হত্যার মাধ্যমে মেয়েদের নানা ঝামেলা উপদ্রব নির্যাতন নিষ্পেষণ থেকে নিরাপত্তা দেওয়া, সেটা আজকের ঐতিহ্য নয়, বহু বছর ধরেই ছিল। দীর্ঘ দীর্ঘ কাল ধরে মেয়েরা শিখে আসছে বেঁচে না থাকাটাই এই সমাজে তাদের সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা। ব্রিটিশরা মেয়েহত্যা এলাকা চিহ্নিত করেছিল তাদের রাজত্বেই। ১৮০৫ সালে সৌরাষ্ট্রের জাদেজা রাজপুতদের মধ্যে মেয়েশিশুহত্যার চল ছিল, ওরা বার করেছিল। পূর্ব উত্তর প্রদেশে একটা গ্রাম ছিল তখন, কোনও মেয়েশিশু ছিল না গোটা গ্রামে। ১৮০৮ সালে বরোদার শাসক আলেকজান্ডার ওয়াকার সমন পাঠিয়েছিল সব সম্প্রদায়ের প্রধানদের কাছে, সবাইকে বলেছিল মুচলেকা লিখে যাও যে মেয়েশিশু হত্যা আর করবে না। ১৮৭০ সালে মেয়েশিশুহত্যা রোধ করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ১৮৯৮ সালে সরকার মেয়েশিশুহত্যাকে অপরাধ বলে রায় দেয়। মেয়েশিশু হত্যা রোধ আইনও প্রণয়ন করা হয়েছিল, একসময় রাজনৈতিক কারণেই ওটি উঠে যায়।
নৃতত্ত্ববিদরা বলেন, সভ্যতার শুরু থেকে দেখা গেছে যখন খাদ্যের অভাব হয়েছে, মেয়ে আর শিশুদের হত্যা করা হয়েছে। ডারউইন বলেছেন, মেয়েদের হত্যা করা হত জন্মের সময়, এর কারণ কিন্তু তাদের মৃত্যুটা সমাজকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য দরকার ছিল বলে নয়। কারণ পুরুষ শাসিত সমাজ মেয়েদেরকে বোঝা বলে মনে করতো। ভারতে সেই উনবিংশ শতাব্দীতে মেয়েশিশুহীন বেশ কয়েকটি গ্রামের কথা নথিপত্র উেল্লেখ আছে। কিছু এলাকায় ছিল ৩৪৩টি ছেলে, ৫৪টি মেয়ে। বোম্বেতে ১৮৩৮টি ছেলে, আর মেয়ের সংখ্যা ৬০৩। আরও পেছনে গিয়ে যদি খুঁজতে যাই, কী পাবো? মেয়েশিশুহত্যার চল হয়তো বৈদিক যুগ থেকেই ছিল। অথর্ব বেদের কথা, ‘মেয়েশিশুকে অন্য কোথাও জন্মাতে দাও, এখানে জন্মাতে দাও ছেলেশিশুকে। পুত্র হল সম্পদ। পুত্র আশীর্বাদ। বৃদ্ধ বয়সে পিতাকে শক্তি দেবে পুত্র। পুত্র মুখাগ্নি করবে পিতার, তাই পিতা স্বর্গে যাবে। পুত্রই পিতাকে নরক থেকে মুক্ত করবে।’ নারীর ভূমিকা কী! নারী পুত্র সন্তান জন্ম দেবে। নারী হচ্ছে জমি, যে জমিতে পুরুষ তার বীর্য নিক্ষেপ করবে পুত্র উৎপন্ন হওয়ার জন্য। মনু বলেছেন, ‘দিন রাত মেয়েদের নির্ভর করতে হবে পুরুষের ওপর।’ বলেছেন, ‘তার পিতা তাকে রক্ষা করে যখন সে শিশু, স্বামী যখন সে যুবতী, পুত্র যখন সে বৃদ্ধা। স্বাধীনতা নারীর জন্য নয়। নারী এর যোগ্য নয়।’ প্রথম মেয়েদেরকে ‘পরনির্ভর’ থাকতে বলা হচ্ছে, তারপর তাদের বলা হচ্ছে, তারা একরকম ‘বোঝা’। তবে সত্য এই, মেয়েদের সেই আদিকাল থেকে এই এখন অবধি পুরুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তি করে রাখা হয়েছে।
