দেশের ছোটো বড়ো মাঝারি সকল দেশপ্রেমিক মিলে যখন ‘এই বেলা নে ঘর ছেয়ে’প্রবাদটার সার্থকতা হৃদয়ঙ্গম করে পনেরো দিন বিনাশ্রমে জেল বাসের বিনিময়ে অন্তত একশত টাকার ‘ভাত কাপড়ের সংস্থান’করে নিলে, তখন যারা তাদের ত্যাগের মহিমাকে মলিন করল না আত্মবিক্রয়ের অর্থদিয়ে – তাদের অন্যতম হচ্ছে মুজাফ্তফর। মুজাফ্ ফর কানপুর বলশেভিক ষড়যন্ত্র কেসের দণ্ডভোগী অন্যতম আসামি এবং বাংলার সর্বপ্রথম মুসলমান স্টেট প্রিজনার। বাংলার বাইরে নানান খোট্টাই জেলে তার উপর অকথ্য অত্যাচার চলেছে। শেষে যখন যক্ষ্মায় সে মৃতপ্রায় তখন তাকে হিমালয় পর্বতস্থিত আলমোড়ায় নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয় তখন ওজন তার মাত্র ৭৪ পাউণ্ড।
সেখানে দিনের পর দিন কাটিয়েছে সে অনশনে, তবু সে চায়নি কিছু। সে বলেনি কোনোদিনই মুখ ফুটে যে, দেশের জন্য সে কিছু করেছে। বলবেও না ভবিষ্যতে। সে বলে না বলেই তো তার জন্য কান্না পায়, তার উপর আমার এত বিপুল শ্রদ্ধা। সেই নেতা যিনি আজ কর্পোরেশনের মোটর চড়ে দাড়িতে মলয় হাওয়া লাগিয়ে বেড়াচ্ছেন এবং ব্যাঙ্কে যার জমার অঙ্কের ডান দিকের শূন্যটা বেড়েই চলেছে দিনের পর দিন, যাঁকে কলকাতা এনে তাঁর টাউন হলের অভিভাষণ লিখিয়ে দিয়ে কাগজে কাগজে তাঁর নামে কীর্তন গেয়ে বড়ো করে তুলল সেই মুজফ্অফর তার অতি বড়ো দুর্দিনে একটা পয়সা বা এক ফোঁটা সহানুভূতি পায়নি ওই লিডার সাহেবের কাছে। সে অনুযোগ করে না তার জন্য, কিন্তু আমরা করি।
যে মুসলমান সাহিত্য সমিতির প্রাণ প্রতিষ্ঠা করল মুজফ্বফর অথচ তার নিজের নাম চিরকাল গোপন রেখে গেল, সেই মুসলমান সাহিত্য-সমিতির যখন নতুন করে প্রতিষ্ঠা হল এবং তার নতুন সভ্যগণ মুজফ্যফর রাজলাঞ্চিত বলে এবং তাদের অধিকাংশই রাজভৃত্য বলে যখন তার বন্দি বা মুক্ত হওয়ার জন্য নাম পর্যন্ত নিলে না– তার ঋণের কৃতজ্ঞতা স্বীকার তো দূরের কথা, তখন একটি কথা কয়ে দুঃখ প্রকাশ করেনি মুজফ্লফর। ও যেন প্রদীপের তেল, ওকে কেউ দেখলে না দেখলে শুধু সেই শিখাকে, যা জ্বলে প্রদীপের তেলকে শোষণ করে। শুধু মুজফ্রফর নয়, এ দলের প্রায় সকলেরই এই অবস্থা। হালিম, নলিনী সব সমান। এ বলে আমায় দেখ, ও বলে আমায় দেখ। একজনের অ্যাপেন্ডিসাইটিস, একজনের ক্যানসার, ম্যালেরিয়া, একজনের আলসার, একজনের ধরেছে বাতে। আর হাড়-হাভাতে ও হা-ভাতে তো সবাই। যাকে বলে নরক গুলজার, বলতে হলে সব শ্রীচরণ মাঝি ভরসা। কোমরের নীচে টাকা জুটল না কারুর, আর পেটের ভিতর সর্বদা যেন বোমা তৈরি হচ্ছে – খিদের চোটে এমন হুড়মুড় করে। দিনরাত চুপসে আছে–বাতাস বেরিয়ে যাওয়া ফুটবলের ব্লাডারের মতো। চায়ের কাপগুলো অধিকাংশ সময়েই দন্ত ‘ক্লাইভ স্ট্রিট’করে পড়ে আছেন। লেখককে তাঁর ইলেকট্রিক ফ্যান শীতলিত এবং লাইট উজ্জ্বলিত ড্রয়ার টেবিল ডেস্ক পরিশোভিত, দারোয়ান দণ্ডায়িত, ত্রিতল অফিস ত্যাগ করে একটু নীচে নেমে (লিফট দিয়ে) তাঁদের অফিসের মোটরে করে আমাদের ‘গণবাণী’অফিসের ও তার কর্ণধারদের দেখে যাওয়ার নিমন্ত্রণ রইল। বুভুক্ষুগুলো অন্তত তাঁর পয়সার একটু চা খেয়ে নেবে। অবশ্য ওকেও এক কাপ দেবে। আমি নিজে গিয়েই শ্রীযুক্ত তারারাকে নিয়ে যেতাম, কিন্তু এদিকেও ভাঁড়ে ভবানী। কয়েকদিন কলকাতায় যাওয়ার বিশেষ প্রয়োজন থাকলেও যেতে পারছিনে ট্রেন ভাড়ার অভাবে। বাড়ির হাঁড়িতে ইঁদুরেরা বক্সিং খেলছে, ডন খেলছে! ক্যাপিটালিস্টরা আমার চেয়েও সেয়ানা, তারা বলে, ‘হাত বুলোতে হয়, গায়ে বুলোও বাবা, মাথায় নয়, তোমার হাত-খরচটা মিলে যাবে, কিন্তু ও কর্মটা হবে না, দাদা। এমন কী মুজফ্ ফরের মতো সুটকি হয়ে মর-মর হলেও না।’
