তাপসীর ধর্ষক এবং খুনী যেদিন ধরা পড়লো এবং মানুষ জানলো তাপসী আসলে আত্মহত্যা করেনি, তাকে ধর্ষণই করা হয়েছিল, ধর্ষণের পর খুন — সেদিন এই শহরের গণ্যমান্য এক পুরুষ নাক সিঁটকে ঠোঁট উল্টে বললো, ‘ছি ছি, তাপসী একটা জিনিস হল ধর্ষণ করার? আমাকে সাতশ কোটি টাকা দিলেও তো ওটাকে ধর্ষণ করতে পারতাম না, ওকে দেখলে কি উজ্ঞেজিত হওয়া যায়? ছি!’ এই মন্তব্য শুনে আমি ভাবছিলাম এ কি বিখ্যাত ওই পুরুষটিরই মনের কথা, নাকি আরও পুরুষেরও মনের কথা এটি! আমার বিশ্বাস আরও পুরুষের।
কোনও মেয়ে ধর্ষিতা হয়েছে, এবং খুন হয়েছে, এই মর্মান্তিক দুঃসংবাদটি নিয়ে দুঃখ করার বদলে পুরুষেরা মনে মনে মেয়েটির ধর্ষকের স্থানে নিজেকে বসিয়ে ধর্ষণটা উপভোগ করে তারপর ভোগ করে খুনটা। ভেতরে ভোগটা সারা হয়ে যায় বলে ধর্ষণ নিয়ে যে আহা আহাটা পুরুষেরা করে, তাতে অকৃঙ্গিমতা থাকে না। থাকলে ধর্ষণ ঘটতো না এত।
অধিকাংশ ধর্ষণের খবর চাপা পড়ে থাকে। গোপন রাখা হয়। নথিভুক্ত হয় না শতকরা সঙ্গেরটি ধর্ষণের খবর। সরকারি হিসেবে, ভারতে প্রতি ঘন্টায় একজন মেয়ে ধর্ষিতা হয়।
কেন ধর্ষণ করে পুরুষেরা? গায়ের জোর আছে বলে করে, সবচেয়ে বড় জোর পুরুষ হওয়ার জোর। ধর্ষণকে আদিকাল থেকে অপরাধ বলে মানা হয়নি। এখন এটি আইনের চোখে অপরাধ। কিন্তু সমাজের চোখে নয়। সমাজের চোখে এটিকে অপরাধ বলে মানা হয় না বলে ধর্ষকদের ঘুরে বেড়ালেও চলে কিন্তু ধর্ষিতাকে মুখ লুকোতে হয়। ধর্ষণ নিয়ে ধর্ষকরা লজ্জা পাবে না, পাবে ধর্ষিতারা, এটাই সামাজিক বিধান। বিধান বলেই বেশির ভাগ ধর্ষিতা আদালতে যায় না, বেশির ভাগ ধর্ষিতাকে কোনও পুরুষই, এমনকী ধর্ষক-পুরুষও বিয়ে করতে রাজি হয় না। ধর্ষিতারা সমাজে ব্রাত্য। ধর্ষকরা নয়। অত্যাচারিতের পক্ষে থাকে না লোক, থাকে অত্যাচারীর পক্ষে। এ সমাজে অত্যাচারীদের সঙ্গে কে্ষমতার একটা অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক আছে। ক্ষমতার প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার এবং ক্ষমতার বশ হওয়ার ঐতিহ্য আজও ভীষণ রকম জীবন্ত।
তাপসীকে যে পুরুষেরা ধর্ষণ করেছে, এবং ধর্ষণের ছক যারা তৈরি করেছে, তাদের খুঁজে বার করা হচ্ছে। কোনও রাজনৈতিক দল বা ক্ষমতাবান দল সিবিআইএর তদন্তের দাবি যদি না তুলতো? কিছুই হত না। কেউই ধরা পড়তো না। ধনঞ্জয়ের বিচারের দাবিতে পথে যদি না নামতো ক্ষমতাবানরা? কিছু কি হত? এই কর্ষক-বর্ষক-ধর্ষকপ্রধান সমাজে নারীরা নীরব দর্শক ছাড়া আর কিছু নয়। পুরুষেরা পুরুষবলে নারীজমি কর্ষণ ক’রে বীর্য বর্ষণ ক’রে ধর্ষণ ক’রে পৌরুষ ফলায়।
