২
পবিত্রবাবু, কাল কলকাতায় এসে পৌঁছেছি ১। দেখা করতে এলাম ২, কিন্তু বরাত খারাপ। আমি ৩২ নং কলেজ স্ট্রিটে।৩ বাড়িটা আপনার সুপরিচিত। দেখা পাওয়ার আগ্রহে বসে থাকব।
হাবিলদার কাজী নজরুল ইসলাম
৩
Dr. Bose’s Sanatorium
Quarter No. 49
Deoghar
শুক্রবার, বিকাল
ভো ভো লিভঁ মসিয়েঁ!
গতকাল শুভ দিবা দ্বিপ্রহরে অহম্ দানবের এই দেওঘরেই আসা হয়েছে। আপাতত আসন পেতেছি ওই উপরের ঠিকানাতে। শিমুলতলা যাওয়া হয়নি। পথের মাঝে মত বদলে গেল। পরে সমস্ত কথা জানাব। জায়গাটা মন্দ নয়। তবে এক মাসের বেশি থাকতে পারব না এখানে, কেননা এখানে খুব বেশি আনন্দ পাচ্ছি না।… ‘নারায়ণ’-এর টাকাটা দিয়েছিস অবিনাশদাকে৩? যদি হাতে টাকা থাকে, তবে ‘বিজলী’র দুটাকা তাদের অফিসে দিয়ে আমার ঠিকানায় কাগজ পাঠাতে বলিস।৪ … তোর বউ-এর খবর কী?৫ তাঁর সঙ্গে আমার চিঠির মারফতে আলাপ করিয়ে দিস। কালই চিঠি না পেলে কিন্তু তোদের মাঝে জোর কলহ বাধিয়ে দেব।… কান্তিবাবুকে আমার প্রীতি ভালোবাসা আর প্রণাম জানাস।৬ তোর গল্প লিখব, একটু গুছিয়ে নিই আগে। বড্ড শীত রে এ শা-র জায়গায়। টাকা ফুরিয়ে গেছে। আফজল৭ কিংবা খাঁ৮ যেন শিগগির টাকা পাঠায়। খোঁজ নিবি, আর বলবি আমার মাঝে মানুষের রক্ত আছে। আজ যদি তারা সাহায্য করে, তা ব্যর্থ হবে না – আমি তা সুদে আসলে পুরে দেব।
ইতি –
তোর পীরিত-দধি-লুব্ধ মার্জার
নজর্
বল সখী বল ওরে সরে যেতে বল
৩২
পিলু-খাম্বাজ–কারফা
বল সখী বল ওরে সরে যেতে বল
বল সখী বল ওরে সরে যেতে বল।
মোর মুখে কেন চায় আঁকি-ছলছল
ওরে সরে যেতে বল॥
পথে যেতে কাঁপে গা
শরমে জড়ায়ে পা,
মনে হয় সারা পথ হয়েছে পিছল।
ওরে সরে যেতে বল॥
জল নিতে গিয়ে সই
ওর চোখে চেয়ে রই,
সান-বাঁধা ঘাট যেন কাঁপে টলমল।
ওরে সরে যেতে বল॥
প্রথম বিরহ মোর
চায় কি ও চিত-চোর?
চাঁদনি চৈতি রাতে আনে সে বাদল।
ওরে সরে যেতে বল॥
বলাই দেবশর্মা-কে
হুগলি,
৩১ শ্রাবণ, ১৩৩২
শ্রীচরণেষু,
বলাইদা! আবার তুমি ‘শক্তি’র১ হাল ধরে ভয়ের সাগরে পাড়ি দিলে দেখে উল্লসিত হয়ে উঠলাম। ‘ধূমকেতু’তে চড়ে আমার আর একবার বাংলার পিলে চমকে দেওয়ার ইচ্ছে ছিল।২ কিন্তু গোবরমন্ত (সরকার) সাহেব পেছনে ভীষণ লেগেছে। কোনো ক্রমেই একে উঠতে দেবে না। তাই ‘বারো বাড়ি তেরো খামার যে বাড়ি যাই সেই বাড়িই আমার’ নীতির অনুসরণ করে পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছি। বাংলার আবহাওয়া বড্ড বেশি ভেপসে উঠেছে এবং তাতে অনেক না-দেখা জীবের উদ্ভব হয়েছে। এখন একজন শক্ত বেটাছেলের দরকার – যে কোদাল হাতে এগুলোকে সাফ করবে। লাভ-লোভকে এড়িয়ে চলার অসম-সাহসিকতা নিয়ে তবে এতে নামতে হবে। যাক, তুমি যখন নেমেছ, তখন কিছু একটা হবে বলে জোর আশা করছি। দেখো দাদা তুমিও শেষে ভেস্তে যেয়ো না। এ ধূমকেতু-ল্যাজাও পেছনে রইল ; নুড়ো জ্বালাবার আগুনের জন্য যখনই দরকার হবে চেয়ে পাঠিয়ো। আর একটি কথা দাদা, মহাত্মা হওয়ার লোভ কোরো না।… ইতি –
