সব সময় স্বামী-স্ত্রী ব্যবহার করা কেন? স্ত্রী-স্বামীও তো ব্যবহার করা যায়। উত্তমস ুচিত্তার জায়গায় সুচিত্তা-উত্তমও বলা চলে বিকল্প হিসেবে।
ভাষাকে শুদ্ধ করার কথা এই কারণেই বলা হচ্ছে, যে, ভাষা শুধু যে আমাদের মানসিকতার প্রতিফলন তাই নয়, ভাষা আমাদের মানসিকতাকে গঠন করেও বটে। এমন ভাষা যদি সারাক্ষণ ব্যবহার করা হয়, যে ভাষা নারীকে দুর্বল, পরনির্ভর, নিচুশ্রেণীর জীব হিসেবে চিহ্নিত করে, তাহলে এই ধারণাটি মানুষের মানসিকতার মধ্যে অজান্তেই ঢুকে বসে থাকে নারীরা বুঝি সত্যিই দুর্বল, পরনির্ভর, নিচুশ্রেণীর জীব।
আধুনিক হচ্ছে জগত। সাম্যের আর সমানাধিকারের বোধ বাড়ছে মানুষের মধ্যে। নারী শেকল ছিড়ে বাইরে বেরোচ্ছে। আমাদের চিন্তাভাবনা ধ্যান ধারণার বিবর্তন হচ্ছে, তবে ব্যবহৃত ভাষাটির বিবর্তন নয় কেন?
ভাষা খুব শক্তিশালী জিনিস। সাহিত্যিকেরা জানেন, বৈষম্যের শিকার যে নারীরা, তাঁরাও জানেন ভাষার শক্তি কী ভয়ংকর। যে সমাজে যত বেশি মানুষ ভাষার শুদ্ধতা আনার চেষ্টা করবে, সে সমাজ তত সভ্য হবে।
৪৫. শাঁখা সিঁদুরের গল্প
ইস্কুলে বিবাহিত মেয়েরা যেন শাঁখা সিঁদুর পরে না আসে, অবিবাহিত মেয়েদের কাছে নিজেদের দাম্পত্য জীবনের গল্প না করে, কিছুদিন আগে মুর্শিদাবাদের একটি ইস্কুল কর্তৃপক্ষ এমন আদেশই জারি করেছে। জারি করা মাত্র ভীষণভাবে ক্ষেপে উঠলো মিডিয়া, মানুষ। কী? হিন্দু ধর্মের বিরুদ্ধে ফতোয়া! কর্তৃপক্ষ বোঝাতে চাইছেন, দাম্পত্য জীবনের সরস বর্ণনা অবিবাহিত মেয়েদের যদি আগ্রহী করে তোলে বিবাহিত জীবনের প্রতি, তবে তারা পড়াশোনায় আগ্রহী না হয়ে বরং যত শীঘ্র পারে বিয়ে করার জন্য আগ্রহী হবে। কতৃপক্ষের যুক্তি কারও পছন্দ হয়নি, হুমকির মুখে ইস্কুলের শাঁখা সিঁদুর না পরার আদেশ তুলে নিতে বাধ্য হলেন কর্তৃপক্ষ।
আর ওদিকে উত্তর চব্বিশ পরগণার গুমা গ্রামের রীনা বৌদ্ধকে গ্রামবাসীরা প্রচণ্ড মেরে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। তার অপরাধ, বিবাহিত হয়েও শাঁখা সিঁদুর না পরা। বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করার কারণে রীনা শাঁখা সিঁদুর পরেননি, কিন্তু গ্রামবাসীর ফতোয়া, শাঁখা সিঁদুর পরতেই হবে, তা না হলে গ্রামে থাকা চলবে না। রীনা বৌদ্ধ অগত্যা তার স্বামী বীরেন্দ্র বৌদ্ধকে নিয়ে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। তিনি তাঁর গ্রামের বাড়িতে নিরাপদে বাস করতে চান কিন্তু সেই নিশ্চয়তা এখনও তিনি প্রশাসনের কাছ থেকে পাননি।
