কেহ চাহিয়াছে তখ্ত-ই-তাউস, কোহিনুর কেহ — এসেছে কেউ
খেলিতে সেরেফ খুশরোজ হেথা, বন্যার সম এনেছে ঢেউ।
‘খঞ্জর’ এরা এনেছে সবাই, তুমি আনিয়াছ ‘হেলাল’ আজ,
তোমারে আড়াল করেনি তোমার তরবারি আর তখ্ত তাজ।
তুমি আসনিকো দেখাতে তোমায়, দেখিতে এসেছ সকলেরে!
চলেছ, পুণ্য সঞ্চয় লাগি বিপুল বিশ্ব কাবা হেরে।
হে মহাতীর্থ-যাত্রা-পথিক! চির-রহস্য-ধেয়ানি গো!
ওগো কবি! তুমি দেখছ সে কোন অজানা লোকের মায়া-মৃগ?
কখন কাহার সোনার নূপুর দেখিল স্বপনে, জাগিয়া তায়
ধরিতে চলেছ সপ্ত সাগর তেরো নদী আজ পারায়ে, হায়!
তখ্ত তোমর রহিল পড়িয়া, বাসি লাগে নও-বাদশাহি,
মুসাফির সেজে চলেছ শা-জাদা না-জানা অকূলে তরি বাহি।
সুলেমান-গিরি হিন্দুকুশের প্রাচীর লঙ্ঘি ভাঙি কারা,
আদি সন্ধানী যুবা আফগান, চলেছে ছুটিয়া দিশাহারা!
সুলেমান সম উড়ন-তখ্তে চলিলে করিতে দিগ্বিজয়,
কাবুলের রাজা, ছড়ায়ে পড়িলে সারা বিশ্বের হৃদয়-ময়!
শমশের হতে কমজোর নয় শিরীন-জবান, জান তুমি,
হাসি দিয়ে তাই করিতেছ জয় অসির অজেয় রণ-ভূমি!
শুধু বাদশাহি দম্ভ লইয়া আসিতে যদি, এ বন্দী দেশ
ফুলমালা দিয়া না করি বরণকরিত মামুলি আর্জি পেশ।
খোশামোদ শুধু করিতে হইত, বলিত না তার ‘খোশ-আমদেদ’,
ভাবিত ভারত ‘কাবুলি’তে আর কাবুলি-রাজায় নাহিকো ভেদ।
‘আমানুল্লা’রে করি বন্দনা, কাবুল রাজার গাহি না গান,
মোরা জানি ওই রাজার আসন মানব জাতির অসম্মান!
ওই বাদশাহি তখ্তের নীচে দীন-ই-ইসলাম শরমে, হায়,
এজিদ হইতে শুরু করে আজও কাঁদে আর শুধু মুখ লুকায়!
বুকের খুশির বাদশাহ তুমি, – শ্রদ্ধা তোমার সিংহাসন,
রাজাসন ছাড়ি মাটিতে নামিতে দ্বিধা নাই – তাই করি বরণ।
তোমার রাজ্যে হিন্দুরা আজও বেরাদর-ই-হিন্দ, নয় কাফের,
প্রতিমা তাদের ভাঙোনি, ভাঙোনি একখানি ইঁট মন্দিরের।
‘কাবুলি’রে মোরা দেখিয়াছি শুধু, দেখিনি কাবুল পামির-চূড়,
দেখেছি কঠিন গিরি মরুভূমি – পিই নাই পানি সেই মরুভূর!
আজ দেখি সেথা শত গুলিস্তাঁ-বোস্তাঁ-চমক কান্দাহার-
গজনি-হিরাট-পঘমান কত জালালাবাদের ফুল-বাহার!
ওই খায়বার-পাশ দিয়া শুধু আসেনি নাদির আবদালি,
আসে ওই পথে নারঙ্গি সেব আপেল আনার ডালি ডালি।
আসে আঙ্গুর পেস্তা বাদাম খোর্মা খেজুর মিঠি মেওয়া,
অঢেল শিরনি দিয়াছে কাবুল, জানে নাকো শুধু সুদ নেওয়া!
কাবুল নদীর তীরে তীরে ফেরে জাফরান-খেতে পিয়ে মধু
আমাদেরই মতো মউ-বিলাসী গো কত প্রজাপতি কত বঁধু।
সেথায় উছসে তরুণীর শ্বাসে মেশ্ক -সুবাস, অধরে মদ।…
গাহে বুলবুলি নার্গিস লালা আনার-কলির পিয়ে শহদ।…
দেখিয়াছি শুধু কাবুলির দেনা, কাবুলি দাওয়াই, কাবুলি হিং, –
তুমি দিয়ে গেছ কাবুল-বাগের দিল-মহলের চাবির রিং!
