চিঠি লিখছি আর গাচ্ছি একটা নতুন লেখা গানের দুটো চরণ:
হে ক্ষণিকের অতিথি, এলে প্রভাতে কারে চাহিয়া
ঝরা শেফালির পথ বাহিয়া।
কোন অমরার বিরহিনীরে চাহনি ফিরে,
কার বিষাদের শিশির নীরে এলে নাহিয়া।
কবির আসা ওই শেফালির পথ বেয়ে আসা। কার বিষাদের শিশির-জলে নেয়ে আসে তা সে জানে না। তার নিজের কাছেই সে একটা বিপুল রহস্য।
আমার লেখা কবিতাগুলো চেয়েছ। হাসি পাচ্ছে খুব কিন্তু। কী ছেলেমানুষ তোমরা দুটি ভাই বোন। যে-খন্তা দিয়ে মাটি খোঁড়ে মালি, সেটারও যে দরকার পড়ে ফুলবিলাসীর, এ আমার জানা ছিল না। যে পাতার কোলে ফুল ফোটে, সে-পাতা কেউ চায় না, এই আমি জানতাম। মালা গাঁথা হওয়ার পর ফুল-রাখা পদ্ম-পাতাটার কোনো দরকার থাকে, এও একটা খুব মজার কথা, না? যাক, চেয়েছ –দেব। তবে এ পল্লব শুকিয়ে উঠবে দুদিন পরে, থাকবে যা তা ফুলের গন্ধ। তাছাড়া অত কবিতাই বা লিখব কোত্থেকে যে খাতা ভরতি করে দেব। বসন্ত তো সবসময় আসে না। শাখার রিক্ততাকে যে ধিক্কার দেয়, সে অসহিষ্ণু; ফুল ফোটার জন্যে অপেক্ষা করতে জানে যে, সে-ই ফুল পায়। যে অসহিষ্ণু চলে যায়, সে তো পায় না ফুল,তার ডাল চিরশূন্য রয়ে যায়। তোমাদের ছায়া-ঢাকা, পাখি-ডাকা দেশ, তোমাদের সিন্ধু পর্বত গিরিদরী-বন আমায় গান গাইয়েছিল। তোমাদের শোনার আকাঙ্ক্ষা আমায় গান গাইয়েছিল। রূপের দেশ ছাড়িয়ে এসেছি এখন রুপেয়ার দেশে, এখানে কি গান জাগে? বীণাপাণির রূপের কমল এখানকার বাস্তবতার কঠোর ছোঁয়ায় রুপার কমল হয়ে উঠেছে। কমলবনের বীণাপাণি ঢুকেছেন এখানের মাড়োয়ারি মহলে। ছাড়া যেদিন পাবেন, আসবেন তিনি আমার হৃদকমলে। সেদিনের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া উপায নেই আমার।
আমার কবিতার উৎস-মুখের সন্ধান চেয়ে। তার সন্ধান যতটুকু জানি নিজে, দেখিয়ে দেব।
আর কিছু লিখবার অবসর নেই আজ। মানস-কমলের গন্ধ পাচ্ছি যেন, কেমন যেন নেশা ধরছে; বোধ হয় বীণাপাণি তার চরণ রেখেছেন এসে আমার অন্তর শতদলে। এখন চললাম ভাই। চিঠি দিয়ো শিগগির। আমার আশিস নাও। ইতি-
তোমার
‘নুরুদা’
পুঃ—
তোমাদের অনেক কষ্ট দিয়ে এসেছি, সে সব ভুলে যেয়ো। তোমার আম্মা ও নানি সাহেবার পাক কদমানে হাজার হাজার আদাব জানাবে আমার। শামসুদ্দিন৫ ও অন্যান্য ছেলেদেরে স্নেহাশিস জানাবে। তুমি কী বই পড়লে এর মধ্যে বা পড়ছ, কী কী লিখলে, সব জানাবে। তোমার লেখাগুলো আমায় আজই পাঠিয়ে দেবে। চিঠি দিতে দেরি কোরো না। ‘কালি কলম’পেয়েছ বোধ হয়। তোমায় পাঠানো হয়েছে। তোমার লেখা চায় তারা।
‘নুরুদা’
» শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়-কে
কৃষ্ণনগর
১০-৪-১৯২৬
প্রিয় শৈলজা!
