্রু। কারণ একদিন তাঁরাই আমার শ্রেষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। আজ যদি তাঁরা সত্যি সত্যিই আমার মৃত্যু কামনা করেন, তবে তা আমার মঙ্গলের জন্যই, এ আমি আমার সকল হৃদয় দিয়ে বিশ্বাস করি। আমি আজও মানুষের প্রতি আস্থা হারাইনি – তাদের হাতের আঘাত যত বড়ো এবং যত বেশিই পাই। মানুষের মুখ উল্টে গেলে ভূত হয়, বা ভূত হলে তার মুখ উল্টে যায়, কিন্তু মানুষের হৃদয় উল্টে গেলে সে যে ভূতের চেয়েও কত ভীষণ ও প্রতিহিংসাপরায়ণ হিংস্র হয়ে ওঠে – তাও আমি ভালো করেই জানি। তবু আমি মানুষকে শ্রদ্ধা করি – ভালোবাসি। স্রষ্টাকে আমি দেখিনি, কিন্তু মানুষকে দেখেছি। এই ধূলিমাখা পাপলিপ্ত অসহায় দুঃখী মানুষই একদিন বিশ্ব নিয়ন্ত্রিত করবে, চিররহস্যের অবগুণ্ঠন মোচন করবে, এই ধুলোর নীচে স্বর্গ টেনে আনবে, এ আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি। সকল ব্যথিতের ব্যথায়, সকল অসহায়ের অশ্রুজলে আমি আমাকে অনুভব করি, এ আমি একটুও বাড়িয়ে বলছিনে, এই ব্যথিতের অশ্রুজলের মুকুরে যেন আমি আমার প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই। কিছু করতে যদি নাই পারি, ওদের সাথে প্রাণ ভরে যেন কাঁদতে পাই!
কিন্তু এ তো আপনার চিঠির উত্তর হচ্ছে না। দেখুন, চিঠি না লিখতে লিখতে চিঠি লেখার কায়দাটা গেছি ভুলে। তাতে করে কিন্তু লাভ হয়েছে অনেক। যদিও চোখ-কান বুঁজে উত্তর দিয়ে ফেলি কারুর চিঠির, সে উত্তর পড়ে তাঁর প্রত্যুত্তর দেওয়ার মতো উৎসাহ বা প্রবৃত্তির ইতি ওইখানেই হয়ে যায়। কেননা, সেটা তাঁর চিঠির উত্তর ছাড়া আর সব কিছুই হয়। এ-বিষয়ে ভুক্তভোগীর সাক্ষ্য নিতে পারেন। সুতরাং এটাও যদি আপনার চিঠির উত্তর না হয়ে আর কিছুই হয়, তবে সেটা আপনার অদৃষ্টের দোষ নয়, আমার হাতের অখ্যাতি।
আমাদের দেখার না হলেও শোনার ত্রুটি কোনো পক্ষ থেকেই ঘটেনি দেখছি। আপনাকে চিনি, আপনি আমায় যতটুকু চেনেন তার চেয়েও বেশি করে ; কিন্তু জানতে যে আজও পারলাম না, তার জন্য অভিযোগ আমার অদৃষ্টকে ছাড়া আর কাকে করব বলুন। এতদিন ধরে বাংলার এত জায়গা ঘুরেও যখন আপনাকে দেখা হল না, তখন আর যে হবে সে আশা রাখিনে। বিশেষ করে – আজ ক্রমেই নিজেকে জানাশোনার আড়ালে টেনে নিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু এ ভালোই হয়েছে – অন্তত আপনার দিক থেকে। আমার দিকের ক্ষতিটাকে আমি সইতে পারব এই আনন্দে যে, আপনার এত শ্রদ্ধা অপাত্রে অর্পিত হয়েছে বলে দুঃখ করবার সুযোগ আপনাকে দিলাম না। এ আমার বিনয় নয় ; আমি নিজে অনুভব করেছি যে, আমায় শুনে যাঁরা শ্রদ্ধা করেছেন, দেখে তাঁরা তাঁদের সে শ্রদ্ধা নিয়ে বিব্রত হয়ে পড়েছেন। তাই আমি অন্তরে অন্তরে প্রার্থনা করছি, কাছে থেকে যাদের কেবল ব্যথাই দিলাম, দূরে গিয়ে অন্তত তাঁদের সে দুঃখ ভুলবার অবসর না দিই, তবে মানুষের প্রতি আমার ভালোবাসা সত্য নয়।
তা ছাড়া নৈকট্যের একটা নিষ্ঠুরতা আছে। চাঁদের জ্যোৎস্নায় কলঙ্ক নেই, কিন্তু চাঁদে কলঙ্ক আছে। দূরে থেকে চাঁদ চক্ষু জুড়ায়, কিন্তু মৃত চন্দ্রলোকে গিয়ে খুশি হয়ে উঠবেন বলে মনে হয় না। বাতায়ন দিয়ে যে-সূর্যালোক ঘরে আসে তা আলো দেয়, চোখে দেখার সূর্য দগ্ধ করে। চন্দ্র-সূর্যকে আমি নমস্কার করি, কিন্তু তাঁদের পৃথিবী-দর্শনের কথা শুনলে আতঙ্কিত হয়ে উঠি। ভালোই হয়েছে ভাই, কাছে গেলে হয়তো আমার কলঙ্কটাই বড়ো হয়ে দেখা দিত।
তারপর শ্রদ্ধার কথা। ওদিক দিয়ে আপনার জিতে যাওয়ার কোনো আশা নেই, বন্ধু। শ্রদ্ধা যদি ওজন করা যেত, তাহলে আমাদের দেশের একজন সম্পাদক – যিনি মানুষের দোষগুণ বানিয়ার মতো করে কড়ায়-গন্ডায় ওজন করতে সিদ্ধহস্ত, তাঁর কাছে গিয়েই এর চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়ে যেত! গ্রহের ফেরে তাঁর কাঁচিপাকি ওজনের ফের আমার পক্ষে কোনোদিনই অনুকূল নয় ; তা সত্ত্বেও আপনিই হারতেন, এ আমি জোর করে বলতে পারি।