আমি গাই তারই গান
আমি গাই তারই গান –
দৃপ্ত-দম্ভে যে-যৌবন আজ ধরি অসি খরশান
হইল বাহির অসম্ভবের অভিযানে দিকে দিকে।
লক্ষ যুগের প্রাচীন মমির পিরামিডে গেল লিখে
তাদের ভাঙার ইতিহাস-লেখা। যাহাদের নিশ্বাসে
জীর্ণ পুথির শুষ্ক পত্র উড়ে গেল এক পাশে।
যারা ভেঙে চলে অপদেবতার মন্দির আস্তানা,
বকধার্মিক-নীতিবৃদ্ধের সনাতন তাড়িখানা।
যাহাদের প্রাণ-স্রোতে ভেসে গেল পুরাতন জঞ্জাল,
সংস্কারের জগদল-শিলা, শাস্ত্রের কঙ্কাল।
মিথ্যা মোহের পূজা-মণ্ডপে যাহারা অকুতোভয়ে
এল নির্মম–মোহমুদ্গর ভাঙনের গদা লয়ে।
বিধি-নিষেধের চিনের প্রাচীরে অসীম দুঃসাহসে
দু-হাতে চালাল হাতুড়ি শাবল। গোরস্থানেরে চষে
ছুঁড়ে ফেলে যত শব-কঙ্কাল বসাল ফুলের মেলা,
যাহাদের ভিড়ে মুখর আজিকে জীবনের বালু-বেলা।
–গাহি তাহাদেরই গান
বিশ্বের সাথে জীবনের পথে যারা আজি আগুয়ান!…
–সেদিন নিশীথ-বেলা
দুস্তর পারাবারে যে যাত্রী একাকী ভাসাল ভেলা,
প্রভাতে সে আর ফিরিল না কুলে। সেই দুরন্ত লাগি
আঁখি মুছি আর রচি গান আমি আজিও নিশীথে জাগি।
আজও বিনিদ্র গাহি গান আমি চেয়ে তারই পথ-পানে।
ফিরিল না প্রাতে যে-জন সে-রাতে উড়িল আকাশ-যানে
নব জগতের দূরসন্ধানী অসীমের পথচারী,
যার ভয়ে জাগে সদাসতর্ক মৃত্যু-দুয়ারে দ্বারী !
সাগরগর্ভে, নিঃসীম নভে, দিগ্দিগন্ত জুড়ে
জীবনোদ্বেগে তাড়া করে ফেরে নিতি যারা মৃত্যুরে,
মানিক আহরি আনে যারা খুঁড়ি পাতাল-যক্ষপুরী,
নাগিনির বিষ-জ্বালা সয়ে করে ফণা হতে মণি চুরি।
হানিয়া বজ্রপাণির বজ্র উদ্ধত শিরে ধরি
যাহারা চপলা মেঘ-কন্যারে করিয়াছে কিংকরী।
পবন যাদের ব্যজনী দুলায় হইয়া আজ্ঞাবাহী, –
এসেছি তাদের জানাতে প্রণাম, তাহাদের গান গাহি।
গুঞ্জরি ফেরে ক্রন্দন মোর তাদের নিখিল ব্যেপে –
ফাঁসির রজ্জু ক্লান্ত আজিকে যাহাদের টুঁটি চেপে !
যাহাদের কারাবাসে
অতীত রাতের বন্দিনি উষা ঘুম টুটি ওই হাসে।
আলি আকবর খান-কে
কান্দিরপাড়,
কুমিল্লা
23 July, 1921
(বিকেল বেলা)
বাবা শ্বশুর!
আপনাদের এই অসুর জামাই পশুর মতন ব্যবহার করে এসে যা কিছু কসুর করেছে, তা ক্ষমা কোরো সকলে, অবশ্য যদি আমার ক্ষমা চাওয়ার অধিকার থাকে। এইটুকু মনে রাখবেন, আমার অন্তর-দেবতা নেহায়েত অসহ্য না হয়ে পড়লে আমি কখনো কাউকে ব্যথা দিই না। যদিও ঘা খেয়ে খেয়ে আমার হৃদয়টাতে ঘা-টা বুঁজে গেছে, তবু সেটার অন্তরতম প্রদেশটা এখনও শিরীষ ফুলের পরাগের মতোই কোমল আছে সেখানে খোঁচা লাগলে আর আমি থাকতে পারিনে। তা ছাড়া, আমিও আপনাদেরই পাঁচজনের মতন মানুষ, আমার গণ্ডারের চামড়া নয়, কেবল সহ্যগুণটা কিছু বেশি। আমার মান-অপমান সম্বন্ধে কাণ্ডজ্ঞান ছিল না বা ‘কেয়ার’ করিনি বলে আমি কখনও এতবড়ো অপমান সহ্য করিনি। যাতে আমার ‘ম্যানলিনেসে’ বা পৌরুষে গিয়ে বাজে – যাতে আমাকে কেউ কাপুরুষ হীন ভাবতে পারে। আমি সাধ করে পথের ভিখারি সেজেছি বলে লোকের পদাঘাত সইবার মতন ‘ক্ষুদ্র-আত্মা’ অমানুষ হয়ে যাইনি। আপনজনের কাছ হতে পাওয়া অপ্রত্যাশিত এত হীন ঘৃণা, অবহেলা আমার বুক ভেঙে দিয়েছে। বাবা! আমি মানুষের উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছি। দোওয়া করবেন, আমার এ ভুল যেন দুদিনেই ভেঙে যায় – এ অভিমান যেন চোখের জলে ভেসে যায়!