নিলুফার আর শিল্পাকে নিয়ে যখন কট্টরপন্থীরা শোরগোল করে, কট্টরপন্থীদের দোষ দিয়ে দিব্যি বসে থাকি আমরা। যেন কট্টরপন্থীরা খুব মন্দ, বাকি সব বেজায় ভালো। দোষ কিন্তু কট্টরপন্থীদের নয়। দোষ মূলে। সমাজে। কাঠামোয়। কট্টরপন্থীরা মাঝে মাঝে আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় কাঠামোটির কথা, এই যা। এই কাঠামো নিয়ে এ দেশের অধিকাংশ মানুষের কোনও আপত্রি নেই। এই কাঠামোর ওপরই তারা গড়ে তুলেছে তাদের সুরম্য সংসার, সমাজ।
লোকে হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিস্টান জৈন ইহুদি পারসি ইত্যাদি ধর্মীয় গোষ্ঠীর পার্থক্য নিয়ে বড় বড় কেতাব লিখে ফেলছে। কিন্তু, আমার মতে এদের মধ্যে সত্যিকারের কোনও পার্থক্য নেই। সব ধর্ম এবং সমাজই পুরুষতান্ত্রিক এবং খুব সংগতকারণে তাই নারীবিরোধী। ধর্মগুলোর মধ্যে ওপরে ওপরে কিছু পার্থক্য আছে, ধর্মীয় উৎসবগুলোর আচার আচরণেও কিছু পার্থক্য দেখা যায়, কিন্তু এসবের প্রকৃতি এক, ভেতরে ভেতরে সবই এক। কোনও একটা অদৃশ্য শক্তিকে ভয় পেতে হবে, তাকে প্রার্থনায় পুজোয় তুষ্ট রাখতে হবে, এবং মনুষ্যসমাজে মেনে চলতে হবে এই নিয়ম, যে, পুরুষ প্রভু, নারী দাসী। দাসী শব্দটি শুনলে আজকাল উচ্চশ্রেণীর উচ্চশিক্ষিত নারীরা খুব বিরক্ত হয়। কিন্তু এই শব্দটি ছাড়া আর কোনও জুতসই শব্দ আমি খুঁজে পাই না নারীর জন্য। আপাতদৃষ্টিতে দাসী বলে মনে না হলেও পুরুষতন্ত্রের কাঠামোটি যে নারীকে দাসী করে রেখেছে, তা তলিয়ে যে দেখতে না পারে, সে অন্ধ ছাড়া আর কী! নারীকে অবশ্য অন্ধ না হলে চলে না। চোখ খোলা মেয়ের এই সমাজে কোনও ঠাঁই নেই।
মেয়েদের যখন চোখ খুলতে থাকে, তখনই সমাজের রক্ষকরা সেই চোখ অন্ধ করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। সমাজের এই রক্ষকদের কট্টরপন্থী বলে কেউ অসম্মান করে না। তারা খুব সম্মানীয় লোক। ভদ্রলোক। বুদ্ধিমান। কালচার্ড। কট্টরপন্থীরা রাস্তায় বাঁদরের মতো লাাফায়। অশ্লীলতা করে। জ্বালায় পোড়ায়। ওরা বোকা। আনকালচার্ড। ওরা আসলে ভদ্রলোকদের চেয়ে কম কট্টরপন্থী। ওরা অতটা ক্ষতি করতে পারে না মেয়েদের, যত করতে পারে ভদ্রলোকেরা। নরমপন্থীরা। কট্টরপন্থীদের দেখলে চেনা যায়, তাদের কাছ থেকে সাবধান হওয়া যায়। বুদ্ধি খাটিয়ে তাদের পরাস্ত করা যায়। কিন্তু পরাস্ত করা যায় না শিক্ষিতদের। ভদ্রলোকদের। বুদ্ধিমানদের। বাইরে থেকে দেখলে তাদের চেনার কোনও উপায় নেই। তারা প্রগতিশীল, তারা সমতায় বিশ্বাসী — এরকমই সবার ধারণা। তাদের নিজেদেরও তাই ধারণা। কিন্তু তারাই প্রচণ্ড বুদ্ধির জোরে কুট-কৌশলে টিকিয়ে রাখছে এই পুরুষ শাসিত সমাজ। নারী বিরোধী ঐতিহ্য, সনাতন সংস্কৃতি আগের চেয়ে আরও জাঁক করে পালন করার আয়োজন করছে তারা।
