যাক, এখন ভাবছি শৈলজার মাটির ঘর তুলি কী করে? মাথা তো একবারে তুর-র-র-ভোঁ!… ‘লাঙল’-এর ফাল আমার হাতে – ‘লাঙল’-এর শুধু বা কাঠেরটাই বেরোয় প্রথমবার। শুধু একটা ‘কৃষাণের গান’ দিয়েছি। নলিনীদাও নাকি চিদানন্দকে স্মরণ করেছেন। – জ্বরে চিত। অফিসটা বোধ হয় চিৎপুরে উঠিয়ে নিয়ে যেতে হবে। অফিসের দোরে একটা আস্ত লাঙল টাঙিয়ে দিতে বলেছি। ওই হবে সাইন বোর্ড। বেশ হবে, না? যাক শৈলজাকে বোলো একটা কিছু করবই।
তোমাদের এক দিন আসতে হবে কিন্তু এখানে। Sincerely-র বাংলা যা হয় – তাই করে বলেছি।… ‘দোলন-চাঁপা’৫ পেয়েছ নৃপেনের৬ কাছ থেকে? তোমাদের সবাইকে দিয়েছি তার হাতে।…
হাঁ, তোমাকে লিখতে হবে কিন্তু ‘লাঙল’-এ। প্রথমবারই দিতে হবে। সকলে মিলে কাঁধ দেওয়া যাক।…শৈলজা, প্রেমেন, অচিন্ত্যকে তাড়া দিয়ো লেখার জন্যে।… আর জায়গা নেই।…
নজরুল
মৌলবি আবদুল গফুরকে
মৌলবি আবদুল গফুরকে
Raniganj,
Moslem Hostel
23.7.17
পাক জোনাবেষু –
আদাব কোর্ণোশাৎ হাজার হাজার পাক জোনাবে পহুছে। বাদ আরজ , ইতিপূর্বে খাদেম আপনাকে ২ খানা পত্র বর্ধমানের ঠিকানায় লিখিয়াছিল, কিন্তু বড়োই দুঃখের বিষয়, কোনো উত্তর পাই নাই। পড়া-শুনা মন্দ হয় নাই। বোর্ডিং অবস্থা মাঝামাঝি। সকলেই ভালো।
রমজান শাহের পিতা সুরত শাহের নিকট আপনি যে ছয় টাকার মানতা হইয়াছিলেন। তন্মধ্যে কেবল ২ টাকা সে আপনাকে দিয়াছিল। বাকি ৪ টাকা আপনি চলিয়া যাইবার সময় আমার নামে চাপাইয়া দিয়াছিলেন এবং লিখাইয়াও লইয়াছিলেন। আমি জানি যে, চারি টাকা আপনি রমজানের হিসাবে চাপান নাই। তথাপি সুরত শাহ বলিতেছে’মৌলবি সাহেব তোমার টাকা চারিটি রমজানের হিসাবে চাপাইয়া দিয়াছেন; তুমি পাইবার কে?’ আমি তাহাকে বিশেষ করিয়া বুঝাইয়া দিলেও সে বুঝিতেছে না। শেষে বলিয়াছে যদি মৌলবি সাহেব লিখিয়া দেন যে তাহা রমজানের হিসাবে চাপান নাই তাহা হইলে আমি টাকা দিতে স্বীকৃত আছি। আপনি পুনরায় যখন টাকার জন্য এখানে আসেন তখনও বলিয়া যান যে, সে-টাকা রমজানের টাকা হইতে কাটাইয়া লই নাই। তথাপি সে বুঝিবে না। অতএব মেহেরবানি পূর্বক অপর কার্ডে স্পষ্ট করিয়া লিখিয়া দিয়া বাধিত করিবেন যে রমজানের টাকা হইতে বা তাহার হিসাবে আমার টাকা কাটাইয়া লন নাই। নতুবা এ গরিবের টাকা কয়টি অনর্থক যায়। আশা করি আমার পত্রপাঠ স্পষ্ট করিয়া জানাইয়া বাধিত করিবেন। পত্রের আশায় রহিলাম।
আজকাল কী করিতেছেন ও কোথায় আছেন জানাইবেন। পাক জোনাবে আরজ।
ইতি
খাদেম
নজরুল এসলাম
শচীন কর-কে
শচীন কর-কে
কৃষ্ণনগর
১০-২-২৬
কল্যাণীয়েষু,
স্নেহের শচীন! তোর কোনো চিঠিও পাইনি, এলিও না। এলে খুব খুশি হতুম। আমার সব কথা প্রাণতোষের কাছে শুনবি।
মার্চে গীষ্পতি আসবে–তখন অবশ্য আসিস। তুই নাকি খুব ভালো কবিতা লিখেছিস আরও কতকগুলো! আসবার সময় সবগুলো নিয়ে আসিস। ভুলিসনে যেন।
যে জোয়ালে গর্দান দিয়েছিস সেটার প্রতি যেন আসক্তি না জন্মে তোর–এই আমার বড়ো আশিস! আমাদের সকলের স্নেহাশিস নে। ইতি –
মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী
‘কাজীদা’
শামসুন নাহার-কে
কৃষ্ণনগর
১১-৮-২৬
সকাল
স্নেহের নাহার,
কাল রাত্তিরে ফিরেছি কলকাতা হতে। চট্টগ্রাম হতে এসেই কলকাতা গেছলাম। এসেই পড়লাম তোমার দ্বিতীয় চিঠি – অবশ্য তোমার ভাবিকে লেখা। আমি যেদিন তোমার প্রথম চিঠি পাই, সেদিনই – তখনই কলকাতা যেতে হয়। মনে করেছিলাম কলকাতা গিয়ে উত্তর দেব। কিন্তু কলকাতার কোলাহলের মধ্যে এমনিই বিস্মৃতি হয়েছিলাম নিজেকে যে কিছুতেই উত্তর দেওয়ার অবসর করে নিতে পারিনি। তাছাড়া ভাই, তুমি অত কথা জানতে চেয়েছ, শুনতে চেয়েছ, যে কলকাতার হট্টগোলের মধ্যে সে বলা যেন কিছুতেই আসত না। আমার বাণী হট্টগোলকে এখন রীতিমতো ভয় করে, মূক হয়ে যায় ভীরু বাণী আমার – ওই কোলাহলের অনবকাশের মাঝে। চিঠি দিতে দেরি হল বলে তুমি রাগ কোরো না ভাই লক্ষ্মীটি। এবার হতে ঠিক সময়ে চিঠি দেব, দেখে নিয়ো। কেমন? বাহারটাও না জানি কত রাগ করেছে, কী ভাবছে। আর তোমার তো কথাই নেই, ছেলেমানুষ তুমি, পড়তে না পেয়ে তুমি এখনও কাঁদ! বাহার যেন একটু চাপা, আর তুমি খুব অভিমানী, না? কী যে করছ তোমরা দুটি ভাই-বোনে যে এসে অবধি মনে হচ্ছে যেন কোথায় কোন্ নিকটতম আত্মীয়কে আমি ছেড়ে এসেছি। মনে সদাসর্বদা একটা বেদনার উদ্ বেগ লেগেই রয়েছে। অদ্ভুত রহস্যভরা এই মানুষের মন! রক্তের সম্বন্ধকে অস্বীকার করতে দ্বিধা নেই যার, সে-ই কখন পথের সম্বন্ধকে সকল হৃদয় দিয়ে অসংকোচে স্বীকার করে নেয়। ঘরের সম্বন্ধটা রক্তমাংসের, দেহের, কিন্তু পথের সম্বন্ধটা হৃদয়ের অন্তরতম-জনার। তাই ঘরের যারা, তাদের আমরা শ্রদ্ধা করি, মেনে চলি, কিন্তু বাইরের আমার-জনকে ভালোবাসি, তাকে না-মানার দুঃখ দিই। ঘরের টান কর্তব্যের, বাইরের টান প্রীতির-মাধুর্যের। সকল মানুসের মনে সকল কালের < এই বাঁধনহারা মানুষটি ঘরের আঙিনা পেরিয়ে পালাতে চেষ্টা করেছে। যে নীড়ে জন্মেছে এই পলাতক, সেই নীড়কেই সে অস্বীকার করেছে সর্বপ্রথম উড়তে শিখেই! আকাশ আলো কানন ফুল, এমনই সব না-চেনা জনেরা হয়ে ওঠে তার অন্তরতম। বিশেষ করে গানের পাখি যারা, তারা চিরকেলে নিরুদ্দেশ দেশের পথিক। কোকিল বাসা বাঁধে না, ‘বউ কথা কও’-এর বাসার উদ্দেশ্য আজও মিলল না, ‘উহু উহু চোখ গেল’পাখির নীড়ের সন্ধান কেউ পেল না! ওদের আসা যাওয়া একটা রহস্যের মতো। ওরা স্বর্গের পাখি, ওদের যেন পা নেই, ধুলার পৃথিবীতে যেন ওরা বসবে না, ওরা যেন ভেসে আসা গান। তাই ওরা অজানা ব্যথার আনন্দে পাগল হয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে দেশে বিদেশে, বসন্ত-আসা বনে, ফুল-ফোটা কাননে, গন্ধ-উদাস চমনে। ওরা যেন স্বর্গের প্রতিধ্বনি, টুকরো-আনন্দের উল্কাপিণ্ড! সমাজ এদের নিন্দা করেছে, নীতিবাগীশ বায়স তার কুৎসিত দেহ— ততোধিক কুৎসিত কণ্ঠ নিয়ে এর ঘোর প্রতিবাদ করেছে, এদের শিশুদের ঠুকরে ‘নিকালো হিয়াসে’বলে তাড়িয়েছে, তবু আনন্দ দিয়েছে এই ঘর-না-মানা পতিতের দলই। নীড়-বাঁধা সামাজিক পাখিগুলি দিতে পারল না আনন্দ, আনতে পারল না স্বর্গের আভাস, সুরলোকের গান…।