আমার যা ইচ্ছে হয় আমি তাই করি। কারও ধ্বংস ঘটিয়ে করি না কিছু। স্বেচ্ছাচারী বলে জীবনের অর্থ এবং মূল্য দুটোই আমি ভালো অনুধাবণ করতে পারি। স্বেচ্ছাচারী না হলে, অন্যের ইচ্ছের যূপকাষ্ঠে বলি হলে, আমার বোঝার সাধ্য ছিল না আমি কে, আমি কেন। মানুষ যদি নিজেকেই চিনতে না পারলো, চিনবে তবে কাকে! আজ যদি স্বেচ্ছাচারী না হতাম আমি, হয়তো এই লেখাটি, যে লেখাটি লিখছি, তার একটি বাক্যও আমি লিখতে পারতাম না।
০৭. বাঙালি নারীর সেকাল একাল
অধিকাংশ বাঙালি-হিন্দু, এমনকী যারা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করেছে, রাজনীতি অর্থনীতির জ্ঞানও যাদের বেশ প্রখর, মনে করে যে বাঙালি বলতে বাঙালি- হিন্দু বোঝায়। বাঙালি-মুসলমান, বাঙালি-খ্রিস্টান, বাঙালি-বৌদ্ধ, বাঙালি-নাস্তিকও যে ‘বাঙালি’ তা তারা জানে না। বাঙালি হিন্দুর এই অজ্ঞানতা দিন দিন ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। পূর্ববাংলা বা বাংলাদেশের বাঙালিদের ‘বাংলাদেশি’ বলে ডাকার চল এ দেশে খুব। বাংলাদেশি গরু, বাংলাদেশি আইন হতে পারে, কিন্তু মানুষ কী করে বাংলাদেশি হয়! বাঙালি জাতি তো একাণ্ডরে বাংলাদেশ নামের একটি দেশ জন্ম নেওয়ার সময় জন্ম নেয়নি। বাঙালি তার দীর্ঘশতাব্দীর ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে বাঙালিই আছে, দেশের নাম শুধু রাজনৈতিক কারণে বারবার বদলে যাচ্ছে। সে বদলে যাওয়ার দায় জাতি নেবে কেন! যে ধর্মবাদীরা সমৃদ্ধ এবং সেকুলার বাঙালি-সংস্কৃতিকে বিনাশ করে ইসলামী-সংস্কৃতি ঢুকিয়ে দেশের সর্বনাশ করতে চেয়েছিল, তারা সংবিধান বদলে ফেলেছে বাঙালি-জাতীয়তাবাদের জায়গায় বাংলাদেশি-জাতীয়তাবাদ ঢুকিয়ে। এই তারাই একই উদ্দেশ্য নিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতাকে বিদেয় করে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করেছে।
বাঙালি-মুসলমানের সংখ্যা বাঙালি-হিন্দুর চেয়ে বেশি, সুতরাং বাঙালি মুসলমানের সংস্কৃতিই শেষ অবধি বাঙালি-সংস্কৃতি হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার বেশি সম্ভাবনা। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বাঙালি-মুসলমানের সংস্কৃতি অবাঙালি মুসলমানের সংস্কৃতি থেকে ভিন্ন। এবং অনেক মিল থাকলেও বাঙালি-হিন্দুর সংস্কৃতির সঙ্গেও এর তফাৎ আছে। বাঙালি-মুসলমানের ভাষা ও সংস্কৃতি ঐতিহাসিক কারণে নানা বিদেশি ধর্ম-সংস্কৃতি ও ভাষার প্রভাবে সমৃদ্ধতর।
