সপ্তমীর কাছে বড় পবিত্র জিনিস এই শাঁখা। এটি সে যে করেই হোক পরতে চায়। এটি ফেলতে যেদিন হবে, সেদিন তার জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ দিন।
আমি হেসে বলি, ‘তোমার স্বামী তোমার কোনও খবরই নেয়নি। তোমার দুরবস্থায় কোনও রকম সাহায্য কোনওদিনই করেনি। তোমার দু বাচ্চা জানেই না বাবা কাকে বলে। ওই লোক বেঁচে থাকলেই কী, না থাকলেই কী।’
সপ্তমী বললো, ‘আমার স্বামী যেভাবেই থাকুক, আমি চাই বেঁচে থাকুক।’
‘কেন?’ আমার প্রশ্ন।
সপ্তমীর উত্তর, ‘আমি শাঁখা সিঁদুর নিয়েই মরতে চাই।’
শাঁখা সিঁদুর নিয়ে মরলে সপ্তমী স্বর্গে যাবে। সপ্তমীর মতো মেয়ে প্রচুর চারদিকে। আমি সেই মেয়েদের কথা জানি, যাদের স্বামী আরেকটা বিয়ে করে অন্যত্র সংসার করছে, ফিরেও তাকায় না, জানি সেই মেয়েদের কথা স্বামীরা যাদের মেরে হাড় গোড় ভেঙে ফেলে রাখে, জানি সেই মেয়েদের কথা, যে মেয়েরা অমানুষিক পরিশ্রম করে সারাদিন যা উপার্জন করে, তার পুরো টাকাই মদ্যপ জুয়ারী স্বামী সন্ধেবেলা এসে কেড়ে নেয়, জানি সেই মেয়েরা কী পরম যত্নে সিঁদুর পরে, কী আহলাদে শাঁখা পরে।
‘শাঁখা সিঁদুর না পরলে তো নানারকম সম্ভাবনা আছে। কারও সঙ্গে তোমার প্রেম হতে পারে, তাকে বিয়ে করে নতুন জীবন শুরু করতে পারো। কোনও ভালো লোকের দেখা তো পেতে পারো।’
আমার কথা শুনে সপ্তমী জোরে হেসে ফেললো। বললো, ‘না, না, বিয়ে আমাদের একবারই হয়। স্বামী আমাদের একজনই থাকে। ভালো লোকের কথা বলছেন? না, দিদি। কাউকে বিশ্বাস নেই। প্রথম প্রথম ভালো হলেও শেষে গিয়ে সব লোকই আমার স্বামীর মতোই।’
সপ্তমী একদিন বললো, ‘বদ লোকের উৎপাত থেকে বাঁচার জন্য শাঁখা সিঁদুর আমাদের পরতেই হয়। এগুলো পরা দেখলে লোকেরা বুঝে যাবে আমরা কোনও বেওয়ারিশ মাল নই।’
আমার বোঝা হল, শাঁখা সিঁদুর মেয়েদের জীবনে বিরাট এক নিরাপত্তা। স্বামীর কোনও অস্তিত্ব না থাকলেও বেওয়ারিশ মাল ভেবে শিয়াল শকুনেরা যেন তাদের খুবলে না খেতে পারে, সে কারণে শাঁখা সিঁদুরের আশ্রয় তাদের নিতেই হয়।
কিন্তু শাঁখা সিঁদুর মেয়েদের সত্যিকার কোনও নিরাপত্তা দিতে পারে বলে আমি মনে করি না। যে পুরুষ ছিঁড়ে খেতে আসে, ধর্ষণের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে আসে, বদ উদ্দেশে বদমাইশি করতে আসে, শাঁখা সিঁদুর তাদের জন্য কোনও বাধা নয়।
সপ্তমীর জন্য, সপ্তমীর মতো আরও লক্ষ মেয়ের জন্য আমার খুব কষ্ট হতে থাকে। মেয়েটি একা থাকে, একা একটি বেড়ার ঘরে। খেতে পাক বা না পাক, কোথায় কোন সুদূরে আমোদ ফুর্তি করা স্বামীর মঙ্গলের জন্য যত পুজো আচ্চা আছে, সবই অভাবী মেয়েটি সাধ্যের বাইরের খরচাপাতি দিয়ে হলেও করে। কী নিরাপত্তা দেয় তাকে শাঁখা সিঁদুর। জিজ্ঞেস করেছিলাম তাকে কেউ কি চেষ্টা করেনি অসম্মান করতে?
‘খুব করেছে।’ সপ্তমীর কথা। ‘দিন রাত লোকে করেই যাচ্ছে।’
‘তবে আর কী লাভ!’ বলতে চেয়েও বলিনি। নিজেই বললো, ‘রাতে রাতে ঘুম হয় না। বালিশের কাছে একটা দা নিয়ে শুই। দরজায় যখনই খুট খুট শব্দ হয়, দা নিয়ে দরজার কাছে যাই। আয় কে ঢুকবি ঢোক, আজ তোর একদিন কী আমার একদিন।’
‘এত সাহস তোমার সপ্তমী!’ মুগ্ধ বিস্ময়ে বলি।
‘সাহস না থাকলে লোকে কেটে ফেলতো গো দিদি। কেউ দু পয়সা দিয়ে আমাকে সাহায্য করার নেই। সোনারপুর থেকে সাত সকালে উঠে পান্তা খেয়ে ভিড়ের ট্রেন ধরি। সাত লোকের বাড়িতে কাজ করে রাতের অন্ধকারে বাড়ি ফিরি। সাহস আছে বলে একটু একটু করে টাকা জমিয়ে একটা জায়গা কিনেছি, জায়গার ওপর হোক না দরমার, ঘর তো একটা করেছি। লোকে কত বড় ছোট কথা বলেছে, বলেছে কলকাতায় গিয়ে গিয়ে লাঙ ধরি। কারও কথায় আমি কান দিইনি। কান দিলে চলবে? আমাকে কি একবেলা খেতে দেবে নাকি ওরা?
