পুরুষেরা যারা কৃষক, যারা শ্রমিক, ছোট চাকুরে, বড় চাকুরে, ব্যবসায়ী, উকিল, বিচারক, ডাক্তার, ইঙ্গিনিয়ার, বিত্তানী, শিল্পপতি, শিল্পী, সাহিত্যিক বা অন্য কিছু, ধনী হোক, দরিদ্র হোক, শিক্ষিত হোক, অশিক্ষিত হোক — দেখা যায় তারা নারী নির্যাতনে প্রায় একইরকম সিদ্ধহস্ত। ধন যাদের যেরকমই থাকুক, এক সমাজেই তাদের বাস, সে সমাজটা পুরুষতান্ত্রিক। পুরুষের নিয়মে, পুরুষের আধিপত্যে, পুরুষের বংশবৃদ্ধিতে যে সমাজটা চলে। শিক্ষিতরা নির্যাতন কিছু কম করে না। শিক্ষিত হলেই নারীকে মানুষ হিসেবে মর্যাদা দেবে, ভাবাটা ঠিক নয়। প্রচলিত যে শিক্ষা, ইস্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যে শিক্ষাটা পাচ্ছে ছেলেমেয়েরা, তার সঙ্গে পুরুষতন্ত্রের কোনও বিরোধ নেই। পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে কোনও বাক্য আমাদের ইস্কুলের ছেলেমেয়েরা পড়ে না কোনও বইয়ে। পাঠ্যপুস্তকে নারীর সমানাধিকারের পক্ষে কোনও জ্ঞান বিতরণের ব্যবস্থা নেই। প্রচলিত এই শিক্ষা শিক্ষার্থীদের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা নিয়ে বড় হতে সবরকম সহযোগিতা করে। শিশুরা ঘরে বাইরে চোখ রেখে দেখে, শেখে, বোঝে, যে, নারীর স্থান গৃহে, সংসার পালনে, শিশু যত্নে, স্বামী সেবায়, এবং পুরুষের বাস বিশাল বিস্তৃত বহির্জগতে, বিদ্যায়, বিত্তানে, বৈভবে, বিপ্লবে, বিদ্রোহে, বিদ্বেষে, বিজয়ে। নারী বিদুষী হোক নিরক্ষর হোক, ধনী হোক দরিদ্র হোক, শহরে বা গ্রামে যেখানেই তার বাস হোক, পুরুষ শাসিত সমাজের নারীবিরোধী সংস্কৃতির সামনে সমান অসহায়।
এসব তথ্য কোনও মানুষের অজানা থাকার কথা নয়। বোধবুদ্ধি থাকলে কেউ এসব নিয়ে তর্ক করে না। কিন্তু কলকাতার কিছু লেখাপড়া জানা পুরুষ দেখলাম, বলছে, বধূ নির্যাতন এবং নারী নিগ্রহ আইন ভারতবর্ষের সবার জন্য মানানসই নয়। কেন নয় জিজ্ঞেস করায় খুব গম্ভীর কজ্ঞে একজন বললো, মুর্শিদাবাদের গ্রামের কোনও মেয়ের জন্য যে আইন খাটে, গড়িয়াহাটের বহুতল ফ্ল্যাটের মেয়ের জন্য সে আইন খাটে না। কেন খাটে না জানতে চাইলে যা বললো তা হল, যেভাবে গ্রামের অশিক্ষিত মেয়েদের ওপর অত্যাচার হয়, সে রকম অত্যাচার তো শহরের শিক্ষিত মেয়েদের ওপর হয় না। গ্রামের মেয়েদের মেরে আধমরা করে ফেলে রাখলেও কই ওরা তো মামলা করতে যাচ্ছে না, কিন্তু শহুরে শিক্ষিত মেয়েরা সামান্য মার খেলেই ফোর নাইনটি এইট দেখিয়ে দেয়। হাঁ হয়ে রইলাম অনেকক্ষণ। আমার ওই বিস্ময়ের ঘোর কাটার আগেই গড়গড় করে বলে গেল, মেয়েরা খুব অপপ্রয়োগ করছে এই আইনের। এই আইন পুরুষবিরোধী আইন। মার খেলে মেয়েরা থানায় ডায়রি করতে পারে। কিন্তু ফোর নাইনটি এইট কেন? অনেক নিরপরাধ পুরুষকে এই আইন ব্যবহার করে হয়রানি করা হচ্ছে। শহরের লোকেরা এখন কাহিনী বুঝে গেছে। তাইতো ব্যাকল্যাশ হচ্ছে। রাগে পুরুষগুলোর চোখ জ্বলছিল। মেয়েদের প্রতি ঘৃণা ঠিকরে বেরোচ্ছিল ভেতর থেকে।