তোমার স্নেহধন্য
নজরুল
মাহফুজুর রহমান-কে
হুগলি
১৬-৭-২৫
স্নেহভাজনেষু –
মাহফুজ! অনেক দিন তোমার খবর পাইনি। আমিও বাড়ি থাকি না – এখান ওখান ঘুরছি। কাল ফিরেছি বাঁকুড়া থেকে।১ মাঝে মাঝে প্রাণতোষের২ কাছে খবর পাই তোমার। সেও দেখা দিচ্ছে না কয়দিন থেকে। এখন কোথায় আছ, পাস করেছ কিনা – এবং কোথায়, কী কী পড়বে পাস করলে – তা জানিয়ো অবশ্য। – বইয়ের টাকা আদায় হয়ে থাকলে পত্রপাঠ পাঠিয়ে দেবে। বড্ড দরকার পড়েছে টাকার। আদায় না হয়ে থাকলে আদায় করবে পত্রপাঠ। বই বিক্রি না হলে ফেরৎ পাঠাবে – বই-এর বড্ড দরকার। সকল ছেলেদের স্নেহাশিস দিয়ো। ইতি –
শুভার্থী –
নজরুল
P.S. পত্রোত্তর দিয়ো শিগগির।
২
হুগলি,
২০ জুলাই, ১৯২৫
কল্যাণীয়েষু,
তোমার চিঠি পেলুম। তুমি পাস করেছ জেনে খুশি হলুম। কলেজেই পড়ো এখন। তুমি বোধ হয় রংপুরের ইদরিশ ও ইলিয়াশকে চেনো। যদি না চেনো, তোমাদের প্রফেসর সাতকড়ি মিত্র (আমার বড়দা)-কে জিজ্ঞেস করো – তিনি বলে দেবেন। ওদের সঙ্গে পরিচয় করো। তোমার আনন্দ হবে। ওরা বড্ড ভালো ছেলে! ইদরিশের সঙ্গে দেখা হলে বোলো – কতকগুলি বই ছিল ওদের কাছে (ওর এবং আজিজ বলে একটি ছেলের কাছে) – তার কী হলো? আজিজের সঙ্গেও আলাপ কোরো। রংপুরে সবচেয়ে দেখবার জিনিস হচ্ছে বড়দা (সাতকড়ি মিত্র)। এতদিন নিশ্চয় আলাপ হয়েছে তোমার। তাঁকে এবং বউদিকে (ওখানে থাকলে) আমার প্রণাম দিও। ইদরিশ, ইলিয়াশ আজিজ প্রভৃতি সব ছেলেদের এবং তোমাকে আমার স্নেহাশিস। আমি বড়ো ব্যস্ত। বীরভূম যাচ্ছি ৪/৫ দিনের জন্যে। ইতি –
শুভার্থী
নজরুল
মুরলীধর বসু-কে
হুগলি,
১৫ নভেম্বর, ১৯২৫
প্রিয় মুরলীদা!
আজ তোমার চিঠি পেয়ে জ্বরজ্বর মনটা বেশ একটু ঝরঝরে হয়ে উঠল। দুটো কথাতেই তোমার যে প্রীতি উপচে পড়েছে, তা আমার হৃদয়-দেশ পর্যন্ত গড়িয়ে এসেচে। দিন ছয়েক থেকে ১০৩- ৪- ৫ ডিগ্রি করে জ্বরে ভুগে আজ একটু অ-জ্বর হয়ে বসেছি। পঞ্চাশ গ্রেন কুইনাইন মস্তিষ্কে ঊনপঞ্চাশ বায়ুর ভিড় জমিয়েছে। আমার একটা মাথাই এখন হয়ে উঠেছে দশমুণ্ড রাবণের মতো ভারী, হাত দুটো নিসপিস করছে – সেই সঙ্গে যদি বিশটা হাতও হয়ে উঠত! তাহলে আগে দেবতাগুষ্ঠীর নিকুচি করে আমাদের ভাঙা ঘরে সত্যিকারের চাঁদের আলো আসে কিনা দেখিয়ে দিতাম। মুশকিল হয়েছে মুরলীদা, আমরা কুম্ভকর্ণ হতে পারি, বিভীষণ হতে পারি – হতে পারিনে শুধু রাবণ। দেবতা হওয়ার লোভ আমার কোনো দিনই নেই – আমি হতে চাই তাজা রক্ত-মাংসের শক্ত হাড্ডিওয়ালা দানব-অসুর! দেখেছ কুইনাইনের গুণ!…