এই মামলা করে মেয়েদের অর্থকড়ি জোটে না, বা কোনও অর্থেই লাভজনক কিছু নয় এটি, মামলা করলে পুরুষদের নয়, উল্টে মেয়েদেরই সামাজিকভাবে একঘরে করা হয়, তাদের সঙ্গে ভবিষ্যতে সম্পর্ক স্থাপনে পুরুষেরা উদ্যোগি হয় না, এত সব ঝুঁকি নিয়েও যখন একটি মেয়ে মামলা করে, আর কোনও উপায় থাকে না বলেই করে। এই মামলা করে মেয়েরা মূলত নিজের প্রাণ বাঁচায়, নিজের মান সম্মান বাঁচায়। প্রতিদিনের অসহ্য অপমান থেকে, অকথ্য অবত্তা থেকে, মর্মান্তিক মৃত্যু থেকে নিজেকে বাঁচায়। আত্মবিশ্বাস এবং আত্মসম্মান থাকলে মার খেয়ে বাঁচতে চায় না কেউ। বিশেষ করে তার মার, যার কি না জীবনের সবচেয়ে বড় বন্ধু, সবচেয়ে বড় সহমর্মী হওয়ার কথা।
পুরুষেরা বধূ নির্যাতন আইনটির বিরোধী। কারণ স্ত্রীর সঙ্গে যথেচ্ছাচার করায় এখন বাধ সাধছে এই আইন। স্ত্রী হচ্ছে নিজের অধিকৃত জিনিস, নিজের এই জিনিসটিকে যদি লাথি গুঁতো দিয়ে, চড় থাপ্পড় দিয়ে, কিল ঘুষি দিয়ে বশে রাখা না যায়, তবে আর কাকে যাবে! সঙ্গেমে রাজি না হলে ধর্ষণ করা যদি না যায় তবে কোথায় যাবে পৌরুষ! পুরুষের পৌরুষে ঘা মেরেছে এই আইন। তাই তারা চায় গ্রামের দরিদ্র অশিক্ষিত নির্যাতিত মেয়ের মতো শহুরে শিক্ষিত মেয়েরাও হোক। মুখ বুজে পিঠ পেতে সব অনাচার সইতে শিখুক। না সইলে রাগ হয় পুরুষদের। গা বড্ড জ্বলে।
পুরুষেরা চায় না মেয়েরা তাদের অধিকারের ব্যাপারে সচেতন হোক। মেয়েরা স্বাধীনতার অর্থ বুঝুক। মেয়েদের কোনও আত্মসম্মানবোধ থাকুক। তাই কায়দা করে আইনের অপপ্রয়োগ হয় এই অভিযোগ করে ইনিয়ে বিনিয়ে আইনের বিরুদ্ধেই কথা বলছে।
এ নতুন নয়। পৃথিবীর সব দেশেই নারীর ওপর পুরুষের অন্যায় অনাচারের বিরুদ্ধে যখনই কোনও আইন প্রণয়ন হয়েছে, এভাবেই নারীঅধিকার বিরোধী পুরুষেরা রাগ করেছে, ফুঁসে উঠেছে, চেঁচিয়েছে। এবং এদের মধ্যে সবধরনের লোক ছিল, বরং চাষাভুষোর চেয়ে শহরের তথাকথিত শিক্ষিত পুরুষের সংখ্যা ছিল বেশি। যখনই কোনও মেয়ে মার খেতে খেতে কুঁজো হয়ে থাকা পিঠটাকে সোজা করে, মাথাটাকে উঁচু করে, আর মার খাবে না বলে পণ করে, তখনই পুরুষেরা সেই মেয়ের দিকে আঙুল তুলে বলে মেয়ে বাজে, মেয়ে খারাপ। এ নতুন নয়। সব দেশে সব সমাজেই এমন ঘটেছে। ঘটে।
দুই তৃতীয়াংশ বিবাহিত মেয়ে এই ভারতবর্ষে নির্যাতিত হচ্ছে স্বামী দ্বারা। যেদিন প্রতিটি নির্যাতিত মেয়েই অর্থাৎ দুই তৃতীয়াংশ মেয়েই বধূ নির্যাতন মামলায় অত্যাচারী স্বামীদের জেলে ভরবে, সেদিনই বুঝবো মেয়েরা এই ভারতবর্ষে সামান্য হলেও সচেতন হয়েছে, সামান্য হলেও আত্মসম্মানবোধ তাদের আছে। যেদিন তাদের ভয় ঘুচে যাবে, দ্বিধা দূর হবে, সেদিন বুঝবো মেয়েরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার যোগ্যতা অর্জন করেছে। আত্মসম্মানবোধ থাকলে নিজের পায়ে দাঁড়াবার উপায় কিছু না কিছু বেরোয়।
আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয়, স্বামী দ্বারা মেয়েরা যত অত্যাচারিত হয়, যত লাঙ্গিত হয়, যত অপমানিত হয়, তত আর কারও দ্বারা হয় না। ভুলে যাওয়া উচিত নয়, মেয়েদের হত্যাকারী অন্য কেউ তত হয় না, যত হয় স্বামী। ভুলে যাওয়া উচিত নয়, মেয়েরা সবচেয়ে বেশি যার কারণে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়, সে হল স্বামী।
৩৯. যদি এর পেছনে রাজনীতি না থাকতো?
