এত কথা বললাম কেন, জান? তোমাদের যে পেয়েছি এই আনন্দটাই আমায় এই কথা কওয়াচ্ছে, গান গাওয়াচ্ছে। বাইরের পাওয়া নয়, অন্তরের পাওয়া। গানের পাখি গান গায় খাবার পেয়ে নয়; ফুল পেয়ে, আলো পেয়ে সে গান গেয়ে ওঠে। মুকুল আশা কুসুম-ফোটা বসন্তই পাখিকে গান-গাওয়ায়, ফল-পাকা জ্যৈষ্ঠ আষাঢ় নয়। তখনও পাখি হয়তো গায়, কিন্তু ফুল যে ফুটতে দেখেছিল, গন্ধ সে তার পেয়েছিল-গায় সে সেই আনন্দে, ফলপাকার লোলুপতায় নয়। ফুল ফুটলে পায় গান, কিন্তু ফল পাকলে পায় খিদে; আমি পরিচয় করার অনন্ত ঔৎসুক্য নিয়ে বেড়াচ্ছি মানুষের মাঝে, কিন্তু ফুল ফোটা মন মেলে না ভাই, মেলে শুধু ফল-পাকার ক্ষুধাতুর মন। তোমাদের মধ্যে সেই ফুল-ফোটানো বসন্ত, গান-জাগানো আলো দেখেছি বলেই আমার এত আনন্দ, এত প্রকাশের ব্যাকুলতা। তোমাদের সাথে পরিচয় আমার কোনো প্রকার স্বার্থের নয়, কোনো দাবির নয়। ঢিল মেরে ফল পাড়ার অভ্যেস আমার ছেলেবেলায় ছিল, যখন ছিলাম ডাকাত, এখন আর নেই। ফুল যদি কোথাও ফোটে, আলো যদি কোথাও হাসে সেখানে আমায় গান গাওয়ায় পায়, গান গাই। সেই আলো, সেই ফুল পেয়েছিলাম এবার চট্টলায়, তাই গেয়েছি গান। ওর মাঝে শিশিরের করুণা যেটুকু, সেটুকু আমার আর কারুর নয়। যাক, কাজের কথাগুলো বলে নিই আগে।
আমায় এখনও ধরেনি, তার প্রমাণ এই চিঠি। তবে আমি ধরা দেওয়ার দিকে হয়তো এগোচ্ছি। ধরা পড়া আর ধরা দেওয়া এক নয়, তা হয়তো বোঝ। ধরা দিতে চাচ্ছি, নিজেই এগিয়ে চলেছি শত্রু-শিবিরের দিকে, এর রহস্য হয়তো বলতে পারি। এখন বলব না। এত বিপুল যে সমুদ্র, তারও জোয়ারভাঁটা আসে অহোরাত্রি। এই জোয়ার-ভাঁটা সমুদ্রেই খেলে, আর তার কাছাকাছি নদীতে; বাঁধ-বাঁধা ডোবায়, পুকুরে জোয়ার-ভাঁটা খেলে না। মানুষের মন সমুদ্রের চেয়েও বিপুলতর। খেলবে না তাতে জোয়ার ভাঁটা! যদি না খেলে, তবে তা মানুষের মন নয়। ওই শান-বাঁধানো ঘাটভরা পুকুরগুলোতে কাপড় কাচা চলে, ইচ্ছে হলে কলসি বেঁধে ডুবে মরাও চলে, চলে না ওতে জাহাজ, দোলে না ওতে তরঙ্গ দোলা, খেলে না ওতে জোয়ার-ভাঁটা… আমি একবার অন্তরের পানে ফিরে চলতে চাই, যেখানে গোপন সৃষ্টিকুজ্ঞ, যেখানে আমার অনন্ত দিনের বধূ আমার জন্যে বসে বসে মালা গাঁথছে। যেমন করে সিন্ধু চলে ভাটিয়ালি টানে, তেমনি করে ফিরে যেতে চাই গান-শ্রান্ত ওড়া-ক্লান্ত আমি। আবার অকাজের কথা এসে পড়ল। পুষ্প-পাগল বনে কাজের কথা আসে না, গানের ব্যথাই আসে, আমায় দোষ দিয়ো না।
‘অগ্নিবীণা’বেঁধে দিতে দেরি করছে দফতরি, বাঁধা হলেই অন্যান্য বই ও ‘অগ্নিবীণা’২ পাঠিয়ে দেব একসাথে। ডি.এম. লাইব্রেরিকে বলে রেখেছি। আর দিন দশেকের মধ্যেই হয়তো বই পাবে। আমার পাহাড়ে ও ঝরনাতলে তোলা ফটো একখানা করে পাঠিয়ে দিয়ো। গ্রুপের ফটোর একখানা (যাতে হেমন্তবাবু ও ছেলেরা আছে), আমি বাহার ও অন্য কে একটি ছেলেকে নিয়ে তোলা যে ফটো তার একখানা এবং আমি ও বাহার দাঁড়িয়ে তোলা ফটোর একখানা – পাঠিয়ে দিয়ে আমায়। ফটোর সব দাম আমার বই বিক্রির টাকা হতে কেটে নিয়ো।