কনফারেন্সের হিড়িকে মরবার অবসর নেই। কনফারেন্সের আর মাত্র একমাস বাকি। হেমন্তদা আর আমি সব করছি এ যজ্ঞের। কাজেই লেখাটা শেষ করতে পারিনি এতদিন। রেগো না লক্ষ্মীটি। আমি তোমাদের লেখা না দিতে পেরে বড়ো লজ্জিত আছি। ‘মাধবী-প্রলাপ’পাঠালুম। বৈশাখেই দিয়ো। দরকার হলে অদল-বদল করে নিয়ো কথা– অবশ্য ছন্দ রক্ষা করে। আমি এবার কলকাতায় গিয়েছিলুম – আল্লা… আর ভগবান…এর মারামারির দরুন তোমাদের কাছে যেতে পারিনি। আমি ২/৩ দিন পরে শ্রীহট্ট যুবক সম্মিলনীতে যোগদান করতে যাচ্ছি। ওখান থেকে ফিরে তোমার সঙ্গে দেখা করব।
আজ ডাকের সময় যায়, বেশি লিখবে না।… মুরলিদা ও প্রেমেনকে ভালোবাসা দিয়ো। তোমরাও নিয়ো।
– নজরুল
সম্পাদক, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা-কে
From:
QAZI NAZRUL ISLAM
Battalion Quartermaster Havilder
49th Bengalis,
Dated, Cantonment, Karachi,
The 19th August, 1919
আদাব হাজার হাজার জানবেন!
বাদ আরজ, আমার নগণ্য লেখাটি আপনাদের সাহিত্য-পত্রিকায় স্থান পেয়েছে, এতে কৃতজ্ঞ হওয়ার চেয়ে আমি আশ্চর্য হয়েছি বেশি। আমার সবচেয়ে বেশি ভয় হয়েছিল, পাছে বেচারি লেখা ‘কোরকে’র কোঠায় পড়ে। অবশ্য যদিও আমি ‘কোরক’ব্যতীত প্রস্ফুটিত ফুল নই; আর যদিই সেরকম হয়ে থাকি কারুর চক্ষে, তবে সে বেমালুম ধুতরো ফুল। যা হোক, আমি তার জন্যে আপনার নিকট যে কত বেশি কৃতজ্ঞ, তা প্রকাশ করবার ভাষা পাচ্ছিনে। আপনার এরূপ উৎসাহ বরাবর থাকলে আমি যে একটি মস্ত জবর কবি ও লেখক হব, তা হাতে-কলমে প্রমাণ করে দিব, এ একেবারে নির্ঘাত সত্যি কথা। কারণ, এবার পাঠালুম একটি লম্বা চওড়া ‘গাথা’ আর একটি ‘প্রায় দীর্ঘ’ গল্প আপনাদের পরবর্তী সংখ্যা কাগজে ছাপাবার জন্যে, যদিও কার্তিক মাস এখনও অনেক দূরে। আগে থেকেই পাঠালুম, কেননা এখন হতে এটা ভালো করে পড়ে রাখবেন এবং চাই কি আগে হতে ছাপিয়েও রাখতে পারেন। তাছাড়া আর একটি কথা। শেষে হয়তো ভালো ভালো লেখা জমে আমার লেখাকে বিলকুল ‘রদ্দি’ করে দেবে, আর তখন হয়তো এত বেশি লেখা না পড়তেও পারেন। কারণ, আমি বিশেষরূপে জানি, সম্পাদক বেচারাদের গলদঘর্ম হয়ে উঠতে হয় এই নতুন কাব্যি-রোগাক্রান্ত ছোকরাদের দৌরাত্ম্যিতে। যাক, অনেক বাজে কথা বলা গেল। আপনার সময়টাকেও খামকা টুঁটি চেপে রেখেছিলুম। এখন বাকি কথা কটি মেহেরবানি করে শুনুন।
যদি কোনো লেখা পছন্দ না হয়, তবে ছিঁড়ে না ফেলে গরিবকে জানালেই আমি ওর নিরাপদে প্রত্যাগমনের পাথেয় পাঠিয়ে দেব। কারণ সৈনিকের বড্ড কষ্টের জীবন। আর তার চেয়ে হাজার গুণ পরিশ্রম করে একটু আধটু লেখি। আর কারুর কাছে এ একেবারে worthless হলেও আমার নিজের কাছে ওর দাম ভয়ানক! আর ওটা বোধ হয় সব লেখকের পক্ষেই স্বাভাবিক। আপনার পছন্দ হল কিনা, জানাবার জন্যে আমার নাম ঠিকানা লেখা একখানা Stamped খামও দেওয়া গেল এর সঙ্গে। পড়ে মত জানাবেন।