বাঙালি নারী হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ইসলাম যে কোনও ধর্মে বিশ্বাসী হতে পারে, অবিশ্বাসীও হতে পারে। বাঙালি নারী কেমন আছে বাংলায়, কেমন তাদের দিন রাত্তির— এই প্রশ্নটি যখন নিজের কাছে করি আমি, বড় বেদনায় নুয়ে আসি। যেসমাজে ধর্ম জাঁকিয়ে বসা, সে সমাজে কোনও নারী কি মানুষের অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে? ধর্ম জাঁকিয়ে বসলে পুরুষতন্ত্র জাঁকিয়ে বসে। ধর্ম এবং পুরুষতন্ত্রের যেখানে জয়জয়কার, সেখানে নারীর পরিচয় দাসী বা যৌনবস্তু বা সন্তান-উৎপাদনের যন্ত্র ছাড়া কিছু নয়। বাঙালি নারী এই পরিচয় নিয়ে বেঁচে থাকে, বেঁচে ছিল। অনেকে পরিবর্তনের কথা বলে। গ্রামগুলো মফস্বল হচ্ছে, মফস্বলগুলো শহর, শহরগুলো নগর। নগরে উঁচু উঁচু দালান। ইস্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়। যে বাঙালি-নারীর ঘরবার হওয়া, লেখাপড়া করা নিষিদ্ধ ছিল এই সেদিন, সে আজ ইস্কুল কলেজ পাশ করছে, বিশ্ববিদ্যালয় ডিঙোচ্ছে, চাকরি বাকরি করছে, অর্থ উপার্জন করছে। শহর নগরের শিক্ষিত এলাকায় বাস করলে মনে হয় পরিবর্তন বুঝি আকাশ-সমান। কিন্তু সুবিধে পাওয়া নারী ক’জন সংখ্যায়? আশি ভাগ নারী এখনও জানে না কী করে লিখতে পড়তে হয়। দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করা মানুষের অধিকাংশই নারী। নারীরা ভুগছে, কেবল ধর্ম ও পুরুষতন্ত্র তাদের চাবুক মারছে না, দারিদ্র্যও তাদের রক্তাক্ত করছে। কিন্তু যে নারীরা মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত? তারা কি সুখে আছে? না। আসলে নারীর কোনও শ্রেণী নেই, জাত নেই। যে শ্রেণীতেই তাদের বাস, যে বর্ণেই তারা চিহ্নিত, তারা নির্যাতিত। নির্যাতনের কায়দা ভিন্ন, ধরন একই।
যারা লেখাপড়া জানে, যারা শিক্ষিত, তারা কি নিজের অধিকার নিয়ে বেঁচে আছে? তারা কি আদৌ স্বাধীন? না। আসলে নারী শিক্ষিত হোক, অশিক্ষিত হোক, নির্যাতিতই। নির্যাতিত, কারণ তারা নারী। নির্যাতিত, কারণ ধর্ম পুরুষতন্ত্র সংস্কৃতি সমাজ সবই নারীবিরোধী। শিক্ষিত মেয়েরা পুরুষতন্ত্রের নিয়মকানুন যত নির্ভুলভাবে শিখতে পারে, অশিক্ষিত মেয়েরা তত পারে না। শিক্ষিত মেয়েরাও স্বামীর আদেশ নির্দেশ মতো চলছে। স্বামী তাকে অনুমতি না দিলে সে চাকরি করতে পারছে না। আর, যে মেয়েরা চাকরি বা ব্যবসা করে অর্থ উপার্জন করছে, তারা অথনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করছে বটে, কিন্তু স্বনির্ভর হতে পারছে না। এখনও পচা পুরোনো সংস্কৃতি নারীকে পুরুষের অধীন করে রাখছে। এখনও নারীকে পরনির্ভর করে রাখার পুরুষতান্ত্রিক ষড়যন্ত্র এক তুড়িতে হুররে।
সংস্কৃতি, সে যদি মানবতার বিপক্ষে যায়, সে যদি সমতার সামনে বেয়াদপের মতো দাঁড়ায়, তাকে উড়িয়ে না দিয়ে পুড়িয়ে না দিয়ে লালন করার কী অর্থ? সংস্কৃতি যদি বহমান নদী না হয়ে বদ্ধ জলাশয় হয়, ওতে সাঁতার আমরা কাটবো কেন? বাঙালি সংস্কৃতির সংস্কার না হওয়া-তক, একে বৈষম্যহীন না করা-তক এই সংস্কৃতি নিয়ে গৌরব করার কিছু নেই। বিশেষ করে নারীর তো নেইই।