শাঁখা সিঁদুরের গল্প অনেক। আমার বাড়িতে প্রায়ই গল্প করতে আসে সোনারপুরের সপ্তমী। জন্ম তার সুন্দরবনে। বন্যায় বাড়ি ঘর ভেসে গেল যে বছর, সে বছর তার বাবা মা তার এগারোটা ভাইবোনকে সঙ্গে নিয়ে চলে এসেছিলো সোনারপুরে। সপ্তমী তখন সাত মাসের শিশু। সপ্তমীকে মেঝেয় বসিয়ে রেখে লোকের বাড়িতে কাজ করতো তার মা। সপ্তমীও অল্প বয়স থেকেই লোকের বাড়িতে কাজ করছে। বারো তেরো বছর বয়সেই তার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। স্বামী কোনওদিন ভালোবাসেনি। শ্বশুরবাড়িতে দাসীর কাজ করতো, তারপরও প্রতিদিন তাকে স্বামী সহ শ্বশুরবাড়ির লোকেরা প্রচণ্ড মারতো। এত অত্যাচার সয়েও স্বামীর বাড়ি বলেই রয়ে গিয়েছিল সে। দুটো মেয়ে-বাচ্চা জন্মেছে, বাচ্চাগুলো তখনও কোলে, স্বামী তাকে মেরে প্রায় আধমরা করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিল। সেও পনেরো বছর হয়ে গেল। এই পনেরো বছর স্বামী তার সঙ্গে কোনও যোগাযোগ করেনি, বাচ্চাদুটো বেঁচে আছে কী মরে গেছে তা জানতেও কোনওদিন চেষ্টা করেনি। কোনওদিন কোনও খরচপাতি দেয়নি। অসম্ভব আর্থিক কষ্টে দিনের পর দিন কাটিয়েছে। না খেয়ে বা আধপেট খেয়ে বেঁচেছে সপ্তমী, বাঁচিয়েছে দু বাচ্চাকে। তার স্বামী আরেকটা বিয়ে করে নিয়েছে সেও অনেক বছর। কিন্তু সপ্তমী এখনও পরে আছে শাঁখা সিঁদুর, এখনও পরে আছে হাতে লোহা। দেখে সপ্তমীকে জিজ্ঞেস করেছি, ‘যে লোক তোমাকে এত কষ্ট দিলো, এত মারলো, তাড়িয়ে দিল, তোমার সঙ্গে পনেরো বছর কোনও সম্পর্ক নেই। তুমিও কোনওদিন তার কাছে ফিরবে না। সেও তোমাকে নেবে না। তবে কেন পরে আছো শাঁখা সিঁদুর?’
সপ্তমী বলে, ‘আমাদের মধ্যে একবার শাঁখা সিঁদুর পরলে তা আমরা ফেলতে পারি না।’
আমি বললাম, ‘তুমি ডিভোর্স দিচ্ছ না কেন?’
বললো, ‘আমাদের মধ্যে মেয়েরা ডিভোর্স করতে পারে না।’
বললাম, ‘কে বলেছে পারে না? খুব পারে। তোমার স্বামীর সঙ্গে তোমার তো ডিভোর্স হয়নি, স্বামী তো আরেকটা বিয়ে করে বসে আছে। তোমাদের মধ্যে তো ডিভোর্স না হলে ফের বিয়ে করাও আইনত নিষিদ্ধ, সেটা জানো?’
সপ্তমী আমার কথা ঠিক বুঝতে পারলো না। আমাকে আবার বুঝিয়ে বলতে হল যে এখনকার হিন্দু আইনে ডিভোর্স দেওয়ার অধিকার মেয়েদের আছে এবং কোনও পুরুষ বা নারীর একাধিক স্ত্রী বা স্বামী রাখার অধিকার নেই। না, সপ্তমী এসব আইনের কথা জানে না। সে গড়গড় করে অনেক চেনা পুরুষের নাম বলে গেল, যারা দুটো তিনটে স্ত্রী নিয়ে এক বাড়িতে বাস করছে।
‘কোথায়?’ আমি জিজ্ঞেস করি।
বললো, ‘সোনারপুর, সুভাষগ্রাম, সুন্দরবন।’
সপ্তমীকে আমি দেখেছি কিছু একটা কথা যখন সে আমাকে বিশ্বাস করাতে চায়, তাড়াতাড়ি তার এক হাতের শাঁখাকে আরেক হাতে চিমটি মেরে ধরে বলে, ‘আমার স্বামীর দিব্যি খেয়ে বলছি দিদি….’