যদিও নারীবাদীদের চাপে রাতের চাকরিতে মেয়েদের নিষিদ্ধ করার বিষয়টি এখন স্থগিত রেখেছেন কর্নাটক সরকার, কিন্তু চাকরিরত মেয়েদের ওপর নিষেধাত্তা আরোপের একটি চেষ্টা অন্তত হয়েছিল, তা ভুলে গেলে চলবে না। আজ কর্নাটকের মতো রাজ্যে নিজেদের নিরাপত্তা ঘরে বন্দি হয়ে থেকে যদি মেয়েদের দিতে হয়, তবে অন্য অনগ্রসর রাজ্যগুলোর রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে যেতে বাধ্য এই নিয়ম। মেয়েদের জন্য সবচেয়ে ভালো, ঘর থেকে না বের হওয়াই। তাহলে ভীষণ নিরাপত্তার মধ্যে মেয়েরা রইল। আর, বাইরে যদি বেরোতেই হয়, নিরাপত্তার চরমতম ব্যবস্থাটিই গ্রহণ করা উচিত। চলমান কারাগার, যার আরেক নাম বোরখা, ব্যবহার করতে হবে যেন মন্দ লোকের নজর না পড়ে। অন্ধকারের দিকে চিরকাল মানুষ এভাবেই হেঁটেছে। অন্ধকার চিরকাল মানুষকে এভাবেই গ্রাস করে নিয়েছে।
মানুষ তো আলোর দিকেও যায়। মনকে আলোকিত করার কিছুই কি নেই এই ভারতবর্ষে? মায়াবতীর বিজয় হচ্ছে একদিকে, ঘর থেকে বেরিয়ে আসা মেয়ে, দিন রাঙ্গির পরিশ্রম করে সাফল্য পাওয়া মেয়ে, আর অন্যদিকে চলছে মেয়েদের পঙ্গু বানাবার, পরাজিত আর পরনির্ভর বানাবার পাঁয়তারা।
ভারতবর্ষে বিজ্ঞান এবং ধর্মের যেমন সহাবস্থান চলে, নারীর জয় এবং পরাজয়েরও তেমন। আলো আর অন্ধকার পরস্পরকে উষ্ণ আলিঙ্গন করে আছে দেখলে বড় আশংকা হয়। যদি অন্ধকারের হাঁ মুখে ঢুকে যায় সব আলো, সব জয়, সব বিজ্ঞান, সব যুক্তি, সব মুক্তি, সব সমতা, সব মানবতা, তবে? অন্ধকারের শিক্ত কম নয়।
নারীকে রক্ষা করার জন্য, নারীর সম্ভ্রম বা ইজ্জত বাঁচানোর জন্য আলাদা কোনও আইনের কোনও প্রয়োজন নেই। নারী নাগরিক রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রের দায়িত্ব তার সকল নাগরিকের নিরাপত্তা বিধান করা। রাষ্ট্র যদি তার সব নাগরিককে বা জনগণকে নিরাপত্তা দেয়, তবে খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রয়োজনীয় সব নিরাপত্তা নারী পেয়ে যাবে। রাষ্ট্র কি তা করে? যদি করতোই তবে সরকার অনুমোদিত বিবাহ, তালাক, উত্তরাধিকার ইত্যাদি আইনি বৈষম্যের শিকার নারীকে হতে হত না, যদি করতোই তবে দিনে কেন, রাতেও নারী নিশ্চিন্তে রাস্তাঘাটে কর্মক্ষেত্রে চলাফেরা করতে পারতো, কোনও নিগ্রহের শিকার তাকে হতে হত না। যদি করতোই, তবে ঘরে ঘরে নারী শান্তিতে স্বস্তিতে বাস করতে পারতো।
নারীর নিরাপত্তা কোথাও নেই! নিরাপত্তার জন্য নানা আইনের প্রণয়ন হয়েছে, কোথাও কোথাও সেসব প্রয়োগও হচ্ছে। কিন্তু সত্যিকার নিরাপত্তা নারীর জুটছে না। একা আইন দিয়ে সব সমস্যার সমাধান করা যায় না। পুরুষ যদি এখন নারীকে আক্রমণ না করে, তবে সে আইনের ভয়ে। কিন্তু পুরুষ যেদিন থেকে নারীকে আক্রমণ করবে না, কারণ নারীকে সে মানুষ হিসেবে সম্মান করবে, সেদিন সমস্যার সত্যিকার সমাধান হবে। তার আগে নয়। শ্রদ্ধা ও সম্মান ভেতর থেকে আসে। ভেতর থেকে না এলে বাইরে থেকে আরোপ করে কৃঙ্গিম উপায়ে যে শিল্প বা সংস্কৃতিই নির্মাণ করা হোক না কেন, তুড়িতে ভেঙে পড়ে সব।
