সভ্য হতে গিয়ে দেশকে বাধ্য হতে হয়েছে নারীবিরোধী কিছু প্রথার বিলুপ্তি ঘটাতে। কিন্তু অধিকাংশ পুরুষ এবং নারীর মানসিকতা এখনও ভয়াবহরকম পুরুষতান্ত্রিক। নারীর অধিকার সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে হলে সমাজে নারী পুরুষের প্রচলিত প্রভু দাসীর ভূমিকা বদলের প্রয়োজন প্রচণ্ড। শিশুবয়স থেকে যেমন এই শিক্ষাটি নেওয়া জরুরি, যে, নারী ও পুরুষ উভয়ের অধিকারে কোনও তফাৎ নেই, একই সঙ্গে সমাজে নারী পুরুষের সমানাধিকারের চর্চাও দেখা জরুরি। পড়ে বা শুনে যত না মানুষ শেখে, দেখে তার চেয়ে বেশি শেখে।
নারীর অবস্থার উন্নতি যদি সত্যিকার হত, তবে এখনও কনে দেখা, এখনও পণ প্রথা টিকে থাকতো না। মেয়েশিশু হত্যা হত না, যেমন হচ্ছে। কেউ কেউ বলে মেয়েরা নির্যাতিত যদি হয়েই থাকে, গ্রামে হচ্ছে, শহরে নয়। পশ্চিমবঙ্গে মেয়েভ্রুণহত্যা সবচেয়ে বেশি কিন্তু হচ্ছে কলকাতা শহরে। এই শহরে সবার নাকের ডগায় দাঁড়িয়ে দাঁতাল হাসি হাসছে বীভৎস বেশ্যালয়। যেন পুরুষেরা প্রতিনিয়ত ওখানে ভিড় করতে পারে নারীকে কুৎসিতভাবে অপমান করার জন্য, নারীর মান সম্মান নিশ্চিহ্ন করার জন্য, নারীর অধিকারকে পায়ে পেষার জন্য। নারীপাচার, নারীহত্যা, ধর্ষণ, গণধর্ষণ কিছুই এখন আর অবাক করা ঘটনা নয়। এগুলো গ্রামের চেয়ে বেশি ঘটে শহরে।
বাঙালি নারীর যে ছবিটি মানুষের মনে গাঁথা, সেটি শাড়ি পরা। বয়স বেশি হলে আটপৌরে সাদা শাড়ি, আঁচলে চাবির গোছা, আর কম হলে কুচি কেটে রঙিন রঙিন শাড়ি। হিন্দু হলে কপালে টিপ, সিঁথিতে সিঁদুর। না হলে যেমন আছে, তেমন। হাতে চুড়ি, কানে দুল। নাকে নথ অথবা নথ নয়। বাঙালি নারী কেমন চরিত্রের হবে, তা যুগে যুগে পুরুষেরা বলে দিয়ে গেছে। লজ্জাবতী, মায়াবতী, নম্র, নত। বাঙালি নারীকে কখনও স্বাধীনচেতা, স্বকীয়, স্বেচ্ছাচারী হিসেবে মানায় না। বাঙালি নারী দেহমন ঢেলে সংসারের কাজে উদয়াস্ত পরিশ্রম করবে। আবার মাঝে মাঝে বীণা বা তানপুরা বা হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান করবে। শীতলপাটিতে আধশোয়া হয়ে দুপুরবেলা কবিতা লিখবে, নয়ত ঘরসংসারের গপ্প করবে। দরজায় দাঁড়িয়ে অস্থির অপেক্ষা করবে, স্বামীর। বাড়ি ফিরলে নিজের রান্না করা খাবার আদর করে পাতে তুলে তুলে খাওয়াবে। হাতপাখায় হাওয়া করবে। নিজের খাওয়া সবার পিছে, সবার নিচে সবহারাদের মাঝে । ধম্মকম্ম করা, মুখ বুজে সবার সব অত্যাচার সওয়া, মমতায় হৃদয় উপচে রাখা, জগতের সবার মঙ্গল কামনা করা, অন্যের সেবায় নিজের জীবনটি বিসর্জন দেওয়া—এই না হলে বাঙালি নারী! বাঙালি নারী মানে সুচিত্তা সেন, শাবানা। যামিনী রায়, কামরুল হাসান।
