আইনত নিষিদ্ধ হলেও বহাল তবিয়তে চলছে ভ্রুণহত্যা, শিশুহত্যা। নারীনির্যাতনও তো আইনত নিষিদ্ধ। চলছে না? চার দেওয়ালের ঘরের মধ্যে কার আইন চলে? ওখানে চলে পুরুষ কর্তার আইন। পুরুষের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে পুরুষ শাসিত এই সমাজে পার পাবে কোন মেয়ে? কে তাকে বাঁচতে দেবে বাকি জীবন?
বিরানব্বই সালে তামিল নাডুর মেয়েশিশুদের নিরাপত্তা দেওয়ার একটি পদক্ষেপ নেওয়া হয়, ২০০০ সালের মধ্যে শিশুহত্যা নির্মূল করার জন্য। এক বা দুই মেয়ে যাদের আছে, কোনও পুত্র নেই, তাদের টাকা দেওয়া হবে যদি বাবা মার একজন বন্ধ্যাকরণ করেন। মেয়ের নামে টাকা জমা হবে ফিক্সড ডিপোজিটে, যতদিন না মেয়ের ২১ বছর বয়স হয়। মেয়ের ইস্কুলের খরচপাতি বাবা মার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। স্কিমে প্রতিবছর ২০,০০০ পরিবারকে নেওয়া হচ্ছিল। বিরানব্বই সালে সালেম ডিস্ট্রিজ্ঞে ৬১৪ টি মেয়ে টাকা পেল, পেল দেড় বছর পর্যন্ত। স্কিমটি শেষ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যেতে বাধ্য হল। নানারকম বাধা বিপত্রি। মাস্তান পুলিশ সুদখোর ঘুসখোর ঢুকে সব্বনাশ করলো প্রকল্পটির । ২১ বছর বয়সে যখন মেয়ের নামে জমা হওয়া টাকাটা তোলা হবে সেই টাকা এক পণ দেওয়া কাজে ছাড়া অন্য কিছুতে ব্যবহার হবে না। কোনও স্কিমই বুঝি সত্যিই মেয়েদের অবস্থা বদলাবে না।
৬ বছর বয়স অবধি ছেলে মেয়ের সংখ্যার আনুপাতিক হার হওয়া উচিত খুব কম করে হলেও ছেলে ১০০০, মেয়ে ৯৫০। বয়স বাড়লে এটি পাল্টে যায়, মেয়ের সংখ্যা বাড়ে, ছেলের সংখ্যা কমে। কারণ ছেলেদের চেয়ে বাঁচার ক্ষমতা মেয়েদের বেশি। যত্নআঙ্গি পেলে মেয়ের সংখ্যা ১০০৫ হয়। সমানাধিকার পেলে মেয়ের সংখ্যা ছেলের অনুপাতে অনেক ওপরে ওঠে। কিন্তু ছ বছর অবধি মেয়ে-শিশুর সংখ্যা যদি ৯৫০এর কম হয়, বুঝে নিতে হবে নির্ঘাত হত্যা করা হচ্ছে মেয়েদের।
অমর্ত্য সেনএর এক গবেষণায় দেখা যায় যে, তিন কোটি সাত লক্ষ মেয়ে এই ভারতে, ১৯৮৬ সালে, ‘মিসিং’। এই যে মেয়ে হারিয়ে যাচ্ছে, এ কিন্তু হঠাৎ করে ঘটছে না। এ বহুকালের পুত্রপিপাসার ইতিহাস। বহু কাল ধরেই অন্যান্য যে কোনও দেশের চেয়ে কম মেয়ে সংখ্যা এই ভারতে। ১৯০১ সালের আদমসুমারিতে দেখা যায় প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের সংখ্যা ছিল ১০০০ ছেলেয় মাত্র ৯৭২ মেয়ে। সেই থেকে বছর যত যাচ্ছে মেয়ের সংখ্যা আরও কমছে। ২০০১ সালে ৯৩৩। ১০০০ ছেলেয় ৭০ জন মেয়ে কম। হিসেব তা হলে এই, একশ কোটির দেশে সে বছর ৭ কোটি মেয়েকে হত্যা করা হয়েছে। এত বিশাল দেশ ভারত, এই ভারতের একটি রাজ্য নেই যেখানে মেয়েশিশু সংখ্যা হ্রাস পায়নি। কিছু কিছু রাজ্যে মেয়েশিশু