আইনের ভয় আজ থাকে, কাল থাকে না। ভয় দিনে দিনে দূর হয় লোকের। দূর্নীতিগ্রস্ত সমাজে ভয় বলে শেষ অবধি কারও কিছুই থাকে না। বুক ফুলিয়ে সন্ত্রাস চালিয়ে যেতে পারে যে কেউ। আইনের ভয় দেখিয়ে নারী নির্যাতন বন্ধ করা যায় না, যাবে না। একমাত্র উপায় নির্যাতন বন্ধ করার, পুরুষের মানসিকতা বদলানোর। নারীকে দুর্বল ভাবার, যৌনবস্তু ভাবার, খেলনা ভাবার, দাসী ভাবার, মনোরঞ্জনের জিনিস ভাবার, উৎপাদনের যন্ত্র ভাবার মানসিকতা না বদলালে কোনওদিনই নারী তার নিরাপত্তা এ সমাজে পেতে পারে না।
প্রশ্ন হল পুরুষের এই মানসিকতা তৈরি করছে কারা? তৈরি করছে রাষ্ট্র ব্যবস্থা, সমাজ ব্যবস্থা, আইনি ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থা। প্রতিটি ব্যবস্থাই পুরুষতান্ত্রিক, পুরুষকেন্দ্রিক। এক মায়াবতী দিয়ে রাজনৈতিক জগতে চমক ফেলা যায়, কিন্তু সমাজ পরিবর্তন করা যায় না। সমাজে আরও অনেক মেধার প্রয়োজন, আরও মায়াবতীর প্রয়োজন। আরও আরও রুখে ওঠা মানুষের প্রয়োজন। সমতার জন্য আরও আরও লড়াইএর প্রয়োজন।
নারীর প্রতি শ্রদ্ধা কি নারীরই আছে! হিসেব করলে দেখা যায়, নেই। কারণটি হল নারী নিচুশ্রেণীর জীব — এ কথা বাচ্চা বয়স থেকে সবাইকে শেখানো হয়, নারী পুরুষ উভয়কেই। উভয়ের মস্তিষ্কেই ঢুকিয়ে দেওয়া হয় এই বিদ্যে। নিচুশ্রেণীর জীবকে শ্রদ্ধা বা সম্মান করা খুব দুরূহ ব্যাপার। তাই নারীবিরোধী অপরাধ বন্ধ হওয়ার কোনও লক্ষণ নেই কোথাও।
নারীকে মানুষ হিসেবে শ্রদ্ধা ও সম্মান যেদিন নারী ও পুরুষ উভয়ে করতে শিখবে, সেদিন নারীবিরোধী কোনও কার্যকলাপ, নারীবিরোধী কোনও আইন, কোনও কুসংস্কার এই সমাজে টিকে থাকতে পারবে না। তখন নারীর নিরাপত্তার জন্য ঘন ঘন আইন প্রণয়ণেরও প্রয়োজন হবে না। শ্রদ্ধা করলে কেউ নারীকে ধর্ষণ করে না, কেউ নারীপাচার করে না, সম্মান করলে কেউ নারীকে বেশ্যাবৃঙ্গিতে ঠেলে দেয় না, তাকে আগুনে পোড়ায় না।
আইন কি কম আছে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে? ক’জন নির্যাতনকারী শাস্তি পায়? ক’জন নারী এ সমাজে সত্যিকার অর্থে নিরাপত্তা পায়? রোগের চিকিৎসা না করে রোগের উপসর্গের চিকিৎসা করা হচ্ছে। রোগ কী করে সারবে তবে!
রাত আটটার পর পুরুষরা যদি অসভ্য, অভব্য, অগণতান্ত্রিক, অমানুষ হয়ে ওঠে, তবে সেই পুরুষদের শাস্তি দেবার ব্যবস্থা হোক, মেয়েদের কেন শাস্তি দেওয়া হবে! মেয়েরা যদি রাঙ্গিভাগে কাজ বন্ধ করতে বাধ্য হয়, তবে তারা চাকরির সুবিধে থেকে বঙ্গিত হবে। এক ক্ষতি ঠেকাতে গিয়ে আরও একটি বিরাট ক্ষতির আয়োজন ছাড়া এ কী আর কিছু! আর, এ কথাও সকলের জেনে রাখা প্রয়োজন, যে পুরুষ রাত আটটার পর বদমাইশি করতে পারে, সে দিন দুপুরেও অবলীলায় তা পারে। যে বদমাইশি করে না, সে রাত গভীর হলেও করে না।