‘সাহস নেই, ভীরু, ভীতু’, ইত্যাদি গালি দিয়ে বদমায়েশিকে আড়াল করা হয়। এইসব গালি অনেকটা মায়ের মুখের মধুমাখা আদরের মতো। ‘উফ আমার ছেলেটা কী যে ভীতু, ঘরে একা ঘুমোতে পারে না। আমার মেয়েটার তো সাহস বলতে কিছু নেই, রাস্তায় কিছুতেই একা বেরোতে চায় না।’ বা বন্ধুর সস্নেহ শাসনের মতো, ‘আবে স্লা, মালটা নিজে এসে ধরা দিল, আর তুই কি না টাচ অব্দি করলি না, ভীরু মাইরি।’ এইসব বিশেষণ মধুর বিশেষণ। সুতরাং মুখ বুজে থাকা বাসের লোকদের এত আদুরে বকুনি যারা দিচ্ছে, তাদেরই বরং মুখ বুজে থাকা উচিত। বোঝা উচিত যে এটা মর্যালএর প্রশ্ন। এই মর্যালটাই সমাজের বেশির ভাগ মানুষের নেই, যে, পুরুষকে পুরুষ হওয়ার কারণে লাঙ্গিত করা যেমন অন্যায়, মেয়েদেরও মেয়ে হওয়ার কারণে লাঙ্গিত করা একই রকম অন্যায়। মানুষ জানেই না যে স্বাধীনতা যেমন পুরুষের জন্মগত অধিকার, স্বাধীনতা মেয়েদেরও তেমন জন্মগত অধিকার। মেয়েরা অসম্পূর্ণ নয়, সম্পূর্ণ মানুষ, এবং মানুষ হিসেবে যতটুকু শ্রদ্ধা পাওয়া উচিত, সবটুকুই তাদের প্রাপ্য। ফুর্তি করার উজ্ঞেশে মেয়েদের দিকে যৌনগন্ধময় শব্দ বা বাক্য ছুড়ে দেওয়ার, তাদের নিয়ে মজা করার, তাদের অপমান করার কোনও অধিকার কোনও বানচোত পুরুষের নেই।
এখন শিকারটিকে শিকার করার চেষ্টা হচ্ছে। শিকার বাস ফসকে পালিয়ে গেছে। চোঙ বাজিয়ে ঘোষণা করা হচ্ছে, ‘শিকার তুমি যেখানেই থাকো, বেরিয়ে এসো। পুলিশের কাছে দুষ্টুরা কী কী করেছে সব বলো। শিকার তুমি না দেখা দিলে, তোমার চাঁদমুখ সাধ মিটিয়ে দেখতে না পেলে বঙ্গবাসীর প্রাণ জুড়োবে না। তুমি দেখা না দিলে অন্য শিকাররাও দেখা দিতে শিখবে না গো। সভ্যতার বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।’
শিকার চোঙের শব্দ শুনছে না। বংশীবাদকের বংশীর সুর শিকারের কর্ণকুহরে পৌঁছোচ্ছে না। শিকার হাতে পেতে খোঁজ খোঁজ রব চাঙ্গিকে। আদালতে দাঁড়িয়ে জলজ্যান্ত মেয়ে নিজের মুখে নিজের হেনস্থার পুংখানুপুংখ বর্ণনা দেবে, ভেবেই অনেকে উজ্ঞেজিত। মেয়েটি যেন দয়া করে একবারটি তার ইতিমধ্যে হয়ে যাওয়া সেলেব্রিটি ফেসটি জনগণকে দেখায়।
কিন্তু মেয়ে কেন এসব আহ্বানে ভুলবে? যথেষ্ট কি হয়নি তার নিজেকে দেখানো সেদিন? সেদিন যখন বাসে বসে সে কাঁদছিল! তার কান্না, তার যন্ত্রণা, তার হাহাকার, তার অসহায়তা কারও কি বাকি ছিল দেখার? কেন সে নিজেকে, নিজের চেহারাকে দেখাবে বাইরে? বাসের বাইরের মানুষ কি বাসের ভেতরের মানুষের চেয়ে ভিন্ন কিছু? কে গ্যারেন্টি দেবে যে বাসের বাইরের মানুষ তাকে একইভাবে হেনস্থা করবে না? ওই ভ্রাম্যমান গণআদালতটি তো মেয়েটির দেখা হয়ে গেছে, যেখানে জুরিরা শুধু নীরব দর্শক হয়ে বসেছিলেন। তার কি আর কোনও আদালত দেখার দরকার আছে?