এখন আবার কোন্ দিকে উড়ব, ঠিক নেই কিছু। যদি না ধরে, কোথাও হয়তো যাব, গেলে জানাব। এখন তোমার চিঠিটার উত্তর দিই। তোমার চিঠির উত্তর তোমার ভাবিই দিয়েছে শুনলাম! আরও শুনলাম, সে নাকি আমার নামে কতগুলো কীসব লিখছে তোমার কাছে। তোমার ভাবির কথা বিশ্বাস কোরো না। মেয়েরা চিরকাল তাদের স্বামীদের নির্বোধ মনে করে এসেছে। তাদের ভুল, তাদের দুর্বলতা ধরতে পারা এবং সকলকে জানানোই যেন মেয়েদের সাধনা। তুমি কিন্তু নাহার, রেগো না যেন। তুমি এখনও ওদের দলে ভিড়নি। মেয়েরা বড্ড অল্পবয়সে বেশি প্রভুত্ব করতে ভালোবাসে। তাই দেখি, বিয়ে হওয়ার এক বছর পরে ষোলো-সতেরো বছর বয়সেই মেয়েরা হয়ে ওঠে গিন্নি। তারা যেন কাজে অকাজে, কারণে অকারণে স্বামী বেচারিকে বকতে পারলে বেঁচে যায়। তাই সদাসর্বদা পুরুষের পেছনে তারা লেগে থাকে গোয়েন্দা পুলিশের মতো। এই দেখ না ভাই, ছটাক খানেক কালি ঢেলে ফেলেছি চিঠি লিখতে লিখতে একটা বই-এর উপর, এরজন্য তোমার ভাবির কী তম্বি, কী বকুনি। তোমার ভাবি বলে নয়, সব মেয়েই অমনই। স্ত্রীদের কাছে স্বামীরা হয়ে থাকেন একেবারে বেচারাম লাহিড়ি!
একটা কথা আগেই বলে রাখি, তোমার কাছে চিঠি লিখতে কোনো সংকোচের আড়াল রাখিনি। তুমি বালিকা এবং বোন বলে তার দরকার মনে করিনি। যদি দরকার মনে করো, আমায় মনে করিয়ে দিয়ো। আমি এমন মনে করে চিঠি লিখিনি যে, কোনো পুরুষ কোনো মেয়েকে চিঠি লিখছে। কবি লিখছে চিঠি তার প্রতি শ্রদ্ধান্বিতা কাউকে, এই মনে করেই চিঠিটা নিয়ো। চিঠি লেখার কোথাও ত্রুটি দেখলে দেখিয়ে দিয়ো।
আমার ‘উচিত আদর’করতে পারনি লিখেছ, আর তার কারণ দিয়েছ, পুরুষ নেই কেউ বাড়িতে এবং অসচ্ছলতা। কথাগুলোয় সৌজন্য প্রকাশ করে খুব বেশি, কিন্তু ওগুলো তোমাদের অন্তরের কথা নয়। কারণ, তোমরাই সবচেয়ে বেশি করে জান যে তোমরা যা আদর-যত্ন করেছ আমার, তার বেশি করতে কেউ পারে না! তোমরা তো আমার কোথাও ফাঁক রাখনি আমার শূন্যতা নিয়ে অনুযোগ করবার। তোমারা আমার মাঝে অভাবের অবকাশ তো দাওনি তোমাদের অভাবের কথা ভাববার; এ আমি একটুও বাড়িয়ে বলছি না। আমি সহজেই সহজ হতে পারি – সকলের কাছে, ওটা আমার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি, কিন্তু তোমাদের কাছে যতটা সহজ হয়েছি – অতটা সহজ বুঝি আর কোথাও হইনি। সত্যি নাহার, আমায় তোমরা আদর-যত্ন করতে পারনি বলে যদি সত্যিই কোনো সংকোচের কাঁটা থাকে তোমাদের মনে, তবে তা অসংকোচে তুলে ফেলবে মন থেকে। অতটা হিসেব-নিকেশ করবার অবকাশ আমার মনে নেই, আমি থাকি আপনার মন নিয়ে আপনি বিভোর।