মানুষের সঙ্গে প্রাণ খুলে কথা বলতে বলতেও অন্যমনস্ক হয়ে পড়ি খেই হারিয়ে ফেলি কথার। আমরা গোপনতম কে যেন একেবারে নিশ্চুপ হয়ে থাকতে আদেশ করে। আর আর্থিক অসচ্ছলতার কথা লিখেছে। অর্থ দিয়ে মাড়োয়ারিকে, জমিদার মহাজনকে বা ভিখিরিকে হয়তো খুশি করা যায়, কবিকে খুশি করা যায় না। রবীন্দ্রনাথের ‘পুরস্কার’৩ কবিতাটি পড়েছ? ওতে এই কথাই আছে।– কবি রাজ-দরবারে গিয়ে রাজাকে মুগ্ধ করে রাজপ্রদত্ত মণি-মাণিক্যের বদলে চাইলে রাজার গলার মালাখানি। কবি লক্ষ্মীর প্যাঁচার আরাধনা কোনো কালে করেনি, সরস্বতীর শতদলেরই আরাধনা করেছে– তাঁর পদ্মগন্ধে বিভোর হয়ে শুধু গুন গুন করে গান করেছে আর গান করেছে। লক্ষ্মীর ঝাঁপির কড়ি দিয়ে। কবিকে অভিবন্দনা করলে কবি তাতে অখুশি হয়ে ওঠে। কবিকে খুশি করতে হলে দিতে হয় অমূল্য ফুলের সওগাত। সে সওগাত তোমরা দিয়েছ আমায় অজ্ঞলি পূরে। কবি চায় না দান, কবি চায় অজ্ঞলি, কবি চায় প্রীতি, কবি চায় পূজা। কবিত্ব আর দেবত্ব এইখানে এক। কবিতা আর দেবতা-সুন্দরের প্রকাশ। সুন্দরকে স্বীকার করতে হয় সুন্দর যা তাই দিয়ে। রুপার দাম আছে বলে রুপা অত হীন; হাটে বাজারে মুদির কাছে, বেনের কাছে ওজন হতে হতে ওর প্রাণান্ত ঘটল; রূপার দাম নেই বলেই রূপ এত দুর্মূল্য, রূপ এত সুন্দর, এত পূজার! রুপা কিনতে হয় রুপেয়া দিয়ে, রূপ কিনতে হয় হৃদয় দিয়ে। রূপের হাটের বেচা-কেনা অদ্ভুত। যে যত অমনই – যে যত বিনাদামে কিনে নিতে পারে, সে তত বড়ো রূপ-রসিক সেখানে। কবিকে সম্মান দিতে পারনি বলে মনে যদি করেই থাক, তবে তা মুছে ফেল। কোকিল পাপিয়াকে বাড়িতে ডেকে ঘটা করে খাওয়াতে পারনি বলে তারা তো অনুযোগ করেনি কোনোদিন। সে-কথা ভাবেওনি কোনোদিন তারা। তারা তাই বলে তোমার বাতায়নের পাশে গান গাওয়া বন্ধ করেনি। তাছাড়া কবিকে হয়তো সম্মান করা যায় না – কাব্যকে সম্মান করা যায়। তুমি হয়তো বলবে, গাছের যত্ন না নিলে ফুল দেয় না কিন্তু সে যত্নেরও ত্রুটি হচ্ছে না। অনাত্মীয়কে লোকে সংবর্ধনা করে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে; বন্ধুকে গ্রহণ করে হাসি দিয়ে, হৃদয় দিয়ে।
উপদেশ আমি তোমায় দিইনি। যদি দিয়ে থাকি, ভুলে যেয়ো। উপদেশ দেওয়ার চাণক্য আমি নই। দিয়েছি তোমার অনাগত বিপুল সম্ভবনাকে অঞ্জলি – তোমার মাঝের অপ্রকাশ সুন্দরকে প্রকাশ-আলোতে আসার আহ্বান জানিয়েছি শঙ্খধ্বনি করে। উপদেশের ঢিল ছুঁড়ে তোমার মনের বনের পাখিকে উড়িয়ে দেওয়ার নির্মমতা আমার নেই, এ তুমি ধ্রুব জেনো। আমি ফুল-ঝরা দিয়ে হাসাই, শাখার মার দিয়ে কাঁদাই নে।
