‘মেয়েরা মেয়েদের শত্রু’, এই বাক্যটি পুরুষের তৈরি, এবং একে জনপ্রিয় করার পেছনে পুরুষের আছে বিরাট অবদান। পুরুষ কি পুরুষের শত্রু নয়? হিসেব যদি হয় কে কার শত্রু বেশি, মেয়েরা মেয়েদের যত, তার চেয়ে শতগুণ পুরুষেরা পুরুষদের। এক মেয়ে যখন আরেক মেয়ের বিরুদ্ধে কিছু বলে, পুরুষেরা খুশি হয়। সেই মেয়েটিকে খুব বিচক্ষণ এবং বুদ্ধিমতী বলে মনে করে। কোনও মেয়ের স্বল্প পোশাক, তার ছেলেবন্ধু, তার পুরুষগমন ইত্যাদি নিয়ে নিন্দা যখন মেয়েরা করে, পুরুষেরা আনন্দ পায়। কারণ এ তাদেরই কথা, মেয়েদের মুখ দিয়ে বলতে শোনে এই যা। মেয়েগুলো তাদেরই মানসিকতা নিয়ে বড় হতে থাকা, তাদেরই কপি। কিন্তু ফিমেইল কপি। ফিমেইল বলে আনন্দ বেশি হয়। অন্য কোনও পুরুষ যদি মেয়ের নিন্দা করে, তাতে আনন্দ এত বেশি হয় না। ফিমেইল বলে যে আনন্দ, সেটা অনেকটা যৌনানন্দের মতো।
‘বাড়ির পরিচারিকারা পুরুষের চেয়ে নারী দ্বারা অত্যাচারিত হয় বেশি’ — বেশ জনপ্রিয় একটি অভিযোগ, পুরুষেরা যখন অত্যাচার করে পরিচারিকাদের, তা নিয়ে তত কথা হয় না, নারী হলেই ছি ছি ছ্যাঁ ছ্যাঁ। নারী তো নিয়ন্ত্রিত। নারীর নিয়ন্ত্রণ করার বেশি কিছু নেই। তাই তার নিচে যে আছে, যে পরিচারিকা তাকেই সে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। এতে পরিতৃপ্তি কিছুটা হলেও পায়। কিছুটা হলেও তার উচ্চতাকে সে অনুভব করতে পারে। পরিচারিকার জায়গায় পরিচারক হলেও ওই একই ব্যাপার ঘটে। স্বামীর ধর্ষনেচ্ছা যদি পরিচারিকাকে দেখে জাগে, তবে স্ত্রী পরিচারিকাকেই অত্যাচার করে, স্বামীকে নয়। এখানেও সবলকে না পিটিয়ে দুর্বলকে পিটিয়ে যন্ত্রণা লাঘব করতে হয় নারীদের। সবলকে পেটানোর শক্তি এখনও তারা অর্জন করেনি।
নারীকে লজ্জাবতী মায়াবতী, করুণাময়ী স্নেহময়ী ইত্যাদি বিশেষণ এতকাল ধরে এত দেওয়া হচ্ছে যে, লোকে ভুলে যায় নারী রক্তমাংসের মানুষ, পুরুষের মতো অত যুদ্ধবাজ, হিংসুক, প্রতিশোধপরায়ণ, সংকীর্ণমনা, বদ, বদমাশ, নিষ্ঠুর, নির্মম, ভয়ংকর, হিংস্র, নীচ, অশ্লীল, কুটিল না হতে পারলেও নারী কিছুটা তো হতে পারে। নারী তো মানুষ! পুরুষের সঙ্গে এতকাল থেকে কিছুই কি শেখেনি! বাসে যেভাবে দুটাকার পকেটমারকে পুরুষেরা পিটিয়ে লাশ বানায়, তেমন ভাবে নারীরা পেটাতে না পারলেও, একেবারেই যে কাউকে পারেনা পেটাতে, তা ভাবার কোনও কারণ নেই।
নারীর নিষ্ঠুরতা দেখে কেন লোকে শংকিত হয়! যেহেতু নারীর কাছ থেকে আশা করা হয় যা প্রচার হয় তা, যে, নারী মাত্রই মমতাময়ী! যেহেতু এই ধারণা মস্তিষ্কে গাঁথা, তাই নিষ্ঠুরতা আগাগোড়া অপ্রত্যাশিত। তাই পুরুষের নিষ্ঠুরতা সইতে পারলেও নারীর নিষ্ঠুরতা অসম্ভব সওয়া!