সংখ্যা ৮০০র নিচে চলে গেছে। পাত্তাব হরিয়ানা হিমাচল প্রদেশ গুজরাট মহারাষ্ট্র। পাঞ্জাবের গুরদাসপুরে তো ১০০০ ছেলেয় ৭২৯ মেয়ে। গুজরাটের মেহসানায় ৭৫২। তামিলনাড়ুর সালেমে যেখানে ৭৬৩, হরিয়ানার আমবালায় ৭৭২। উত্তর প্রদেশের সাহজাহানপুরে ৬৭৮। এসব অঞ্চলে ১০০০এ ২০০ করে মেয়ে বেপাত্তা। পাত্তাব হরিয়ানায় ১৯৯১ সালের পরেই বাজার কথা বিপদঘন্টি। কিন্তু কেউ হয়তো অনুমান করেনি দশ বছরে আরও কত নেমে যেতে পারে সংখ্যা। ১৯৯১ সালে কোনও রাজ্যেই ৮০০র কম মেয়ে ছিল না, কিন্তু দশ বছরের মধ্যেই মোট চারটে রাজ্যে মেয়ের সংখ্যা ৮০০র চেয়ে কম।
এনজিওগুলো বলে যে, নারী শিক্ষিত ও উপার্জনক্ষম হলে মেয়েশিশু বা মেয়েভ্রুণ হত্যা বন্ধ হবে। বেশির ভাগ মানুষের বিশ্বাস পরিকল্পিত মেয়েহত্যা বুঝি গরিব এবং অশিক্ষিতদের মধ্যে হয়ে থাকে। কিন্তু ঘটনা তার উল্টো। ভারতে সবচেয়ে বেশি ছেলের অনুপাতে মেয়ে কম এখন দক্ষিণ দিল্লিতে, যেখানে শিক্ষিত এবং ধনীদের বাস। সবচেয়ে বেশি বিলুপ্তি ঘটেছে সেখানে। বড় বড় রাজনীতিবিদদের নাকের ডগায় ঘটছে হত্যাযজ্ঞ। ৯০৪ থেকে দশ বছরে ৮৪৫। ২৪,০০০ মেয়েশিশুকে এই দক্ষিণ দিল্লি থেকে প্রতিবছর উধাও করা হচ্ছে। গুজরাটের প্যাটেল বংশে বিস্ময়। ধনী কৃষক ওরা। অথচ মেয়ের চিহ্ন নেই ওদের গ্রামগুলোয়। চঙ্গিগড়ে ৮৫৩ মেয়ে। চঙ্গিগড় শহরে হার আরও কম, ৮৪৪। ভারতে দরিদ্র এবং অশিক্ষিত এলাকার চেয়ে ধনী এবং শিক্ষিত মানুষের এলাকায় মেয়েশিশুর হার কম। হত্যা বেশি হচ্ছে ওখানেই। মেয়েদের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে চলছে হলোকস্ট। গণহত্যা। পশ্চিমবঙ্গে অন্য যে কোনও অংশের চেয়ে কলকাতায় মেয়েশিশুর বিলুপ্তি বেশি।
১ কোটি মেয়েভ্রুণের গর্ভপাত হয়েছে ভারতে, গত দু দশকে। ১৯৯৭ সালে স্বাধীনতার পত্তাশ বছর পূর্তির বছরে পাঁচ লক্ষ মেয়ে ভারতের মাটিতে জন্মানোর স্বাধীনতা পায়নি, যে ভারত কিনা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ‘গণতন্ত্র’ নিয়ে গর্ব করে।
এ দেশে মেয়েরা খুব দ্রুত বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘ দীর্ঘ কাল ধরে লালন করা নারী বিরোধী কুসংস্কার। বেশ কিছু সম্প্রদায়ে পুত্রদেরই সন্তান বলে মনে করা হয়, কন্যাদের নয়। ১৯৮০ সালের আগ অবধি মেয়েশিশুদের জন্মানোর পর হত্যা করা হত। তখন জরায়ুর ভেতরে থাকা অবস্থায় মারার চল শুরু হয়নি। ভ্রুণহত্যা যে হারে বাড়ছে, এটি নিষিদ্ধ করার পরও, এতে আশংকা হয় যে সমাজে মেয়েদের অবস্থার উন্নতি না হওয়াতক এই হত্যাকাণ্ড, এই রক্তপাত রোধ করার কোনও উপায় নেই। উত্তর ভারত এমন ভয়াবহ অবস্থায় দাঁড়িয়েছে, যে, আশংকা করা হচ্ছে ২০২১ সালে বোধহয় মেয়ে বলতে কিছুই থাকবে না।