নিজেদের অধিকারের ব্যাপারে সামান্য সচেতন হলে মেয়েরা নিশ্চয়ই বুঝতো যে জগতে যত নির্যাতন আছে মেয়েদের বিরুদ্ধে, সবচেয়ে বড় নির্যাতন হল, মেয়েদেরকে সুন্দরী হওয়ার জন্য লেলিয়ে দেওয়া। এর পিছনে যেন মেয়েদের অঢেল টাকা যায়, সময় যায়, মাথা যায়, যেন সর্বনাশ হয়। আর, পুরুষ নিশ্চিন্তে নিরাপদে ভুঁড়িঅলা, টাকঅলা, কুৎসিত কদাকার শরীর নিয়েও জগতের যাবতীয় ক্ষমতায় বহাল তবিয়তে বিরাজ করবে। কেউ তাদের শারীরিক সৌন্দর্য নিয়ে মোটেও ভাবিত হবে না। প্রশংসায় পঞ্চমুখ হবে তাদের কাজকর্ম দেখে। এসবের কিছু ব্যতিক্তম যে নেই তা নয়। কিন্তু ব্যতিক্তম কখনও উদাহরণ হতে পারে না। অনেকে হয়ত বলবে সিনেমা থিয়েটার এবং বিজ্ঞাপনের জগতে পুরুষের সৌন্দর্য গোনা হয়। তা হয়ত হয় কিছু ক্ষেত্রে, কিন্তু তুলনায় নিতান্তই নগণ্য। সিনেমার কথা ধরি, দিলীপ কুমারের মতো ইয়া মোটা কোনও অভিনেত্রীকে ভাবা যায় তারকা হিসেবে? যে শরীর নিয়ে গোবিন্দ নায়ক হয়, কোনও মেয়েকে কি অমন স্থূল শরীরে নায়িকা করা হবে কখনও? অমিতাভ বচ্চন তাঁর ত্বকের একশ ভাঁজ নিয়েও আজ মেগা স্টার থেকে যেতে পারেন, রেখাকে কিন্তু বলিরেখা সব ঘুচিয়ে তবে টিকে থাকতে হচ্ছে! উত্তম কুমার ঘরের বাইরে বেরিয়েছেন বয়স হলেও; চুলহীনতা, স্থূলতা, বলিরেখা নিয়েও যত্রতত্র ঘুরে বেড়াচ্ছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তারকাখ্যাতি কমেনি, বরং বেড়েছে। সুচিত্রা সেনকে কিন্তু ঘরবন্দি থাকতে হচ্ছে। বেরোলেই তাঁর তারকাখ্যাতি ঝটিতে বিদেয় হবে। এ কথা জানেন বলেই জনসমক্ষে তিনি চেহারা দেখান না। লুকিয়ে আছেন বছরের পর বছর। সুচিত্রা সেন খুব ভালো অভিনেত্রী ছিলেন, কিন্তু অত বড় অভিনেত্রীকেও মর্যাদা পেতে হয় তাঁর শরীরের কারণে। ত্বকে ভাঁজ পড়লে, স্তন নুয়ে পড়লে, চুলে পাক ধরলে, নারীরা, যত বড় অভিনেত্রীই তাঁরা হোন না কেন, আর সম্মান পান না। অপর্ণা সেনএর প্রতিভার ধারে কাছে আসার যোগ্যতা হবে না অনেক পুরুষ-চিত্রপরিচালকের। কিন্তু তারপরও, অজান্তেই তিনি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চমৎকার শিকার হয়ে বসে আছেন। তাঁকেও কী ভয়াবহরকম সাজতে হয়, প্রমাণ করতে হয় যে তিনি সুন্দরী! আর সাহিত্যের জগত? সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের চেহারা দেখুন, তারাপদ রায়কে দেখুন, এরকম চেহারা নিয়ে কোনও মেয়ে-লেখক কি দুদিনও টিকে থাকতে পারতো?
০৫. আমি কান পেতে রই
কলকাতায় অদ্ভুত সব অভিজ্ঞতা আমার হচ্ছে। এখানকার ইস্কুল কলেজ পাশ করা বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরোনো মেয়েরা, স্বনির্ভর কী স্বনির্ভর নয়, বলে বেড়ায় যে নারীরা সমানাধিকার পেয়ে গেছে। আপত্তি জানালে শ্লেষ ফুটে ওঠে ঠোঁটের কিনারে, শ্লেষের অনুবাদ করে নিই নিজ দায়িত্বে। আমি এদেশি নই বলে এ বিষয়ে আমি জানি না। নারী নির্যাতন সম্পর্কে প্রশ্ন করলে অনেকে আকাশ থেকে পড়ে, নির্যাতনের কথা শুনেছে তারা কিছু, তবে, ঠিক কোথায়, কীভাবে, জানে না। সেঁটে থাকলে বিস্তর ভেবে নাক ঠোঁট কুঁচকে বলে দেয়, হ্যাঁ হলে গ্রামে হয় ওসব, শহরে নয়।
আমি হাঁ করে তাকিয়ে থাকি। আমাকে খুব বোকা দেখতে লাগে। খুব অস্ফুট স্বরে হয়তো জিজ্ঞেস করি, শহরে কোনও নির্যাতন নেই?
