একটা সময় ছিল, যখন জগতে ছিল ধর্মের শাসন, সেই সময়কে বলা হয় ‘দ্য ডার্ক এজেস’ বা ‘অন্ধকার যুগ’। খ্রিস্টানেরা ডাইনি আখ্যা দিয়ে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারতো মেয়েদের। হিন্দুরা মেয়েদের জ্যান্ত পোড়াতো, স্বামীর সঙ্গে সহমরণে যেতে বাধ্য করতো তাদের, পুরুষের বহুবিবাহ তো ছিলই, উত্তরাধিকার এবং মানবাধিকার থেকে মেয়েদের বঞ্চিত করা হত, যৌনদাসী আর পুত্র উৎপাদনের যন্ত্র হিসেবেই শুধু ব্যবহৃত হত মেয়েরা। মেয়েদের জ্যান্ত না পোড়ালেও যৌনদাসী এবং পুরুষের সম্পত্তি হিসেবে ব্যবহার করা আর সব ধর্মের মতো ইসলামেরও আদর্শ। জগতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দার্শনিক, যুক্তিবাদী, এবং মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসীরা ধর্মীয় শাসনের সমালোচনা করেছেন, সাম্যের কথা, সমানাধিকারের কথা মুখ ফুটে বলেছেন, এবং তাঁদের কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা হয়েছে সব কালেই, সব সমাজেই। গ্যালিলিও গ্যালিলেই, জিয়োর্দানো ব্রুনো থেকে শুরু করে বাংলার বিদ্যাসাগর, রামমোহন রায় সকলের ওপরই আক্রমণ হয়েছে। অন্ধকার সমাজকে যে মানুষই আলোকিত করতে চেয়েছেন, তাদের মুণ্ডচ্ছেদ করার লোকের কোনওকালেই অভাব ছিল না। এখনও নেই।
যুক্তিবাদীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে অন্যান্য ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে নৈতিক এবং লৌকিক শিক্ষা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে গেলেও এবং রাষ্ট্র ও ধর্মকে পৃথক করার ব্যবস্থা হলেও অধিকাংশ মুসলিম অঞ্চল আজও পড়ে আছে অনেক পেছনে। পুঁজিবাদী শক্তি মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে নিজেদের স্বার্থে অনেককাল ধরে ব্যবহার করে আসছে। সাধারণ মানুষকে অজ্ঞতা আর অলৌকিকতার মধ্যে কৌশলে ডুবিয়ে রেখেই স্বার্থসিদ্ধি সম্ভব হয়েছে। মুসলিম শাসকদের স্বৈরাচার, ব্যক্তসি্বার্থ, অদূরদর্শিতা অধিকাংশ মুসলিম রাষ্ট্রকে এখনও সভ্যতা থেকে আলোকবর্ষ দূরে সরিয়ে রাখছে। মানবাধিকার, মানবতা, নারীর অধিকার, গণতন্ত্র, বাক্ স্বাধীনতার অস্তিত্ব প্রায় নেই বললেই চলে। ওখানে যা ঘটছে, তার প্রভাব পড়ছে বিভিন্ন দেশের সংখ্যালঘু মুসলিম এলাকায়। এর ফলে ধর্মনিরপেক্ষ হওয়ার বদলে মানুষ হয়ে উঠছে মৌলবাদী। তা ছাড়াও মুসলিম দেশগুলোয় বৃহৎ পরাশক্তির অহমিকার বোমা-বিস্ফোরণ মুসলিম যুবসমাজকে পথভ্রষ্ট করে মৌলবাদী হওয়ার পথে পা বাড়াতে সাহায্য করেছে। কমিউনিজমের পতনও দিগভ্রান্ত করেছিলো মানুষকে, ধর্মকেই আশ্রয় হিসেবে জেনেছে তারা।