নারীর স্বাধীনতা এবং সমানাধিকারের জন্য যে সংগ্রাম, তা একটি আদর্শের জন্য সংগ্রাম। এই আদর্শে নারী বিশ্বাসী হতে পারে, পুরুষেরা অবিশ্বাসী হতে পারে। আবার এর উল্টোও হয়। নারী এই আদর্শে বিশ্বাস একেবারেই করে না, কিন্তু পুরুষেরা করে। (পুরুষেরা যারা নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে, তাদের সংখ্যাটা নিতান্তই কম, বিশ্বাসী হলেও স্বাধীনতার সংগ্রামে সক্তিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে ইচ্ছুকের সংখ্যা আরও কম।) বিষয়টি নারী সম্পর্কিত হলেও এ কখনই লিঙ্গের ব্যাপার নয়, এ আদর্শের ব্যাপার। সুতরাং আমার নারী-অধিকার বিষয়ক লেখাগুলো যদি সব নারীর পছন্দ না হয়, তবে তো বিস্ময়ের কিছু নেই। এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এত আহম্মক নয় যে সব নারীকে নারীর স্বাধীনতা বিষয়ে সচেতন করে তুলবে এবং তাদের স্বাধীনতার কথা উচ্চারণ করা মাত্র নারীরা হাত তুলে সমর্থন জানাবে। পরাধীন হয়ে থাকতে থাকতে বেশির ভাগ নারীই পরাধীনতাকে আশ্রয় বলে মনে করে, পরাধীনতার লোহার দেওয়ালের ফুটো গলে যে আলোটুকু আসে, ওটুকুই রোত্রুর তাদের, ওটুকুই স্বাধীনতা। ওটুকুতেই তৃপ্ত তারা।
আমি মেয়েদের সম্পূর্ণ স্বাধীনতার কথা বলি, এটা অনেক মেয়ের কাছে বাড়াবাড়ি বলে মনে হয়। অনেকসময় মেয়েদের স্বাধীনতা বিষয়ে আমি যা বলি, তা মেয়েরা যত বোঝে, তার চেয়ে বেশি পুরুষেরা বোঝে। বোঝে, কারণ, স্বাধীনতা ভোগ করে পুরুষ অভ্যস্ত, স্বাধীনতার অর্থ তারা তাই জানে। পুরুষেরা আমার লেখার বিরুদ্ধে বলে, কারণ তারা ঠিক জানে আমি কী বলতে চাইছি। নারীরা আমার লেখার বিরুদ্ধাচরণ করে, করে, কারণ তারা ঠিক জানে না আমি কী বলতে চাইছি। দুজনের বিরোধীতার ভাষাটা এক, কারণটা ভিন্ন।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী ভিকটিম। এ কথা যেমন ঠিক, নারী আত্মঘাতী এটাও ঠিক। আজ যদি নারীরা নিজেদের অধিকারের ব্যাপারে সচেতন হতো, আত্মপরিচয়ের সংকটমোচনে নিজেরা বিচ্ছিন্ন না থেকে সংগঠিত হতো, নারীর সঙ্গে নারীর যোগাযোগ যদি আরও বেশি হত, পরস্পরের প্রতি সহানুভূতি এবং শ্রদ্ধা যদি বাড়তো, যদি তারা আন্তরিকভাবে পরস্পরের হাতে সহযোগিতার হাত রাখতো, নারীর ক্ষমতায়নে এক নারী আরেক নারীর পাশে দাঁড়াতো, তবে চিড় ধরতো অথবা চুর চুর করে ভেঙে পড়তো পুরুষতন্ত্র। বাসযোগ্য হত জগৎ।
৪১. পুরুষের স্ত্রী বা প্রেমিকা হওয়া ছাড়া মেয়েদের আর কোনও ভূমিকা নেই
দুটো বাংলা ছবি নিয়ে হৈ চৈ শহরে। চারদিকে বিজ্ঞাপন। লেখালেখি। পরিচালক এবং অভিনেতাদের সাক্ষাৎকার। বাংলা ছবিতে প্রচুর ইংরেজি সংলাপ দিয়ে বোঝানো হয়েছে যে ছবিগুলো শিক্ষিত এবং সচেতন শ্রেণীর জন্য, আধুনিক মনের মানুষদের, এবং নতুন প্রজন্মের নতুন দৃষ্টিভঙ্গির ছেলেমেয়েদের, যারা এক বাক্য বাংলা বললে পাঁচ বাক্য ইংরেজি বলে। উচ্চবিত্ত হলে অবশ্য বাংলা উচ্চারণ খুব বিচ্ছিরি রকম হওয়া চাই। অস্বীকার করার উপায় নেই নাগরিক নবীন নবীনাদের চাল চলন চেহারা এমনই। অনুরণনে রাহুল আর অমিতের তাই হয়েছে। রাহুল আর অমিত, অনুরণনের দুটো পুরুষই যার যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত, একজন স্থপতি, আরেকজন ব্যবসায়ী। আর তাদের বউ, ভীষণ স্মার্ট, শিক্ষিত। কী করছে? না, ‘হাউজওয়াইফ’। পরনির্ভর। কাজ বলতে সেজেগুজে থাকা, সুন্দর সুন্দর পোশাক পরা, স্বামীর সঙ্গেী হওয়া, আর ফালতু ঘুরে বেড়ানো।