এ কথা এক ফোঁটা সত্য নয়। নারী পুরুষের মধ্যে যৌন তাড়নার কোনও কম- বেশি নেই। যদি থাকে, সে মেয়েদের। শরীর-বিজ্ঞান মতে মাল্টিঅরগাজম পাওয়ার মেয়েদেরই আছে। কিন্তু পুরুষদের বদমাইশি করার ইয়েটা আবার এ সমাজে বেশি। কেউ যদি জিজ্ঞেস করে ‘এই ইয়েটা আবার কী?’ খুব সোজা উত্তর, ‘সুযোগটা’। সমাজটা পুরুষ শাসিত। এই সমাজে পুরুষরা বদমাইশি করার সুযোগ পাবে না তো কি মেয়েরা পাবে? এই বদমাইশি পুরুষরা তাদের সঙ্গে করছে, যাদের সঙ্গে তাদের বাস করতে হয়, যাদের ছাড়া তাদের চলে না। এক বাড়িতে, এক অফিসে, এক পথে, এক ট্রেনে যাদের সঙ্গে চলতে হয়, তাদের সঙ্গেই করছে। এখানে আসলে পুরুষেরা কোনও ব্যক্তির সঙ্গে ইয়ার্কি করছে না, জাতটার সঙ্গে করছে। মেয়েজাতটার সঙ্গে। কারণ এই জাতটা সম্পর্কে তাদের ধারণা এই, যে, ‘এই জাতটাকে যাঁতা যায় কারণ এই জাতটা যা তা। জাতটা কলজ্ঞের ভয়ে কাঁপে আর কথায় কথায় কাঁদে। জাতটা জীবনভর মার খায়, যার মার খায় তারই গুণ গায়। জাতটা আসলে কোনও জাতের না।’
ইন্দ্রাণীকে দেখে, যেহেতু ইন্দ্রাণী মেয়ে, মেয়েদের সম্পর্কে মস্তিষ্কে যে ধারণা বাসা বেঁধে আছে তীর্থংকরের , সেটি স্বাভাবিকভাবেই সুড়সুড় করে বেরিয়ে এসেছে। বেরিয়ে যখন আসে, তখন ইন্দ্রাণী দণ্ড চৌধুরী তীর্থংকর দাস পুরকায়স্থের সহকর্মী নন, আগাগোড়া কেবলই তিনি মেয়ে। সমাজ যেরকম ভাবে, সেরকমই, ‘এক শরীর মাংস আর এক মাথা আবর্জনা।’
এই ধারণা গভীরে বলেই অত সহজে তীর্থংকর পেরেছেন ইন্দ্রাণীকে অপমান করতে। তিনি জানেন যে, অপমানের জবাব একটি পুরুষ হলে দিতে পারে, মেয়ের দেবার ক্ষমতা নেই। সুতরাং অসুবিধে কী! তাছাড়া অপমানিত পুরুষের পক্ষে মানুষ দাঁড়ায়, অপমানিত মেয়ের পক্ষে নয়। কারণ মেয়েরা অপমানিত আর পদদলিত হতে জন্মেছে বলেই সবার বিশ্বাস। মেয়েরা অপমানের শোধ নিতে চাইলে ‘শুভাকাঙ্ক্ষীরা’ চিরকালই একে বাড়াবাড়ি বলে বিবেচনা করেছে, প্রতিবাদে প্রেরণা দেওয়ার বদলে পিছিয়ে থাকতে বলেছে। মেয়েদের নাকি মানায় না গলা চড়ানো, চোখ রাঙানো, তেজ দেখানো। বাহ, পুরুষের জন্য এর চেয়ে চমৎকার ব্যবস্থা আর কীই বা হতে পারে। এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ পুরুষকে ইন্ধন জোগায় নির্বিঘ্নে নিশ্চিন্তে মেয়েদের যৌন হেনস্থা করে যেতে।
মেয়েদের বিচক্ষণতা, দক্ষতা, মেধা, প্রতিভা—এসবের আজও কোনও দাম নেই। একটি মেয়ে মালি হলেও মেয়ে, মালিক হলেও মেয়ে। সুপার থেকে সুইপার অবধি তার শরীর নিয়ে মজা করে। পুরুষের শ্রেণী আছে। উঁচু শ্রেণী, নিচু শ্রেণী। পুরুষের জাত আছে। উঁচুজাত নিচুজাত। মেয়েদের কোনও শ্রেণী নেই। কোনও জাত নেই। একটিই শ্রেণী তাদের, একটিই বর্ণ। মেয়েবর্ণ। মেয়েজাত। উঁচুশ্রেণী বলে বা উঁচু জাত বলে বা শিক্ষিত বলে, বা স্বনির্ভর বলে, বা প্রতিভাবান বলে মেয়েদের ক্ষমা নেই। এই পুরুষতন্ত্রে সব মেয়েই সমান। সব মেয়েই ‘মাল’, সব মেয়েই ‘ইয়ার্কি মারার জিনিস’।
সমাজের সর্বত্র থিকথিক করছে তীর্থংকরে। যদি মেয়েরা সব ইন্দ্রাণী হত, মেনে না নিত অপমান! যদি মাথা না নোয়াতো। যদি আত্মবিশ্বাস থাকতো তাদের, ইন্দ্রাণীর যেমন আছে! যদি বদ পুরুষদের ক্ষমা না করতো, পাছে লোকে কিছু বলের ভয় যদি না থাকতো! পৃথিবী বদলে যেত।
৩৬. কবে হবে মেয়েরা নিজেই নিজের পরিচয়?