তোমায় লিখতে বলেছি, আজও বলছি লিখতে। বললেই যে লেখা আসে, তা নয়। কারুর বলা যদি আনন্দ দেয়, তবে সেই আনন্দের বেগে সৃষ্টি হয়তো সম্ভব হয়ে ওঠে। তোমরা আমায় বলেছ লিখতে। সে-বলা আমায় আনন্দ দিয়েছে, তাই সৃষ্টির বেদনা জেগেছে অন্তরে। তোমাদের আলোর পরশে, শিশিরের ছোঁয়ায় আমার মনের কুঁড়ি বিকচ হয়ে উঠেছে। তাই চট্টগ্রামে লিখেছি। নইলে তোমরা বললেই লেখা আসত না। তোমার মনের সুন্দর যিনি, তিনি যদি খুশি হয়ে ওঠেন, তাহলে সেই খুশিই তোমায় লিখতে বসাবে। আমার বলা তোমার সেই মনের সুন্দরকে অজ্ঞলি দেওয়া। বলেছি, অজ্ঞলি দিয়েছি। তিনি খুশি হয়ে উঠেছেন কিনা তুমি জান। তুমি আজও অনেকখানি বালিকা। তারুণ্যের যে উচ্ছ্বাস, যে আনন্দ, যে ব্যথা সৃষ্টি জাগায়, সেই উচ্ছ্বাস, সেই আনন্দ, সেই ব্যথা তোমার জীবনে আসার এখনও অনেক দেরি। তাই সৃষ্টি তোমার আজও উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল না। তার জন্যে অপেক্ষা করবার ধৈর্য অর্জন করো। তরুর শাখায় আঘাত করলে সে ফুল দেবে না, যখন দেবে সে আপনি দেবে। আমাদের দেশের মেয়েরা বড়ো হতভাগিনী। কত মেয়েকে দেখলাম কত প্রতিভা নিয়ে জন্মাতে, কিন্তু সব সম্ভাবনা তাদের শুকিয়ে গেল সমাজের প্রয়োজনের দাবিতে। ঘরের প্রয়োজন তাদের বন্দিনি করে রেখেছে। এত বিপুল বাহির যাদের চায়, তাদের ঘিরে রেখেছে বারো হাত লম্বা আট হাত চওড়া দেয়াল। বাহিরের আঘাত এ দেয়ালে বারে বারে প্রতিহত হয়ে ফিরল। এর বুঝি ভাঙন নেই অন্তর হতে মার না খেলে। তাই নারীদের বিদ্রোহিনী হতে বলি। তারা ভেতর হতে দ্বার চেপে ধরে বলছে আমরা বন্দিনি। দ্বার খোলার দুঃসাহসিকা আজ কোথায়? তাকেই চাইছেন, যুগদেবতা। দ্বার ভাঙার পুরুষতার নারীদের প্রয়োজন নেই, কারণ তাদের দ্বার ভিতর হতে বন্ধ, বাহির হতে নয়। তোমারও যে কী হবে বলতে পারিনে। তার কারণ তোমায় চিনলেই তো চলবে না, তোমায় চালাবার দাবি নিয়ে জন্মেছেন যাঁরা তাঁদের আজও চিনিনি। আমার কেমন যেন মনে হল অভিভাবক নয়। ভুল যদি না করে থাকি, তাহলেই মঙ্গল। অভিভাবক যিনিই হন তোমার, তিনি যেন বিংশ শতাব্দীর আলোর ছোঁয়া পাননি বলেই মনে হল। তোমায় যে আজ কাঁদতে হয় বসে বসে কলেজে পড়তে যাওয়ার জন্য, এও হয়তো সেই কারণেই। মিসেস আর. এস. হোসেনের মতো অভিভাবিকা পাওয়া অতি বড়ো ভাগ্যের কথা। তাঁকেও যখন তাঁরা স্বীকার করে নিতে পারলেন না, তখন তোমার কী হবে পড়ার, তা আমি ভাবতে পারিনে! তোমার আর বাহারের উপর আমার দাবি আছে – স্নেহ করার দাবি, ভালোবাসার দাবি, কিন্তু তোমার অভিভাবকদের উপর তো আমার দাবি নেই। তবুও উপর-পড়া হয়ে অনেক বলেছি এবং তা হয়তো তোমার আম্মা ও নানি সাহেবাও শুনেছেন। বিরক্তও হয়েছেন হয়তো।