বদমাইশি আলো আর অন্ধকারের ওপর নির্ভর করে না। করে মানসিকতার ওপর। মানসিকতা নির্ভর করে সুশিক্ষার ওপর। সুশিক্ষা নির্ভর করে শিক্ষা-ব্যবস্থার ওপর। শিক্ষা-ব্যবস্থা নির্ভর করে রাজনীতির ওপর। পুরুষতন্ত্রের আর বৈষম্যের রাজনীতির জয়জয়কার এখন। সমতায় বিশ্বাসী নারী-পুরুষ যতদিন না বৈষম্যের মূলোৎপাটন করছে, যতদিন ব্যবস্থাগুলোর আমূল পরিবর্তন না হচ্ছে, ততদিন নারীকে ইঁদুরের মতো বেঁচে থাকতে হবে। বিপদ দেখলে গর্তে লুকিয়ে পড়তে হবে। ইঁদুরের গর্তেই কি ইঁদুরের নিরাপত্তা আদৌ আছে! নিরীহ ইঁদুরের যেমন নেই, নারীরও নেই।
৩৫. মেয়েরা যেন না মেনে নেয় অপমান
বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক ইন্দ্রাণী দণ্ড চৌধুরীর দিকে নজর পড়েছে তাঁর বিভাগীয় প্রধানের। আমরা জানি পুরুষের নজর যখন পড়ে কোনও মেয়ের ওপর, কী হয়। ইন্দ্রাণীর দিকে সকাল সন্ধ্যে যৌনগন্ধময় বাক্য ছুড়ে দিতে লাগলেন তীর্থংকর দাস পুরকায়স্থ। নির্ভয়ে এবং নির্ভাবনায় এই কাজ তিনি করেন, তাঁকে নিরস্ত করে, সাধ্য কার! ইন্দ্রাণীকে যে ইশারাই বা যে ইঙ্গিতই করেন তীর্থংকর, ব্যর্থ হন। যত ব্যর্থ হন, তত তিনি ব্যাঘ্র হন। ভেতরে বাইরে গর্জন করেন। সব জেনে বুঝেও লোকে শেষ অবধি ইন্দ্রাণীকে দোষ দেয়। যেহেতু মেয়েদের দোষ দেওয়া খুব সহজ এবং এই সংস্কৃতিটি খুব জনপ্রিয়, লোকে ধর্ষককে দোষ না দিয়ে যেমন ধর্ষিতাকে দেয়, ধর্ষিতার পোশাক বা চাহনি বা চালচলন নাকি ইন্ধন জুগিয়েছিল ধর্ষণ করতে। এও ঠিক তেমন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধ্যক্ষকে তীর্থংকরের আচরণ নিয়ে অভিযোগ করেছেন ইন্দ্রাণী। কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। উপাধ্যক্ষ নিজে পুরুষ। পুরুষেরা সাধারণত পুরুষের পক্ষই নেয় বিপদ দেখলে। কারণ পুরুষের চরিত্র তো পুরুষ চেনে। রতনে রতন যেমন চেনে। এক রতন ফাঁদে পড়লে আরেক রতন যদি না বাঁচায় তবে সেই রতনকে বিপদে বাঁচাবার জন্য এই রতন তো এগোবে না। অলিখিত একটি চুক্তি এদের মধ্যে থাকেই যে পরস্পরের প্রয়োজনে এরা এগিয়ে আসবে এবং এগিয়ে আসে বলেই আজ রতনে জগত ভরে গেছে। রতনদের ভিড়ে মেয়েরা পথ চলতে পারছে না। চলতে গেলেই ধাত্তা খাচ্ছে, পিছলে পড়ছে।
ইন্দ্রাণী যেহেতু সাড়া দেননি তীর্থংকরের প্রস্তাবে, শুধু তাই নয়, গোপনে কী কী বলেছেন এবং করেছেন, তা রাষ্ট্র করে দিয়েছেন, সেহেতু রেগে আগুন হয়ে আছেন তীর্থংকর। প্রচার করার চেষ্টা করছেন যে তাঁর জন্য দুর্দম্য আকর্ষণ ইন্দ্রাণীরই ছিল, ইন্দ্রাণীই তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। এইসব মিথ্যে প্রচারের কাছে হেরে যাওয়ার মেয়ে ইন্দ্রাণী নন। তিনি অপমান মেনে নেবেন না বলে পণ করেছেন। তীর্থংকর