কলকাতায় বসবাস করার শুরুতে একটি বাড়ি ভাড়া নিয়েছি। সংসারের কাজে আমাকে সাহায্য করার জন্য তখন কাউকে চাই আমি। খুঁজছি কাকে পরিচারিকার চাকরিটি দেওয়া যায়। এক বন্ধু বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল, ওখান থেকে দৌড়ে এসে বললো, ‘তোমার পাশের বাড়ির দিকে একটা বউ যাচ্ছে, ওকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারো।’
আমি ঠিক বুঝে পেলাম না কী বলছে বন্ধুটি, বললাম, ‘কে যাচ্ছে বললে?’ বললো, ‘বউ।’
‘বিয়ে হচ্ছে নাকি পাশের বাড়িতে! বরকেও দেখলে?’
আমি বারান্দায় এলাম দেখতে কী ঘটছে। না, যেমন ছিল চারদিক, তেমনই আছে। কোনও বাড়িতে বাড়তি হৈ চৈ নেই, সানাই বাজছে না কোথাও। বর বধূ বেশে কাউকেই দেখলাম না উঠোনে। বন্ধুটি জোরে হাসছে তখন। এপ্রিল মাসের পয়লা তারিখও নয় যে আমাকে বোকা বানাবে কেউ। কিন্তু টের পাই যে আমি বোকা বনে আছি।
না, একদিনে হয়নি। কয়েক মাস আমার লেগেছিল বুঝতে যে, যে মেয়েরা অন্যের বাড়ি কাজ করে, সে মেয়েরা যদি বিবাহিত হয়, তবে তাদের বউ বলে ডাকা হয়। এই মেয়েদের বর বা স্বামীর সঙ্গে কারও চেনা পরিচয় থাকতে হবে, তার কোনও মানে নেই।
‘আর যে পুরুষেরা অন্যের বাড়ি কাজ করে, তারা যদি বিবাহিত হয়, তবে কি তাদের বর বা স্বামী বলে ডাকা হয়?’
আমার এই প্রশ্নকে উদ্ভট বলে লোকেরা বিবেচনা করে। কিন্তু আমার প্রশ্ন অতি সরল, এবং সহজ। বুঝতে কারও অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। কিন্তু তারপরও কাউকে আমি বোঝাতে পারি না।
না। এই বউ বলে ডাকার চলটি একেবারে যে কথ্য ভাষায়, তা নয়। শুদ্ধ ভাষায় এর চল বেশ আছে। রাজ্যের পত্রিকাগুলোয় প্রায় প্রতিদিনই পড়ছি, ‘ঝাঁপ দিয়ে বধূর আত্মহত্যা।’ ‘বধূ খুন’। ‘বধূ ধর্ষণ’। বধূদের নিয়ে কিছু না কিছু খবর থাকেই। বধূ কারা? ওই একই উত্তর। মেয়ে। মেয়েদের বধূ বলা হচ্ছে কেন? যেহেতু তারা বিবাহিত। মেয়েরা কি বিয়ে করলে আর মেয়ে থাকে না? বধূ হয়ে যায়? পুরুষরা তো বিয়ের আগে এবং পরে পুরুষই থাকে। খবর কোনওদিন এরকম পড়িনি, বরের আত্মহত্যা। বর খুন। বর ধর্ষণ। বা ‘স্বামীর আত্মহত্যা’। ‘স্বামী খুন’। ‘স্বামী ধর্ষণ’। নাম দিয়ে নয়, লিঙ্গ দিয়েও নয় অর্থাৎ মেয়ে মহিলা নারী রমণী কিছু দিয়ে নয়, তার শিক্ষা দীক্ষা, কাজ কর্ম দিয়ে নয়, প্রতিভা পারদর্শিতা দিয়ে তো নয়ই, মেয়ের পরিচয় পুরুষের সঙ্গে তার সম্পর্ক দিয়ে।