শারীরিক যে পার্থক্য পুরুষ নারীতে আছে, তা তো আছেই। তার বদলের কথা হচ্ছে না। নারী আর পুরুষের ভূমিকা এক এক সমাজে এক এক সময়ে এক একরকম ছিল। নারী ও পুরুষ হওয়ার কারণে অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সুযোগ সুবিধে হেরফের করা হয়। নারী এবং পুরুষদের কাজ ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। এই ভাগটি করেছে পুরুষেরা। নারীকে দেশের লোকনীতি, অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ, সিদ্ধান্ত-নির্মাণ — এসব গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব নিতে বাধা দেওয়া হয়। লৈঙ্গিক সাম্যের কথা বললে অনেকে ভাবে পুরুষ ও নারীকে বুঝি এক করে দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। তা নয়, পুরুষ হোক নারী হোক, সুযোগ সুবিধে যা পাবে, সমান পাবে — এই হল দাবি।
‘অবলা’ যে অর্থে ব্যবহার হয়, সেই অর্থে ‘অবল’ শব্দটি ব্যবহৃত হতে হবে। পুরুষ যদি বলহীন এবং দুর্বল হয় তবে তাদের অবল বলে ডাকতে হবে, যেমন ডাকা হয় নারীদের অবলা। কুমারী, সতী, রক্ষিতা, পতিতা, বারাঙ্গণা, বারবণিতা, গণিকা, বেশ্যা, ডাকিনী, কলঙ্গিনী, কুলটা, উপপত্নী, মাগ, মাগী, অসতী, দ্বিচারিণী, রূপোপজীবিনী, দেহোপজীবিনী, ছিনাল, খানকি ইত্যাদির পুং প্রতিশব্দ প্রস্তুত করা হোক, নয় এই শব্দগুলোর ব্যবহার বন্ধ করা হোক।
যে অর্থে কুমারী এবং সতী শব্দদ্বয় ব্যবহৃত হয়, সেই একই অর্থে কুমার আর সৎ ব্যবহৃত হয় না। শব্দে নতুন অর্থ স্থাপন করারও খুব প্রয়োজন। সতী/অসতী শব্দদ্বয়ের পুংলিঙ্গ প্রতিশব্দ তৈরি করতে হলে সত/অসত-এর কথা ভাবা যায়। সৎ-অসৎ যেমন ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে নারী পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে, তেমনই হবে। জানি জোর করে কোনও নতুন শব্দ ভাষায় ঢোকানো যায় না। কিন্তু মানুষের মধ্যে সচেতনতা এলেই নতুন শব্দ এবং বাক্যের ব্যবহার হয়, এবং এর প্রচলন শুরু হয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ বাংলা ভাষাটিকে অত্যন্ত নারী বিরোধী ভাষায় পরিণত করেছে। গালিগালাজ আর যৌন রসাত্মক কৌতুক বাজারে যা চিরকালই চলছে, প্রায় সবই নারী-বিরোধী। নারীকে ভয়ংকরভাবে অপমান করেই হো হো করে তুমুল হেসে ওঠে সমাজ।
যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক পরিবেশে নারীরা বাস করছে, কোনওদিনই সেখানে নারী তার সমানাধিকার পাবে না, যদি এই পরিবেশটি নারীকে বর্জন করে কোনওভাবে।