বিপ্লব ছাড়া, গণজাগরণ ছাড়া মৌলবাদের দানবীয় শক্তির সঙ্গে যুদ্ধ করা আজ অসম্ভব। এদের ভয়ে যত কুঁকড়ে থাকবে মানুষ, সভ্যতার সংকট ততই উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে। বাইরে থেকে যেমন জোর করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় না, জোর করে মানবাধিকারও কোথাও চাপানো যায় না। যাদের জন্য গণতন্ত্র, যাদের জন্য সমানাধিকার, তাদেরকে প্রস্তুত হতে হয় এসব গ্রহণ করার জন্য। সচেতন না হলে প্রস্তুত হওয়া যায় না। মানুষের মধ্যে সচেতনতা জাগাতে যুগে যুগে বহু চিন্তক, বহু সংস্কারক চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। ব্যক্তিগতভাবে নিজের লেখালেখির মাধ্যমে সেই চেষ্টা আমি করছি।
মুসলিম অধ্যুষিত দেশে জন্ম হওয়ার কারণে মেয়েদের ওপর ইসলামের আইন এবং সংস্কারের শাসন দেখেছি খুব কাছ থেকে। বহু ধর্ম আর সংস্কৃতির সমাজে বড় হওয়ার কারণে অমুসলিম মেয়েদের ওপর অন্যান্য ধর্মের এবং সংস্কৃতির অনাচারও দেখা হয়েছে যথেষ্ট। আমি অতি ক্ষুদ্র একজন মানুষ। ডাক্তারি পড়েছি। ডাক্তারি করে সচ্ছল জীবন কাটাবো, এরকম কথা ছিল। সব ছেড়ে ছুড়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নারী-বিদ্বেষীতে, পুরুষতান্ত্রিকে, ধার্মিকে আর অসহিষ্ণু মৌলবাদীতে ভরা সমাজে আমি যে নারীর অধিকারের কথা জোর গলায় বলতে শুরু করেছি, তা কেন? শখে? নাকি দায়িত্ব বোধ করেছি সমাজকে সুস্থ করার? কাউকে না কাউকে তো রুখে দাঁড়াতে হয় দুঃশাসনের বিরুদ্ধে। কেউ কেউ তো কোনও দুরভিসন্ধির সঙ্গে আপোস না করে অন্যায়ের প্রতিবাদ করে!
সুস্থতা, সাম্য আর সুন্দরের স্বপ্ন নিয়ে ধর্ম, মৌলবাদ, কুসংস্কার, পুরুষতন্ত্র ইত্যাদির বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে আজ আমি তেরো বছর নির্বাসন-জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছি। মুখ বুজে থাকার শর্ত মেনে নিলে আমি হয়তো দেশে ফিরতে পারতাম। আশ্রয় চেয়ে চেয়ে এক দেশ থেকে আরেক দেশে দৌড়োতে হত না। ঘোর অনিশ্চয়তার মধ্যে বন্ধু স্বজনহীন দুঃসহ জীবন কাটাতে হত না। শুধু লিখবো বলেই তো, যে কথা লেখে না খুব বেশি মানুষ, শুধু যাবো বলেই তো সেই পথে, যে পথে সাহস নেই সবার যাবার।
আমি বারবার বলি মৌলবাদের বিরুদ্ধে এ আমার একার লড়াই নয়, এ সকল মুক্তচিন্তায়, মত প্রকাশের অধিকারে আর ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী মানুষের লড়াই। এ লড়াই সত্যের সঙ্গে অসত্যের। যুক্তির সঙ্গে যুক্তিহীনতার। নতুনের সঙ্গে পুরোনোর। সভ্যতার সঙ্গে অসভ্যতার। সাম্যের সঙ্গে অসাম্যের। এ লড়াই ত্তানের সঙ্গে অজ্ঞতার। শিক্ষার সঙ্গে অশিক্ষার। প্রগতির সঙ্গে পশ্চাৎপদতার।
প্রায়ই আমার ওপর রক্ষণশীল পুরুষতান্ত্রিক ধার্মিক মৌলবাদীদের হামলা হয়। হামলা হয় কেন? ফতোয়া জারি হয় কেন? মাথার দাম ঘোষণা হয় কেন? নিশ্চয়ই আমি সঠিক জায়গায় আঘাত করতে পেরেছি। আমি নারীর অধিকারের পক্ষে লিখবো এবং নারী-অধিকার বিরোধী শক্তি আমার ওপর খুশি থাকবে তা তো হতে পারে না।