গোষ্ঠী আশা করেছিলেন যে চরিত্র ইেচ্ছেমতো কালি কলঙ্ক লেপন করলে ইন্দ্রাণী এই বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যেতে বাধ্য হবেন। আপদ বিদেয় হবে। এ শুধু আশায় বসতি। ইন্দ্রাণী বিশ্ববিদ্যালয় পাল্টাবেন না, আরও এই জন্য পাল্টাবেন না যে তিনি অপরাধ করেননি, অপরাধ করেছেন তীর্থংকর। মাথা নত করে যদি কাউকে বিদেয় নিতে হয়, নেবেন তীর্থংকর, ইন্দ্রাণী কেন! আর পিছু হঠলে দুষ্টু লোকের দেওয়া অপবাদকে সত্যি বলে মনে হবে, নিজের স্বস্তি বলে যে জিনিসটির প্রয়োজন খুব, সেটিও তো থাকবে না! পিছু হঠার কোনও কারণ ইন্দ্রাণীর নেই, কারণ তিনি খুব ভালো করেই জানেন যে তিনি কোনও অপরাধ করেননি। সুতরাং মাথা উঁচু করে ইন্দ্রাণী দাঁড়িয়ে আছেন, এবং অপরাধীর শাস্তি দাবি করছেন।
নারীর বিরুদ্ধে নিগ্রহ নির্যাতনকে, নিরন্তর যৌন হেনস্থাকে এখনও অন্যায় ভাবতে বেশির ভাগ মানুষই পারে না। কারণ সমাজে এসব যেমন নিত্য নৈমিঙ্গিক ঘটনা, তেমনই গা সওয়া, সহজ স্বাভাবিক ব্যাপার। অনেকে ভাবছেন, তীর্থংকর তো আর ইন্দ্রাণীকে ধর্ষণ করেননি বা ধর্ষণের কোনও চেষ্টাও করেননি, তবে ইন্দ্রাণী কেন শাস্তি দিতে চাইছেন তাঁকে। শাস্তি দিতে চাইছেন এটা বোঝাতে যে ‘মেয়েরা ইয়ার্কি ফাজলামির জিনিস নয়।’ মেয়ে দেখলেই যৌনগন্ধযুক্ত কথা বলার অধিকার পুরুষেরা মনে করে তাদের আছে, কিন্তু তাদের নেই। তারা ইচ্ছে করলেই মেয়েদের নিয়ে যা খুশি তাই করতে পারে না।
সমাজ প্রচণ্ডভাবে পুরুষতান্ত্রিক হওয়া সঙ্গে্েবও সামান্য সভ্যতার আইন কানুন ইদানীং যা আমদানি হচ্ছে, তাতে অপকর্মের জন্য পুরুষের শাস্তি পাওয়ার একটি ব্যবস্থা, খুব আশার কথা যে, হচ্ছে। যৌন হেনস্থার বিরুদ্ধে আইন ভারতবর্ষে আছে, পুরুষেরা জানলেও বেশির ভাগ মেয়েই এ কথা জানে না। জানলেও নীরবে লজ্জাবনত মুখে সয়ে যায় সব রকম লাঞ্ছনা। ঘুরে দাঁড়াতে পারে ক’জন?
ইন্দ্রাণী দাঁড়িয়েছেন। তীর্থংকরের বিরুদ্ধে তিনি যে মামলা করেছেন, তা আমি একশ ভাগ সমর্থন করি। প্রতিটি মেয়েরই ইন্দ্রাণীর মতো নিজের ব্যক্তিত্ব এবং আত্মবিশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকা উচিত। মেয়ে দেখলেই যে পুরুষেরা টিকাটিপ্পনি করে, অশ্লীলতা করে, তাদের ধর্ষণ করার দরকার হয় না, ধর্ষণের স্বাদ তারা এসব থেকেই নেয়। তাদের অপরাধকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে মেয়েরা বহুকাল দেখে আসছে। এবং এভাবেই তারা পুরুষকে আস্কারা দিয়ে মাথায় তুলেছে। পুরুষ এখন মনে করে মেয়েদের সঙ্গে বদমাইশি করা তাদের জন্মগত অধিকার। নির্বোধ মেয়েরাও আদুরে গলায় বলে, ‘পুরুষ তো, একটু ওরকম তো হবেই। ওদের তো ইয়েটা বেশি।’ ইয়েটা কী টা? যদি জিজ্ঞেস করি, বলবে, ‘ওই সঙ্গেটা।’