চলতে ফিরতে আমি পুরুষতান্ত্রিক বাক্যের সম্মুখীন হই প্রতিদিন। ধরা যাক সুব্রত আমাকে নেমন্তন্ন করলো, আমি যাবো, সিদ্ধান্ত নিলাম সঙ্গে আমার এক বন্ধু অমিতকে নেব আমি, যেই না বললাম অমনি সুব্রত অমিতের সঙ্গে ফোনে কথা বলতে চাইবে, বলে দেবে অমিত যেন আমাকে অমুক ঠিকানায় সুব্রতর বাড়িতে নিয়ে যায়। অমুক ঠিকানা অমিত তার বাপের জন্মে চেনে না। যদি চেনে কেউ, সে আমার গাড়ির ড্রাইভার, আর গাড়িতে যে ম্যাপ আছে, সেই ম্যাপ দেখে ঠিকানা খুঁজে বার করতে পারি আমি, যেটি অমিতের পক্ষে কখনই সম্ভব নয়। আমার গাড়িতে আরাম করে বসে অমিত গান শোনে। আর, হয় ড্রাইভার নয় আমি ঠিকানা খুঁজে বার করি। সুব্রতর বাড়িতে যাওয়ার পর সুব্রত এবং তার বাড়ির সকলে আর তার বন্ধুরা এই খবরটি জানে এবং লোককে জানায় যে অমিত নামের একটা ছেলে আমাকে তার বাড়ি নিয়ে গেছে।
কোথাও নেমন্তন্নে গেলে যেখানে প্রচুর লোক লক্ষ্য করেছি একলা মেয়েদের জিজ্ঞেস করে, ‘কার সঙ্গে এলে বা কে নিয়ে এলো তোমাকে?’ একলা ছেলেদের এ কথাটা জিজ্ঞেস করে না কে নিয়ে এলো। মেয়েরা একা কোথাও যেতে পারে না এই বিশ্বাস থেকে ভাষার এই ব্যবহার।
দৈনন্দিন জীবনে প্রতিদিনই পুরুষকে প্রধান করে যেসব বাক্য ব্যবহার হচ্ছে, কারও কানে বা মনে কোনো খটকা লাগে না শুনে। ‘সুব্রত এই মাত্র তার বউকে নিয়ে বেরিয়ে গেল।’ এর বদলে বলা তো যায় ‘সুব্রত আর ঋতুপর্ণা এই মাত্র বেরিয়ে গেল!’ ‘দে আর মেকিং লাভ’ বাংলা কথ্যভাষায় এমন শব্দ প্রচলিত নয়, যা প্রচলিত তা হল ‘ছেলেটা মেয়েটাকে করছে।’ এতে দুজনকে দিয়ে কোনও কাজ করানো হচ্ছে না। তাতে দুজনের ইনভলভমেন্ট নেই। একজনকে অ্যাকটিভ, আরেকজনকে প্যাসিভ ধরা হচ্ছে।
কবি আর মহিলা-কবি, এরকম বলা হচ্ছে অনেক যুগ। নারী পুরুষ উভয়ের জন্য ‘কবি’ শব্দটি ব্যবহার করা জরুরি, কিন্তু তা না করে মেয়েদের যদি ‘মহিলা-কবি’ বলা হয়, তবে পুরুষদের শুধু কবি না বলে ‘পুরুষ কবি’ বলা উচিত। একই রকম সাংবাদিক আর মহিলা সাংবাদিক। হয় দুজনের জন্য সাংবাদিক। নয় একজন পুরুষ-সাংবাদিক, আরেকজন মহিলা-সাংবাদিক।
তোমরা ক-পুরুষ বাস করছো এখানে?’ না বলে, ‘তোমরা ক-প্রজন্ম বাস করছো এখানে?’ ‘তোমার পূর্ব পুরুষ কোথায় বাস করতো?’ র বদলে ‘তোমার আগের প্রজন্ম কোথায় বাস করতো?’
‘আমার কর্তা কলকাতায় নেই’ না বলে ‘আমার স্বামী’, বা যদি নাম হয় কল্যাণ তবে ‘কল্যাণ কলকাতায় নেই।’ স্বামীকে ‘অ্যাই, অ্যাই শুনছো, কই গো, পিংকির বাবা কোথায় গেলে’ এভাবে না ডেকে সোজা নাম ধরে, যদি নাম হয় অভীক, ডাকতে হবে অভীক।
বাংলাকে লিঙ্গ নিরপেক্ষ ভাষা করার ক্ষেত্রে একটা বড় সুবিধে আছে। সুবিধেটি হল ইংরেজির হি এবং শি বাংলায় ‘সে’। হিম/হার/হিজ/ সবই তার/তাকে। নারী পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে এই একই শব্দের ব্যবহার ভাষাটিকে লিঙ্গ নিরপেক্ষ হওয়ার পক্ষে ব্যাপক সম্ভাবনা দিচ্ছে।