তার পর ‘গণবাণীর’লেখা নিয়ে ‘তারারা’বলছেন–’বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিকরা লেখাপড়ার সঙ্গে গোটা কয়েক মতবাদ শিখলে ওগুলো শিগগিরই বুঝতে পারবেন?’– তাঁর ইঙ্গিতটা এবং রসিকতাটা দুটাই বুঝলাম না, বুঝলাম শুধু তার জানাশোনা কতটুকু–অন্তত সেই সম্বন্ধে তিনি আলোচনা করেছেন। তিনি কি জানেন না, যে কোনো দেশের কোনো শ্রমিক কার্ল মার্কস-এর ‘ক্যাপিটাল’পড়ে বুঝতে পারবে না। ওই মতবাদটা যারা পড়বে তারা কৃষক শ্রমিক নয়, তারা লেনিন ল্যান্সব্যারির নমুনার লোক। কার্ল মার্কসের মতবাদ সাধারণ শ্রমিক বুঝতে না পারলেও তা দিয়ে তাদের মঙ্গল সাধিত হয়েছে হচ্ছে এবং হবে। এ মতবাদ দিয়ে এমন কতকগুলি লোকের সৃষ্টি হয়েছে যাঁরা জগৎটাকে উলটে দিয়ে নতুন করে গড়তে চাচ্ছেন বা গড়ছেন। মতবাদ কোনোকালেই জনসাধারণ বুঝবে না, মতবাদ তৈরি করে তুলবে সেইরকম লোক যাঁরা, বুঝোবেন এ মতবাদের মর্ম জনসাধারণকে। ইঞ্জিন চালাবে ড্রাইভার, কিন্তু গাড়িতে চড়বে সর্বসাধারণ। ‘গণবাণী’ ও কৃষক-শ্রমিকদের পড়ার জন্য নয়, কৃষক শ্রমিকদের গড়ে তুলবেন যাঁরা–’গণবাণী’তাঁদের জন্য। কৃষক-শ্রমিক দলের মুখপত্র, মানে তাদের বেদনাতুর হৃদয়ের মূক মুখের বাণী ‘গণবাণী’তাদের বইতে না পারা ব্যথা কথায় কথায় ফুটিয়ে তুলবে ‘গণবাণী’। ইতি –
বিনীত
– নজরুল ইসলাম
৮ ভাদ্র
১৩৩৩ বঙ্গাব্দ
পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়কে
১
… ‘প্রবাসী’তে বেরিয়েছে ‘সবুজপত্র’-এ পাঠানো কবিতা, এতে কবিতার মর্যাদা বেড়েছে কী কমেছে, তা আমি ভাবতে পারছি না। ‘সবুজপত্র’-এর নিজস্ব আভিজাত্য থাকলেও ‘প্রবাসী’র মর্যাদা একটুকও কম নয়। প্রচার আরও বেশি। তা ছাড়া আমি কবিতা লিখেছি, পারসিক কবি হাফেজের মধ্যে বাংলার সবুজ দূর্বা ও জুঁই ফুলের সুবাস আর প্রিয়ার চূর্ণ কুন্তলের যে মৃদু গন্ধের সন্ধান আমি পেয়েছি, সে-সবই তো খাঁটি বাংলার কথা, বাঙালি জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, আনন্দরসের পরিপূর্ণ সমারোহ। কত শত বছর আগের পারস্যের কবি, আর কোথায় আজকের সদ্য শিশির-ভেজা সবুজ বাংলা। ভারতের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তের রুক্ষ পরিবেশে মৃত্যু সমারোহের মধ্যে বসে এই যে চিরন্তন প্রেমিক-মনের সমভাব আমি চাক্ষুস করলাম আমার ভাষায়, আমার আপন জন বাঙালিকে সেই কথা জানাবার আকুল আগ্রহই এই এক টুকরো কবিতা হয়ে ফুটে বেরিয়েছে। জানি না জুঁই ফুলের মৃদু গন্ধ ও দূর্বা শ্যামলতা এর মধ্যে ফুটেছে কি-না। তবু বাঙালির সচেতন মনে মানুষের ভাব জীবনের এই একাত্মবোধ যদি জাগাতে পারে তবে নিজেকে ধন্য মনে করব। অবশ্য বাঙালির কাছে পৌঁছে দেওয়ার ও যোগ্য বাহনে পরিবেশন করবার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব আপনার। …