ভদ্রলোকেরা বলাবলি করছেন যে এই মেয়েটিও ঠিক সেই মেয়েটির মতো পালিয়ে গেল, যাকে বাঁচাতে গিয়ে পুলিশ সার্জেন্ট বাপি সেনকে খুন হতে হয়েছিল। অনেকে মেয়েদের দোষ দিয়ে বলছে যে মেয়েরা নাকি পালিয়ে বাঁচার শিক্ষা পেয়েছে। আসলে, এই মেয়েরা শিক্ষা পেয়েছে যে, যৌন হেনস্থার শিকার হলে এবং তা প্রকাশ করলে তাকে আরও বেশি যৌন হেনস্থার শিকার হতে হয়। হেনস্থাকারী পুরুষের বিরুদ্ধে অসন্তোষ প্রকাশ করলে আরও বেশি হেনস্থার আশংকা থাকে। শিখেছে মামলা করলে ঝামেলা নিজেরই হয়, অন্যের নয়। সত্যি বলতে, হেনস্থাকারীর সত্যিকারের কোনও শাস্তি হয় না। শিখেছে বাঁচানোর কথা যারা বলে, তারা আসলে বাঁচায় না। তারাই করুণার ঘায়ে সপাং সপাং করে মেরে জীবন রক্তাক্ত করে। যতই নিরাপত্তার কথা বলা হোক, মেয়েদের নিরাপত্তা কোথাও নেই। ধর্ম, সংস্কৃতি, রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার কোথাও কোনও মেয়েরই একবিন্দু নিরাপত্তা নেই।
মেয়েরা খুব ভালো করেই জানে যে, একবার যদি লোকে জেনে যায় বাসের মেয়েটি কোন মেয়ে ছিল, সকলে হামলে পড়ে তাকে দেখবে। ধরা না পড়া অপরাধীরাও দ্বিতীয়বার তাদের যৌনবস্তুটিকে দেখে নেবে। পাড়ার যৌন হেনস্থাকারীরা তাকে দেখিয়ে দেখিয়ে বলবে, ‘ওই যে দেখ, ইভ টিজিংএর শিকার যায়।’ চেনা অচেনা প্রত্যেকে মুখে অথবা মনে মনে বলবে, বলবেই, ‘বাসে বা রাস্তায় তো আরও মেয়ে ছিল, ওসব মেয়েদের পেছনে তো ছেলেরা লাগলো না, ওর পেছনে লাগলো কেন? নিশ্চয়ই ওর দোষ ছিল কোনও!’