আমার কেবলই মনে পড়ছিল সরকারি সমীক্ষার কথা, ভারতবর্ষের দুই তৃতীয়াংশ বিবাহিত মেয়ে ডমেস্টিক ভালোলেন্স বা গৃহ নিগ্রহের শিকার। খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছিল দুই তৃতীয়াংশের ক’জন বধূনির্যাতনের মামলা করেছে? সংখ্যাটি আমার জানা নেই। কিন্তু অনুমান করতে পারি, যে, এক বা একাধিক লাখ নির্যাতিত মেয়ের মধ্যে একজন হয়তো আইনের আশ্রয় নেয়। যারা মামলা করে না তাদের নানারকম কারণ আছে মামলা না করার। কারণগুলো এই ১. জানে না বধূ নির্যাতন আইন বলে কোনও আইন আছে। ২. স্বামীর ওপর অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল। স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করলে স্বামী ভাত কাপড় দেওয়া বন্ধ করে দেবে, অথবা তাড়িয়ে দেবে। তখন কোথায় যাবে, কী খাবে, কী পরবে, এই দুশ্চিন্তা। ৩. নিজে উপার্জন করছে। কিন্তু বিচ্ছেদ ঘটলে একার উপার্জনে সচ্ছল জীবন যাপন সম্ভব নয়। ৪. মামলা করলে স্বামী মেরে হাড়গোড় ভাঙবে। প্রাণেও মারতে পারে, এই ভয়। ৫.মামলা করলে লোকে মন্দ বলবে। ৬. ডিভোর্স হলে ছেলেমেয়েগুলো কষ্ট পাবে। ৭. স্বামীর মানসিকতা যদি পাল্টায় ভবিষ্যতে, তার অপেক্ষা। ৮. ডিভোর্স হলে দুর্বিষহ জীবন যাপন করতে হবে। ডিভোর্সি মেয়েদের এই সমাজে দুর্ভোগের শেষ নেই। ৯. অন্য পুরুষের সঙ্গে বিয়ে হলে সেই পুরুষও হয়তো একই চরিত্রের হবে। তাই কী দরকার! ১০. সমাজটাই তো এমন। কত মেয়ে নির্যাতন সইছে। তারা যদি মুখ বুজে থাকতে পারে, সে পারবে না কেন! ১১. বাপের বাড়ি থেকে মামলার বদলে আপোস করতে উপদেশ দিচ্ছে। ১২. ভগবান মিলিয়ে দিয়েছেন এই জুটি, এই জুটি ভাঙা মানে ভগবানের বিরুদ্ধে গিয়ে পাপ কামানো।
মূলত এসবই অত্যাচারী স্বামীর বিরুদ্ধে বধূ নির্যাতন মামলা না করার কারণ। ভয়। দ্বিধা। দ্বিধা ভয় কাটিয়ে যে মেয়েরা এই মামলা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে পুরুষেরা যে ক্ষেপে আগুন হয়ে আছে, তা অনুমান করা কঠিন নয়।
বধূ নির্যাতন আইন মেয়েদের পক্ষের এবং পুরুষের বিপক্ষের কোনও আইন নয়। এটি অন্যায় অত্যাচার নির্যাতন ইত্যাদির বিরুদ্ধে আইন। মেয়েদের ওপর নিয়ত নির্যাতন চলছে, শারীরিকভাবে মানসিকভাবে সামাজিকভাবে এবং অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল বলে মেয়েদের মার খেতে হচ্ছে। কে তাদের সবল হওয়ার পথে বাধা ! আমরা তা জানিনা তা নয়।
সমাজের ব্যবস্থা এমন যে এই পুরুষ শাসিত সমাজে পুরুষেরা কর্তার ভূমিকায় এবং মেয়েরা দাসীর ভূমিকায়। দাসী শব্দটি শুনতে খারাপ লাগে, কিন্তু দাসী না বলে কর্ত্রী বললেও ভূমিকার কোনও হেরফের হয় না। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মেয়েদের যে স্থানে রাখা হয়েছিল আদিকাল থেকে এখনও সেই স্থানেই মেয়েরা রক্ষিত আছে। মেয়েদের স্থান পরিবর্তন হয়নি। এখনও বিয়ে হলে মেয়েরা নিজের বাড়ি বা বাপের বাড়ি থেকে স্বামী বা শ্বশুরবাড়িতে স্থানান্তরিত হয়।