এই চিত্র-চরিত্র তৈরি করা। এ ছিঁড়ে বেরিয়ে এসেছে অনেক নারী। তারা যা খুশি তাই পরে, যা খুশি তাই করে। পোশাকে প্রচুর পশ্চিমী ঢং, ভাষা চৌকশ, গায়ে গতরে তরঙ্গ, বাঁধ না মানা, বাধা না মানা। তারা দেখতে নতুন। শুনতে নতুন। কিন্তু তাদের সঙ্গে অনেকদূর চললে দেখা যায় একটি সীমানায় এসে তারা পৌঁছোচ্ছে, সীমানার বাইরে এক পা-ও ফেলছে না। সংস্কারের একটি অদৃশ্য সুতো তারা শক্ত করে হাতে ধরে রাখে, সুতোয় টান পড়লে পিছু হটে। পিছু হটে, বিয়ে করে, স্বামী সেবা করে, সন্তান উৎপাদন করে, জীবন উৎসর্গ করে আর মুখ বুজে সব সয়। শুরুতে এদের আধুনিক বলে মনে হলেও আধুনিক নয়। শুরুতে নতুন দিনের স্বপ্ন দেখাচ্ছে, কিন্তু যৌবনে এসে দাদি নানি ঠাকুরমা দিদিমার আদর্শ মেনে নিয়ে ওদের মতোই ওদের বৃজ্ঞে আবর্তিত হতে শুরু করে। আধুনিকতার সত্যিকার অর্থ বুঝতে অসুবিধে হলে বুঝি এই হয়।
পুরুষাঙ্গ না থাকার অপরাধে জীবনভর যাদের নির্যাতিত হতে হয়, প্রাপ্য স্বাধীনতা আর অধিকার থেকে বঙ্গিত হতে হয়, দরিদ্র হয়ে, পরমুখাপেক্ষী হয়ে, আশ্রিতা হয়ে, বোঝা হয়ে, বেঁচে থাকার দুর্বিষহ যন্ত্রণা সইতে বাধ্য হতে হয়, পরিবারে সমাজে রাষ্ট্রে যাদের কোনও নিরাপত্তা নেই, সেই নারীদের আবার জাত কী, সমাজ কী, দেশ কী! বাংলা নিয়ে বাঙালি নিয়ে পুরুষ না হয় গৌরব করতে পারে, নারীর গৌরবের কিছু নেই।
বাঙালি-নারীর ত্যাগের ওপর দাঁড়িয়ে বাঙালি-পুরুষ নিজের আখের গুছিয়ে নেয়। নারীর কিছু গোছানো হয় না। শূন্য জীবন শূন্যই পড়ে থাকে। যে স্বামী আর সংসারের জন্য জীবন বিলিয়ে দেওয়া, সেও কোনও সুখ দেয় না। কব্জিতে জুঁইফুলের মালা জড়িয়ে ঘোড়ার গাড়ি চড়ে বাবুরা সন্ধেবেলায় বাইজিবাড়ি যেত। এখন ঘোড়ার গাড়ি নেই, বাইজিবাড়ি নেই। কিন্তু স্ত্রীকে অবত্তা-অপমান, অন্য-নারীসঙ্গে, বহুগামিতা সবই বহাল তবিয়তে আছে। পুরুষ তার বহুগামিতা গায়ের জোরে, ধর্মের জোরে আজও খাটিয়ে যাচ্ছে। শাস্ত্রমতে যত ইচ্ছে তত বিয়ে করতে পারতো পুরুষ, করতোও। একাধিক বিয়ে এখন বাঙালি-হিন্দুর জন্য নিষিদ্ধ বটে, বাঙালি-মুসলমানের জন্য নয়, তারা এখনও চার বিয়ের আরাম ভোগ করছে, মানসিক শারীরিক অত্যাচারে মেয়েদের অতিষ্ঠ করছে। তবে যে ধর্মের যে জাতের পুরুষই হোক, বহুগামিতা তারা মনে করে যে তাদের জন্য বৈধ। আর নারীর জন্য? বেশ্যা হলেই বৈধ, নয়তো নয়। বাঙালি নারীর যৌনতা নিয়ে কথা বলা বারণ, স্বামী নপুংসক হলেও সে স্বামীকে ত্যাগ করা বারণ, সম্পত্তির দাবি করা বারণ, উচ্চাকাংক্ষী হওয়া বারণ, নিজের সুখ আর স্বাধীনতার জন্য কোনও পদক্ষেপ নেওয়া বারণ। বারণের শেষ নেই। রাগ করা, রুখে ওঠা, ছিঁড়ে ফেলা, ভেঙে ফেলা, সবই বারণ।