গ্রামের মেয়েরা সময় সময় রুখে ওঠে, বুঝে না বুঝে বিপ্লব বাঁধিয়ে ফেলে ঠিক, কিন্তু এর মানে এই নয় যে, গ্রামে যে অশিক্ষা কুশিক্ষা ছিল, তা নেই। নারীনির্যাতন নেই। এখনও সেসবের সবই আছে। বাল্যবিবাহ, পণপ্রথা, স্ত্রীহত্যা, ধর্ষণ, খুন বহাল তবিয়তে বিরাজ করছে। তবে তলে তলে বেশ ক’বছরে বেশ বদলেও গেছে কিন্তু গ্রামের কিছু চিত্র। মেয়েরা ইস্কুলে আগের চেয়ে বেশি যাচ্ছে। ইস্কুল হয়তো ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে একটা সময়ে, কিন্তু যাওয়ার ঢেউটা নতুন। দারিদ্র্য যে একটি বড় কারণ ইস্কুলে না যাওয়ার, তা ইস্কুলের মিডডে-মিলই প্রমাণ করে। ভাত পাবে বলে ইস্কুলে পড়ুয়ার সংখ্যা বেড়ে যায়। ভাত না পেলে ভাত অন্য কোথাও থেকে যোগাড়ে লেগে যায়। অ আ ক খ দিয়ে কারুর তো ক্ষিধে দূর হয় না। মেয়েদের জন্য ঘর সংসারের কাজ করা, বিয়ে হয়ে যাওয়া ইত্যাদি কারণ ইস্কুল ছাড়ার। এই ঝামেলা যাদের নেই, তারা দেখা যায়, দিব্যি ইস্কুল শেষ করে কলেজ অবধি পড়তে যাচ্ছে। সাইকেল চালিয়ে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে, গ্রামের রাস্তাকে আলোকিত করতে করতে যাচ্ছে। শহুরে ক’জন মেয়ে সাইকেল চালায়? কলকাতায় আমি একটি মেয়েকেও এ পর্যন্ত দেখিনি।
শহরের চেয়ে গ্রামের সংখ্যাই যেহেতু বেশি, শহুরে মেয়ের তুলনায় গ্রামের মেয়েই যেহেতু অধিক, গ্রামেই তরতর করে বাড়াতে হবে নারীশিক্ষা। সই করতে পারলেই শিক্ষিত নাম দিয়ে ঢপ মেরে আসা হয়েছে বহুকাল। এবার এসব বন্ধ হোক। শিক্ষিত মানে সই করতে পারা তো নয়ই, ইতিহাস ভুগোল বিজ্ঞান পড়ে ডিগ্রি অর্জন করাও নয়, শিক্ষিত মানে নিজের অধিকার সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানলাভ করা। নারী যে কারও খেলনা নয়, পুতুল নয়, দাসী নয়, বস্তু নয়, যন্ত্র নয় — সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন হওয়াই সবচেয়ে বড় শিক্ষা।
একটি সমাজ কতটুকু উন্নত, তা ওই সমাজে নারীর উন্নতি কেমন তার ওপর নির্ভর করে। এ কথা আমি বিশ্বাস করি। গোটা জনসংখ্যার অর্ধেকই হচ্ছে নারী। এই অর্ধেক সংখ্যক মানুষ যদি অশিক্ষিত এবং পরনির্ভর থেকে যায়, যদি নির্যাতিত এবং অত্যাচারিত থেকে যায়, সমাজের জন্য যদি এই বিপুল সংখ্যার মেধা, বুদ্ধি, শিক্ত, ক্ষমতা কিছু কাজে না লাগে তবে সেই সমাজ তো পিছিয়েই থাকবে। নারী পিছিয়ে থাকলে প্রগতি পিছিয়ে থাকে। প্রগতি পিছিয়ে থাকলে সভ্যতা পিছিয়ে থাকে। ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিঃসন্দেহে আকাশ ছুঁচ্ছে। কিন্তু সে তুলনায় নারীর সার্বিক উন্নয়ন কিন্তু প্রায় পাতাল স্পর্শ করেই আছে। নারীর অধিকার, মানবাধিকার এবং সমানাধিকারের জন্য অভিন্ন দেওয়ানি বিধির ব্যবস্থা, ধর্মমুক্ত, সংস্কারমুক্ত সুস্থ জীবনের দাবি নিয়ে সংগ্রাম করার জন্য শক্তিশালী কোনও নারী আন্দোলন নেই এ দেশে। কী রকম হবে তবে সেই অর্থনৈতিক উন্নয়ন, যদি অর্ধেক জনসংখ্যাই বত্তিত থাকে নিজেদের অধিকার থেকে! সেই উন্নয়ন সত্যিকার উন্নয়ন নয়, যে উন্নয়ন নিয়ে গৌরব করা যায়। সৌদি আরব এবং সুইডেন, দুটো দেশই ধনী দেশ। তফাত কিন্তু ভয়াবহ। গণতন্ত্রে, বাক স্বাধীনতায়, মানবাধিকারে সুইডেন ১০০ পেলে সৌদি আরব পাবে ০। একটি সভ্য, অন্যটি নিশ্চিতই অসভ্য।
নারীকে কেউ স্বাধীনতা হাতে দিয়ে বলবে না ‘নাও’। নারীকে লড়াই করে নিজের স্বাধীনতা নিজেকে নিতে হবে। নারী নিজেই জানে না কী থেকে তারা বত্তিত হচ্ছে, কীভাবে হচ্ছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী তো নারীর মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে যে তারা দাসীর জাত। কী করে মুক্তি পাবে নারী! তবু আমি কান পেতে রই। কান পেতে রই দীর্ঘ দীর্ঘ কাল ধরে ঘুমিয়ে থাকা নারীর জেগে ওঠার শব্দ শুনবো বলে।
০৬. আমার গৌরব, আমি স্বেচ্ছাচারী
আকাশ ভাঙা বৃষ্টি আর বজ্রপাত। এর মধ্যেই সেদিন বেরিয়ে পড়লাম বাড়ি থেকে। কী, বৃষ্টিতে ভিজবো।
কেন ভিজবে?
ইচ্ছে করেছে।
ইচ্ছে?
হ্যাঁ ইচ্ছে।
লোকে কী ভাববে বলো!
কী ভাববে?
ভাববে মাথা খারাপ।
ভাবুক।
বৃষ্টিতে ভিজলে অসুখ করবে তো!
কী অসুখ?
সর্দি জ্বর।
করুক।
এই বয়সে এসব মানায় না।
কোন বয়সে এসব মানায়?
ষোলো সতেরো বছর বয়স হলে ঠিক হতো।
অনেকের চোখে তাও ঠিক নয়। কে বানিয়েছে কোন বয়সে কী করা উচিত কী উচিত নয়, তার লিস্ট?
সোসাইটি।
সোসাইটির জন্য আমরা, নাকি আমাদের জন্য সোসাইটি? মানুষই নিয়ম তৈরি করে। মানুষই নিয়ম ভাঙে। কোনও নিয়মই দীর্ঘকাল বিরাজ করে না।
আমাদের কথোপকথন এরপর আরও অনেক এগিয়ে শেষে স্বেচ্ছাচারে গিয়ে থেমেছে। স্বেচ্ছাচার শব্দের অর্থ যদি নিজের খেয়ালখুশিতে করা কাজ (সংসদ বাংলা অভিধান) হয় তবে অবশ্যই আমি স্বেচ্ছাচারী। একশ ভাগ। এ আমার জীবন। আমি সিদ্ধান্ত নেব আমার জীবনে আমি কী করবো না করবো। অন্যে কেন নেবে? জীবন যার যার তার তার। নিজের জীবনে কার কী করার ইচ্ছে, তা মানুষের নিজেরই জানা উচিত। যার এখনও নিজস্ব ইচ্ছে গড়ে ওঠেনি, তাকে আমি প্রাপ্তবয়স্ক বলি না। যে এখনও নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী চলে না বা চলতে ভয় পায়, তাকে আমি সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষও মনে করি না।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, কারও যদি ইচ্ছে করে কাউকে খুন করতে, তবে? কারও যদি ইচ্ছে করে কাউকে ধর্ষণ করতে, তবে? আমার ব্যক্তিগত মত, যে স্বেচ্ছাচার অন্যের ক্ষতি করে, সেই স্বেচ্ছাচারে আমি বিশ্বাসী নই। এখন ক্ষতিরও রকম ফের আছে। কেউ যদি বলে ‘তুমি ওই ধর্মের নিন্দা করতে পারো না, কারণ তোমার নিন্দা আমার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছে,’ তবে?