লোকেরা ধর্ষিতার জন্য যতটা, তার চেয়ে বেশি নিজেদের স্বার্থে ধর্ষিতার পক্ষে দাঁড়ায়। সে ক্ষেত্রে ধর্ষিতা বেঁচে না থেকে খুন হলে তাদের দাবি দাওয়ার জন্য বিস্তর সুবিধে হয়। যে ধর্ষিতা খুন হয়নি তার পক্ষে কি কোনও রাজনৈতিক দল স্বতস্ফূর্তভাবে মিছিল করে? এক মৃত্যূ দিয়েই হয়তো ধর্ষণের বিচার পাওয়া সম্ভব, তাও সব ক্ষেত্রে নয়, কিছু কিছু ক্ষেত্রে যে ক্ষেত্রগুলোতে ক্ষমতা বা রাজনীতির কোনও যোগ আছে।
তাপসী হতদরিদ্র একটা মেয়ে। তাকে যে কেউ ধর্ষণ করে পুড়িয়ে মারতে পারতো। এতে কার কী বলার আছে? যেরকম বলা হয়েছিল যে তাপসী কেরোসিনের একটা জার হাতে বাইরে গিয়েছিল ভোরবেলা, ওরকমই হত বলা, বলা হত গায়ে কেরোসিন ঢেলে সে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। তাপসীর আত্মীয়রাও তাই বিশ্বাস করতো, পাড়ার লোকেরাও। মানুষ এরকমই জানতো যে অভাবে অসুখে ভুগতে ভুগতে নিজের গায়ে নিজে আগুন দিয়ে মরেছে তাপসী, যেমন মরে দেশের শত শত তাপসী।
আজ তাপসীকে নিয়ে যে কাণ্ড হচ্ছে তাতে তাপসী নামের হতদরিদ্র মেয়েটি কিন্তু মূল্যবান কিছু নয়। কদিন পরে লোকে ভুলেও যাবে তাপসী কে ছিল কী ছিল। বিখ্যাত সেই পুরুষটির মতো কেউ কেউ হয়তো মনে রাখবে তাপসী দেখতে কুৎসিত ছিল, ওকে ধর্ষণের ইচ্ছেও জাগে না এমন কুৎসিত।
পুরুষদের প্রেম যেন জাগে, এমন সৌন্দর্য মেয়েদের ধারণ করা জরুরি। পুরুষদের ধর্ষনেচ্ছা যেন জাগে, পুরুষেরা চায়, এমন সৌন্দর্যও মেয়েদের যেন থাকে। না থাকলে রক্ষে নেই। মরে গেলেও শ্লেষ বিদ্রুপ থেকে রেহাই পাবে না কোনও মেয়ে। তাপসীও পাচ্ছে না। তাপসী সম্ভবত মরে বেঁচেছে। অন্তত মরেছে বলে কারও যদি তার জন্য করুণা হয়! না মরে কেবল ধর্ষিতা হলে লোকে বলতো, ধর্ষক-দেবুকে তাপসীই ইন্ধন জুগিয়েছিল ধর্ষণ করতে। প্রাতঃক্তিয়া করতে বসেছিল বলেই তো দেবু উজ্ঞেজিত হয়েছে। তাপসী সেটা না করলেই তো তাকে ধর্ষিতা হতে হয় না!
হতদরিদ্র মেয়ের ধর্ষিতা হলেই কী, না হলেই কী! তারা তো প্রতিদিনই কোনওনা-কোনওভাবে ধর্ষিতা হচ্ছে, প্রতিদিনই নিহত হচ্ছে বৈষম্য-লালন করা সমাজের নানা নিয়মে। ধর্ষিতা না হলে, তাকে জ্যান্ত না পোড়ানো হলে কী এমন উত্ত্বল ভবিষ্যত ছিল তার সামনে? হয়তো দেবু মালিকের মতোই কারও সঙ্গে তার বিয়ে হত, অমানুষিক অত্যাচার সইতে হত জীবনভর। অথবা তাকে বিক্রি করে দেওয়া হত, নারী পাচারের শিকার হত, কোনও বেশ্যালয়ের অন্ধকার খুপড়িতে বাকি জীবন পার করতে হত তার। এ ছাড়া আছে কী গ্রামের অসহায় দরিদ্র একটি মেয়ের ভাগ্যে? এই পশ্চিমবজ্ঞেই তো পাচারের শিকার মেয়েরা এমনভাবে হচ্ছে যে অনেক গ্রামেই আর মেয়ে নেই। চাকরি বা বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে গ্রাম উজাড় করে মেয়েদের ধরে ধরে দেশের নানা বেশ্যালয়ে নিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে। ওখানে তো প্রতিদিনই মেয়েদের ধর্ষিতা হতে হয়, জ্যান্ত পুড়ে মরার চেয়ে কিছু কম যন্ত্রণা মেয়েরা ভোগ করে!