দীর্ঘ দীর্ঘ কাল ধরে মেয়েশিশু হত্যা করে এসে এখন মেয়েশিশুর গর্ভপাত ঘটানো ঐতিহ্যের বাইরের কোনও কাজ নয়। এ অনেকটা আগাছা তোলার মতো পুত্রউৎপাদনের জন্য রাখা জরায়ুর মাটি থেকে মেয়ে তুলে ফেলে দেওয়া। এমন পুত্রপিপাসু জাতির জন্য কন্যাহত্যা তো আশ্চর্যের কিছু নয়।
রামচন্দ্রের পিতা রাজা দশরথ পায়েশ খাওয়ালো তিন স্ত্রীকে, অমনি স্ত্রীরা জন্ম দিয়ে দিল চারটে পুত্রসন্তান। পুরাণের সেই জাদুর পায়েশ ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের কোথাও কোথাও এখনও স্ত্রীদের খাওয়ানো হয়, যেন পুত্র জন্ম দেয়।
কারও কারও মতে, সীতা এই সমাজের মেয়েশিশুহত্যাযজ্ঞের শিকার, পরে তাকে উদ্ধার করা হয়েছে। রাজা জনক সীতাকে মাটির তলায় পুঁতে রাখা একটা হাঁড়িতে পেয়েছিল। যেখানে পাওয়া গিয়েছিল, সেখানকার ঐতিহ্য হল—হাঁড়িতে জীবন্ত মেয়েশিশুকে পুরে, এক টুকরো গুড় আর একটু সুতো সঙ্গে দিয়ে হাঁড়ির ঢাকনা শক্ত করে লাগিয়ে মাটির তলায় পুঁতে চেঁচিয়ে লোকে বলতো, ‘গুড় খা, ওখানেই থাক, কখনও ফিরে আসিস না, তোর ভাইকে পাঠিয়ে দে।’ সম্ভবত, ‘রাম এবং সীতা দুজনই সেক্স সিলেকসানের প্রাচীন ফর্মের প্রডাক্ট।’
পুত্র পিপাসায় ধর্মে জাতিতে কোনও ভেদ নেই। বাদশা আকবর পুত্র চেয়ে শেখ সেলিম চিশতির আশীর্বাদ নিল। পুত্র হল। পুজ্ঞের নাম রাখা হল সেলিম আর ফতেপুর সিক্তি নামের চমৎকার একটি শহর তৈরি করা হল পুজ্ঞের জন্ম উৎসব করার জন্য। এ দেশের আনাচে কানাচে গলি ঘুপচিতে আছে ধর্মশালা, যেখানে গিয়ে পুত্র কামনা করা যায়। হিন্দু, শিখ, মুসলিম, বৌদ্ধ সবারই প্রয়োজন পুজ্ঞের। ভারত ছেয়ে যাচ্ছে বাবায়। বাবাদের দ্বারে ধর্না দেওয়া হয়েছে, ফকির কোবরেজ অনেক হয়েছে। ভগবান, বাবা এরা এখন কেউই আর এত পারফেক্ট নয়। বিজ্ঞান পারফেক্ট। বিজ্ঞান এখন মানুষকে ঝাঁড় ফুক তুকতাক ভগবান বাবা থেকে উদ্ধার করতে এসেছে। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেও, নানা পুজো আর্চা করেও এত ভালো ফল কোনওদিন পাওয়া যায়নি, বিজ্ঞান যে ফলটি তাদের দিচ্ছে। বিজ্ঞান আসাতে এখন দেখে নেওয়া যাচ্ছে পেটের ভেতর বাচ্চাটির লিঙ্গ, লিঙ্গ পছন্দ না হলেই লিঙ্গসহ বাচ্চাকে হাওয়া করে দেওয়া হচ্ছে। ট্রেডিশান আর টেকনোলজির এমন সমন্বয় পৃথিবীর অন্য কোথাও এত বীভৎস ভাবে নেই।
‘অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভ বিদেয় করা যায় বিজ্ঞানের মাধ্যমে’, বিজ্ঞানের লোকেরা এমন দাবিও করেছিল শুরুতে। স্ক্যান তো আছেই, এলো অ্যামনিওসেনথেসিস। ভ্রুণে কোনও অস্বাভাবিকতা বা ডিফরমিটি বা পঙ্গুত্ব আছে কি না দেখার জন্য। কিন্তু সে উজ্ঞেশে ভারতে এই পরীক্ষাটি করা হয় না। করা হয় লিঙ্গ দেখার জন্য। যেই না স্ত্রীলিঙ্গ, অমনি গুডবাই। এদেশি মানসিকতায় তবে ভ্রুণের অস্বাভাবিকতা লিঙ্গেই লুকিয়ে আছে, পঙ্গুত্ব লিঙ্গেই। স্ত্রীলিঙ্গেই।