একটা পনেরো বছর বয়সী মেয়েকে পুরুষেরা ধর্ষণ করে জ্যান্ত পুড়িয়ে দিয়েছে। এই হল ঘটনা। ঘটনাটি সকলে জানে। জানে কারণ ঘটনার পেছনে রাজনীতি আছে, এবং রাজনীতির লোক আছে। তদন্তের পর অভিযুক্ত ধর্ষক এবং খুনীকে গ্রেফতার করা হয়েছে, এ খবর পত্রিকার প্রথম পাতায়, টেলিভিশনগুলোর ব্রেকিং নিউজে। কাকে কাকে ধরা হচ্ছে, কে তারা, কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত এসব নিয়ে হৈচৈ হচ্ছে চারদিকে।
আমি শুধু ভাবছি, এই তাপসী মালিক নামের মেয়েটির ধর্ষণ এবং হত্যাকাজ্ঞের সঙ্গে যদি রাজনীতি জড়িয়ে না থাকতো, যদি রাজনীতির কোনও লোক এর পেছনে না থাকতো! তবে কি এই হৈচৈটা হত? সিবিআই তদন্ত হত? কেউ ধরা পড়তো?
তাপসী মালিক অত্যন্ত দরিদ্র ঘরের দরিদ্র মেয়ে। তার মতো দরিদ্র আরও লক্ষ মেয়ে এই রাজ্যেই আছে। তারা কী খাচ্ছে, কী পরছে, তাদের কোনও জমি আছে কি নেই, তাদের দুপয়সা উপার্জন আছে কি নেই, তার খবর কে রাখে! তারা লাথি ঝাঁটা কেমন খাচ্ছে, কে তাদের অপমান করছে, অসম্মান করছে, কে তাদের দিনে দুপুরে, বা রাতে রাতে ধর্ষণ করছে, কোনওদিন কেউ জানতেও চায় না। ঘরে ঘরে তাপসী মালিকের মতো লক্ষ মেয়ে গুমরে কাঁদে।
ভেবে নেওয়ার কোনও কারণ নেই এ দেশে মেয়েরা অধর্ষিত অবস্থায় জীবন যাপন করে। ভেবে নেওয়ার কোনও কারণ নেই যে এদেশে এবং এ রাজ্যে নারী তার সর্বময় অধিকার এমন ভোগ করে যে, হঠাৎ কোথাও কোনও ধর্ষণ জনিত দুর্ঘটনা ঘটলে তুলকালাম কাণ্ড বেধে যায়।
তাপসী মালিকের হত্যাকাজ্ঞের পেছনে এবং হত্যাকাজ্ঞের বিচার চাওয়ার পেছনে রাজনৈতিক দুটো দল যদি জড়িত না থাকতো এবং তারা যদি একে অপরের বিরোধী না হত তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই ধর্ষণ এবং হত্যা প্রতিদিনের নারী-ধর্ষণ এবং হত্যার মতো তুচ্ছাতিতুচ্ছ খবর অথবা অখবর হয়ে পড়ে থাকতো। ভারতবর্ষে বিপুল সংখ্যক নারী বিক্রি হচ্ছে, পাচার হচ্ছে, প্রতারিত হচ্ছে, প্রতিদিনই বাধ্য হচ্ছে বেশ্যাবৃঙ্গিতে নামতে। ভারতবর্ষে বিরাট সংখ্যার নারী ধর্ষণ, হত্যা এবং আত্মহত্যার শিকার হচ্ছে, প্রতিদিন। অযুত নিযুত নারী অনাহার, অনাচার, অবিচার, অশিক্ষা আর অস্বাস্থ্যের শিকার। এবং এগুলোকে দেশের প্রধান অথবা গুরুত্বপূর্ণ কোনও সমস্যা বলে কেউ মনে করে না। ক্ষমতাবান পুরুষেরা সে রাজনীতির ভেতরের হোক, বাইরের হোক, নারী সম্পর্কে একটি রাজনৈতিক ছক সযত্নে লালন করে, তা হল, পুরুষ হচ্ছে রাজার জাত আর নারী প্রজার জাত, যে সে প্রজা নয়, একটু নিম্ন জাতের প্রজা।