জিজ্ঞেস করি, ‘তবে শাঁখা সিঁদুর না পরলে লোকে কী ভাববে কী বলবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করো কেন? যা ইচ্ছে তাই বলুক, ভাবুক। বেওয়ারিশ মাল ভাবলে তোমার কী যায় আসে? যদি বলো, তোমার অনুমতি ছাড়া তোমাকে কেউ স্পর্শ করবে, তোমাকে কেউ বিরক্ত করবে, তোমার ওপর কেউ ঝাঁপিয়ে পড়বে, তাতে কী? তোমার দা তো আছেই। ভয় কিসের?’
সপ্তমীর চোখে অন্য ভয় খেলা করে। সেই ভয়টা দীর্ঘ দীর্ঘকাল ধরে মহা দাপট নিয়ে বিরাজ করা সংস্কারকে ভাঙার ভয়। এই ভয়টা সপ্তমীর মতো আরও সহস্র সপ্তমীর আছে।
নিম্নবিত্ত মেয়েরা কী কী সব কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলে, উচ্চ-শ্রেণীর, উচ্চ-শিক্ষিত উচ্চ- বিত্ত মেয়েদের পক্ষে সেসব কল্পনা করাও অসম্ভব। সপ্তমীরা আইন জানে না তাই মানে না। মুখের অন্ন জোগাতে বাধা দেয়, এমন যা কিছুই দেখে সজোরে উপড়ে ফেলে, পাছে লোকে কিছু বলের ধার কখনও ধারে না। ভীষণ সাহস আর শক্তি নিয়ে এরা একা একা বেঁচে থাকে। এদের দু পয়সা দিয়ে সাহায্য করার, একবেলা খাবার দিয়ে সহযোগিতা করার কেউ নেই। এরা যুদ্ধ করে প্রতিদিন, ভাতের একটি দানার জন্যও যুদ্ধ করতে হয়। এরা কোনওদিন ইস্কুলে যায়নি, স্বরে অ স্বরে আ জানে না। কিন্তু লাফিয়ে কী করে ট্রেনটা ধরতে হয় জানে। কেউ কাঁধ খামচে ধরলে কী করে গুষ্ঠি তুলে গালি দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে হয় জানে। নিজের পয়সার দিকে কেউ হাত বাড়ালে সেই হাত কি করে মুচড়ে দিতে হয় জানে। রাতের অন্ধকারে ঘরের দরজা ভেঙে কেউ ঢুকে পড়লে মাথায় কী করে কোপ দিতে হয় জানে। শুধু জানে না কী করে ফেলে দিতে হয় হাতের শাঁখা, কী করে মুছতে হয় সিঁদুর। সংস্কারের শেকলে বন্দি এখনও বেশির ভাগ মেয়ে, এমনকী দুর্দান্ত সাহসী মেয়েও।
৪৬. ধর্ম থাকবে, নারীর অধিকারও থাকবে, এটা হয় না
নারী-স্বাধীনতা, মানবাধিকার, মানবতা, মুক্ত চিন্তা, মতপ্রকাশের অধিকার, গণতন্ত্র এবং ধর্মমুক্ত জীবনাচরণের সঙ্গে ধর্ম, ধর্মান্ধতা, ধর্মীয় কুসংস্কার, ধর্মীয় আইন, ধর্মীয় শাসন ইত্যাদির বিরোধ সবচেয়ে বেশি। এই বিরোধ আজকের নয়, যেদিন থেকে ধর্মের আবির্ভাব সেদিন থেকেই। নারীর অধিকারের কথা বলবো, কিন্তু ধর্মীয় মৌলবাদীরা আমার ওপর অসন্তুষ্ট হবে না, সুযোগ পেলে আক্রমণ করবে না, তা তো হতে পারে না। কেউ কেউ বলে, ওদের খোঁচাও কেন, বা উসকে দাও কেন, বা বাড়াবাড়ি করো কেন, তাই তো ওরা ফতোয়া দেয়, বা হত্যা করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এর অর্থ মৌলবাদের কারণে নারীরা নিজেদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে হোক, মৌলবাদ সমাজে ত্রাসের সৃষ্টি করছে করুক, মৌলবাদ নারীকে শেকল পরাচ্ছে পরাক, নারীকে অন্ধকারে বন্দি করছে করুক, কিন্তু নারী যেন মুখ বুজে থাকে। মুখ বুজে না থাকলে মৌলবাদীরা আবার নাখোশ হবে, রাগ হবে, গালি দেবে, পাথর ছুঁড়ে মারবে। এর ফলে সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে, তা তো কিছুতেই হতে দেওয়া যায় না।