মেয়েটি হেনস্থা হওয়ার হেনস্থা থেকে বাঁচতে চায় বলে মুখ দেখাচ্ছে না। হেনস্থাকারীর দিকে জগন্নাথ আর শুভেন্দুর অমন মারমুখো এগিয়ে যাওয়ার বোকামো নিয়ে নিশ্চয়ই সে আফশোস করছে। মেয়ে হয়ে জন্মেছে বলে যে এভাবেই ঘরে বাইরে, বাসে, ট্রেনে, অটোয়, মাঠে ঘাটে হাটে অপমান সয়ে বাকি জীবন পার করতে হবে তা সে জানে। কেবল ‘অপমানিত হয়েছি’ এ কথা রাষ্ট্র করে নিজেকে দ্বিতীয়বার অপমান করার সুযোগটি সে দিতে চায় না। ডবল ট্রিপল অপমান থেকে নিজেদের বাঁচানোটাই মেয়েদের অত্যন্ত যুক্তিবুদ্ধি খাটিয়ে নিজেদের বাঁচানো।
এত যে সাহসী বলা হয় আমাকে, এই আমিও যদি ওই মেয়েটির জায়গায় হতাম, এই অশিক্ষিত নারীবিদ্বেষী সমাজের লোককে আমিও জানাতাম না, যে, বাসের মেয়েটি আমি ছিলাম।
৪৩. নামে অনেক কিছু আসে যায়
উঁচু পদগুলো পুরুষের জন্য তৈরি, তাই পদগুলোয় ‘পতি’র বাড়াবাড়ি। ভূপতি, রাষ্ট্রপতি, সভাপতি, দলপতি। পত্নীদের তো ঘরবন্দি রাখা হত এবং হয়, পত্নীদের তো শিক্ষিত হতে দেওয়া হত না এবং এখনও হয় না। এখন লিঙ্গ বৈষম্যের প্রকটতাকে একটু হালকা করার জন্য, সংরক্ষণ বা ওই জাতীয় কিছুর কারণে, দিব্যি লেখাপড়া শিখে ‘কানে কলম গুঁজে আপিস যেতে থাকা গিন্নিদের’ (নারীশিক্ষার বিরুদ্ধে বাংলার শিক্ষিত পুরুষদের অনেক ব্যঙ্গোক্তির একটি), হঠাৎ করে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয় এমন এমন সব পদের সামনে, যে পদগুলোয় তাদের পা বাড়ানোর অধিকার নেই। প্রেসিডেন্ট পদে ‘আনটাচেবল’ হল, ‘মাইনরিটি মুসলিম’ হল, এখন ওদের সঙ্গে এক কাতারে দাঁড়িয়ে থাকা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক, অন্য অর্থে ‘সর্বোৎকৃষ্ট আনটাচেবল’ আর মাইনরিটি অর্থাৎ নারীকে ওই পদে বসিয়ে দিলে ভারত নামক রাষ্ট্রটির উদারনীতি নিয়ে বিশ্বে নাম ফাটবে। রাষ্ট্রের ‘পতি’ হতে যাবেন একজন নারী। পতি তো পুরুষ, পুরুষের জন্য তৈরি করা পদটিতে কেন নারী আসীন হবেন? পুরুষের জন্য ‘পদ’ তৈরি করা হয়ে গেছে, এখন নারী সেই পদের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন বলে পদটির নাম বদলে যাবে, এ কথা না মানার লোক প্রচুর। এর মধ্যে বুদ্ধিজীবী আছেন, ‘বাঘা বাঘা নারীবাদী’ও আছেন। আমার মতে, উঁচু পদগুলো অধিকার করার অধিকার যে কেবল পুরুষের নয়, তা যে নারীরও, সে কথা পদ তৈরি করার সময় কোনও পুরুষেরই মাথায় আসেনি, আসেনি বলে আজ তার প্রায়শ্চিত্য হোক। ‘পতি’ পদের অবলুপ্তি হোক, নয়তো নারী-পদ অর্থাৎ লিঙ্গ-নির্দিষ্ট পদ তৈরি হোক। সবচেয়ে ভালো নয় কি নারী পুরুষ উভয়ের জন্য পদ অর্থাৎ লিঙ্গ-নিরপেক্ষ পদ রচিত হওয়া? অনেকে সেটায় রাজি নন, পুরুষপদটিই যেমন আছে, তেমন রেখে দিতে চান, ‘তা নাহলে স্ট্যাম্প-প্যাড ইত্যাদি পাল্টাতে হবে, খুব ‘প্র্যাকটিক্যাল’ নয় নাকি ব্যাপারটা। পুরোনো জিনিস দিয়ে চালিয়ে নিলে ‘প্র্যাকটিক্যাল’ হয়। পুরুষের পদটা অ্যকসিডেন্টালি অধিকার করেছে নারী, এমন তো আর সচরাচর ঘটবে না, সুতরাং পদটি যে নামে আছে, সে নামেই থাকুক।’ ব্যয় সাপেক্ষ, বাড়তি ঝামেলা এসব যুক্তি দেখিয়ে পুরুষের নামেই পদটি বহাল থাকুক, তা পুরুষবাদী নারী পুরুষ সকলেরই মনের কথা।