মাথা নাড়া উত্তর। না।
কোনও বৈষম্য?
না। না। এখানে মেয়েরা খুবই স্বাধীন।
তা বটে। স্বাধীন। স্বাধীনতার মানে কাকে বলে, এই মেয়েরা কি জানে? আমি নিশ্চিত, জানে না। এই যে স্বাধীন বলে নিজেদের তারা মনে করছে, মন তাদের স্বাধীন ভাবে চিন্তা করতে পারে না বলেই বলছে যে তারা স্বাধীন।
অধিকার কি সব পাওয়া হয়েছে?
হ্যাঁ সবটাই।
সত্যিই কি?
খুব ইনটিরিয়রে, মানে একেবারে গ্রামে অবশ্য মেয়েদের অধিকার পাওয়া হয়নি ততটা। বেচারা, ওদের জন্য সত্যিই মায়া হয়।
শুনে, গ্রামের মেয়ের চেয়েও শহুরে মেয়ের জন্য বেশি মায়া হতে থাকে আমার। লেখাপড়া জানা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নেওয়া দুচারটে ছেলেবন্ধুর সঙ্গে মেশা মেয়ে স্বাধীনতার শীর্ষে উঠে গেছে বলে বিশ্বাস করছে। সে দেখেনা তার হাত পায়ে যে শিকল পরানো। সে বোঝে না যে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে তার পূর্ব নারীরা যেমন যৌনসামগ্রী আর সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র ছিল, তেমন সেও। আধুনিকতার হাওয়া লাগা মেয়েরা পুরুষের ভোগের ক্ষিধে বরং তিনগুণ বাড়িয়ে দেয়। এই শহুরে স্বাধীন নারী শাঁখা সিঁদুর প’রে এবং স্বামীর পদবী ধারণ ক’রে নিজেই জানান দিচ্ছে যে সে পুরুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তি। স্বামী নামক যে পদার্থটি তার আছে, সেটি তার নিরাপত্তা, যে নিরাপত্তাটি বিগড়ে গেলে তার সমূহ বিপদ, যে নিরাপত্তাটি খসে গেলে সেও খসে পড়বে।
অর্থ উপার্জনে কী লাভ, যদি একা দাঁড়াবার মতো মনের শক্তি এবং সাহস না থাকে! আমি অনেক স্বনির্ভর মেয়েকে দেখেছি সমাজের নারীবিরোধী নষ্টপচা নিয়মের সামনে নির্বিকার মাথা নোয়াতে। নিজের অধিকার সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখা এবং তা অর্জনের জন্য সব রকম ঝুঁকি নেওয়া সব শিক্ষিত এবং স্বনির্ভর মেয়ের পক্ষেও সম্ভব নয়।
গ্রামের অনেক নিরক্ষর মেয়েকেই আমি দেখেছি উচ্চশিক্ষিত শহুরে দাসী বাঁদীদের চেয়েও বেশি অধিকারবোধ নিয়ে বাঁচে। একটু এদিক ওদিক কেউ করলো তো কোমরে আঁচল বেঁধে গুষ্ঠি তুলে গালাগাল করে তবে ছাড়লো। গায়ে আঁচড় লাগলো, লেঠেল নামিয়ে দিল। নিজের হক আদায় করতে ওস্তাদ তারা। রীতিমত যুক্তি দিয়ে তর্ক করে। শহরের মসজিদে কোনও মেয়ের গিয়ে সাহস নেই নামাজ পড়ে আসে। কিন্তু গ্রামের মেয়েরা দলবেঁধে গিয়ে বিষম বিপ্লব করে নামাজ পড়ে এলো পশ্চিমবঙ্গেরই এক গ্রামে, এই সেদিন। ধর্মাচরণ করে যে মেয়েদের সত্যিকার কোনও লাভ হয় না, তা না জেনেও কিছু একটা তো করে ফেলল, যে কিছুটা ওই সমাজে নিষিদ্ধ ছিল! মেয়েদের পথগুলো শত সহস্র নিষেধের আবর্জনায় ভরা, পথ চলতে গেলে তাদের প্রধান দায়িত্ব যাবতীয় নিষেধগুলো আগে আস্তাকুঁড়ে ফেলা।