রাস্তায় কুশপুতুল পোড়ানো, ফতোয়া দেওয়া কট্টরপন্থী বা উগ্রপন্থীদের সংখ্যা ভদ্রলোকদের তুলনায় অনেক কম। এই সংখ্যালঘুদের কোনও ক্ষমতা নেই পুরুষতন্ত্র টিকিয়ে রাখার। টিকিয়ে রাখছে ভদ্রলোকেরা, যারা নরমপন্থী, চালাক চতুর। কট্টরপন্থী বলে তাদের কেউই মনে করবে না, আসলে সত্যিকার কট্টরপন্থী তারাই। পুরুষতন্ত্রের কাঠামোটিকে অক্ষত রাখার জন্য যা করার সবই তারা করছে। তারা যদি বুদ্ধিবলে শক্তিবলে পুরুষবলে টিকিয়ে না রাখতো পুরুষতন্ত্রকে, তবে এটি টিকে থাকতো না এত দীর্ঘকাল।
৩৪. জনগণের নিরাপত্তার ব্যবস্থা হলেই নারী নিরাপত্তা পাবে
কেরালা আর কর্ণাটক রাজ্যদুটোতে মেয়েদের অবস্থা ভারতবর্ষের অন্যান্য রাজ্যের চেয়ে ভালো। এই ভালো-রাজ্য কর্ণাটকে হঠাৎ কিছুদিন আগে ৪৬ বছরের পুরোনো একটি আইন (দোকান এবং বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান আইন ১৯৬১) প্রয়োগ করা হল। আইনটি হল, ‘মেয়েরা রাত আটটার পর কোথাও কাজ করতে পারবে না, অর্থাৎ রাঙ্গিভাগে তাদের কাজ নিষিদ্ধ। আইন অমান্য করলে শাস্তি, ছ মাসের কারাদণ্ড এবং নগদ দশ হাজার টাকা।’ হঠাৎ যেন ভারতবর্ষে ঝড়ের মতো নেমে এলো এক টুকরো মধ্যযুগ।
আসলেই কি নেমে এলো? মধ্যযুগ কি বিরাজ করছে না প্রকাশ্যে অনেক অঞ্চলেই, এবং গোপনে গোপনে প্রায় সর্বত্র? মানসিকতার কি উত্তরণ ঘটেছে যথেষ্ট? রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক আখ্যা দেওয়া হচ্ছে, চমৎকার চমৎকার আইনের প্রণয়নও হচ্ছে, সংখ্যালঘুর জন্য না হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠর জন্য সমানাধিকারের ব্যবস্থা হচ্ছে, গৃহ নিগ্রহের বিরুদ্ধেও আধুনিক একটি আইন আনা হল, জাতপাতের বিরুদ্ধে তো কঠোর কঠিন আইন আছেই, পণপ্রথার বিরুদ্ধেও। তাতে কী? সমাজে জাতপ্রথা নেই? পণ দেওয়া নেওয়া হরদম চলছে না? শিকার হচ্ছে না মেয়েরা প্রতিদিন,এই প্রথার, এই ভারতবর্ষে? বধূহত্যা, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, নারীপাচার, বেশ্যাপ্রথা সবই সতীদাহের আগুনের মতো দাউ দাউ করে জ্বলছে, জানান দিচ্ছে তারা আছে। তারা আইন মানে না।
এই মধ্যযুগের মধ্যেই মেয়েরা অনেকে শিক্ষা আর স্বনির্ভরতার আধুনিকতার দিকে যখন এগোচ্ছে তখন পুরোনো নথিপজ্ঞের গা থেকে ধুলো ঝেড়ে কর্ণাটকের সরকার আইন বের করেন খুঁজে, মেয়েদের পায়ে শেকল পরাতে চান। মেয়েদের ওপর রাতে রাতে আক্রমণ বাড়ছে, সুতরাং মেয়েদের ঘরবন্দি করো। ‘মাথা ব্যথা হচ্ছে, সুতরাং মাথা কেটে ফেলো’র মতো সমাধান। দিনের বেলায় যদি আক্রমণ হয় তাহলে তো দিনের বেলাতেও ঘরের বাইরে বেরোনো মেয়েদের বন্ধ হবে। মেয়েদের ওপর আক্রমণ কখন না হয়? রাতে হয়, দিনে হয় না? দিন রাতের কোনও ভাগেই নিরাপদ নয় মেয়েদের জীবন। কেন নয়, সে কারণটি খুঁজে বের করা উচিত কর্ণাটক সরকারের। সমস্যার মূল কারণটিকে নির্মূল করা হলে সমস্যা নিয়ে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।