আমি নাকউঁচু সমালোচকদের মতো করে বলবো না যে শরীর নিয়ে লিখলেই তো শুধু হবে না, লেখা সাহিত্যপদবাচ্য হল কি না তা দেখতে হবে। না, আমি তা দেখবো না। মেয়েরা যাই লিখুক, যেভাবেই লিখুক, হৃদয় দিয়ে যদি লেখে, তা অন্যের হৃদয় স্পর্শ করবেই। সাহিত্যকে আমি কোনও সংজ্ঞায় ফেলতে চাই না। পাঠকের যদি ভালো লাগে, পাঠক যদি আলোড়িত হয় কোনও কবিতা গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ পড়ে, তা-ই সাহিত্য। আমার ভাবনাটি এরকম।
নারী শৃঙ্খল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসছে, এটি আমার কাছে অনবদ্য একটি কবিতা। শৃঙ্খল ছেঁড়ার বা ভাঙার যে শব্দ, সে শব্দ আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় সঙ্গীত। এ নিয়ে কেউ যদি গল্প লেখে বা কবিতা লেখে, তা আশ্চর্য সুন্দর সাহিত্য, আমি তা নির্দ্বিধায় বলতে পারি। হাজার বছর ধরে পরা শেকল ভেঙে যে নারী মুক্ত হয়, সে কবিতা না লিখুক, আমি তাঁকে কবি বলি বিশ্বাস করি।
০৪. সুন্দরী
অ্যান্টিএজিং, এক্সফলিয়েটর্স, মাস্কস, আই ব্রাউজ, আই লাইনার্স, আই শ্যাডো, বেস মেকআপ, ব্লাশ, কনসিলার, ইলুমিনেটর্স, লিপ গ্লস, লিপ লাইনার্স, লিপস্টিক, নেইল পলিশ—এরকম সহস্র সামগ্রী আজ বাজারে কেন? কাদের ব্যবহারের জন্য? এর উত্তর আমরা সকলেই জানি। মেয়েদের। আমার প্রশ্ন, কেন মেয়েদের এসব ব্যবহার করতে হবে? কেন মেয়েদের আসল চেহারাকে আড়াল করতে হবে নানান রঙ দিয়ে? কেন বানাতে হবে নকল একটি মুখ? নকল চোখ, নকল ঠোঁট, নকল গাল? এই প্রসাধন সামগ্রী ব্যবহার করে মেয়েরা, কারণ নিজেদের সত্যিকার চেহারা নিয়ে তারা হীনমন্যতায় ভোগে। কে এই হীনমন্যতাবোধটি জাগালো? কে বলেছে মেয়েদের মুখে কোনও ত্রুটি আছে, তাই অজস্র প্রসাধন মেখে সেই মুখকে ত্রুটিমুক্ত করতে হবে! ত্রুটিমুক্ত করলে তারা সুন্দরী আখ্যা পাবে!
মেয়েরা তটস্থ। খাবে না। খেলে মেদ জমবে শরীরে। কোথাও মেদ জমতে দেওয়া যাবে না। বুকের মাপ এই হতে হবে, কোমর ওই, পেট সেই, নিতম্ব এমন, উরু তেমন। সব কিছুরই মাপ নির্দিষ্ট করা আছে। সেই মাপ মতো শরীর বানাতে মেয়েরা মরিয়া হয়ে উঠেছে। খাবার দেখলে ভয়। না খেতে খেতে মেয়েদের অনেকে আজ অ্যনোরেক্সিয়া আর বুলিমিয়া রোগে ভুগছে। মেয়েদের শরীরের আকার আকৃতি এবং অঙ্গ প্রত্যকের কী মাপ হওয়া উচিত, তা তৈরি করছে কারা? শরীর নিয়ে মাপজোকের অংক কষছে কারা? কারা বলছে কোনও একটি মাপের মধ্যে শরীরকে না ফেললে সেই শরীর সুন্দর নয়? সেই মেয়ে সুন্দরী নয়?
মেয়েদের শরীর-এর জন্য বিশ্ব ব্যতিব্যস্ত। তাদের পোশাক এবং অলঙ্কারের অন্ত নেই। চারদিকে সাজ সাজ রব। শরীর সাজাও। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ অবধি সাজাও। এটা পরো। ওটা মাখো। ফুটফুটে ঝলমলে চকচকে রাখো সর্বাঙ্গ। কিন্তু, কেন? কার জন্য? মেয়েরা কি একবারও ভাবে, কার জন্য? কাকে তৃপ্ত এবং তুষ্ট করার জন্য? অনেক মেয়েই জোর দিয়ে বলতে চেষ্টা করবে যে, নিজেদের জন্যই তারা সাজে, নিজের ভালো লাগাই মূল কথা। বটে। ওরকম মনে হয়। কিন্তু, ভালো লাগা এবং না লাগার উদ্রেক হওয়ার পিছনে দীর্ঘকালের শিক্ষা থাকে, তা কে অস্বীকার করবে? কে অস্বীকার করবে নারীকে সাজসজ্জা করানোর ইতিহাস?
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী হচ্ছে পণ্য। পুরুষের ভোগের সামগ্রী। কেউ মানুক না মানুক, এ কথা সত্য। ঠিক যে রকম রূপ হলে পুরুষের উত্তেজনা জাগে, নারীবস্তুটিকে সেই রকম হতে হয়। এই নারীবস্তুটিকে ঠিক সেই রকম দেখতে শুনতে হতে হয়, যে রকম হলে পুরুষের শরীর এবং মনের আরাম হয়। নারীকে জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি যে সাজগুলো এবং যে কাজগুলো করতে হয়, তার সবই পুরুষ এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজের স্বার্থ রক্ষার জন্য। নারীর সতীত্ব, মাতৃত্ব, নত ও নম্র চরিত্র-রক্ষা সবই পুরুষের স্বার্থে। পুরুষ যেন নারীকে তার অধিকৃত সম্পত্তি এবং ক্রীতদাসী হিসেবে চমৎকার ব্যবহার করতে পারে। নারীকে কুক্ষিগত করার নানা রকম পদ্ধতির চল আছে। সবচেয়ে আধুনিক পদ্ধতির নাম প্রেম। প্রেম, নারীকে, এমনকী সবল নারীকেও এমন দুর্বল করে, এমন গলিয়ে ফেলে যেন পুরুষের চর্ব্য চোষ্য লেহ্য পেয় হওয়া ছাড়া নারীর আর কোনও উপায় না থাকে। সংসার মঞ্চে স্ত্রীর ভূমিকায় যাওয়ার আগে প্রেমিকার মহড়া চলে। এই মহড়ায় প্রেমিক পুরুষটির জন্য ত্যাগে এবং তিতিক্ষায় যথেষ্ট দক্ষতা দেখাতে পারলে নারী উতরে যায়।
সুন্দরী। এই বিশেষণটি এবং ধারণাটি পুরুষতন্ত্রে বিশ্বাসী পুরুষ এবং নারী উভয়েরই তৈরি। তারাই নির্ধারণ করে কোন শরীরের নারীকে সুন্দরী বলে আখ্যা দেওয়া যাবে। তাদের দখলে আছে প্রচার এবং পণ্যসামগ্রীর বাণিজ্য। প্রচার হয়ে গেল ওই শরীরটি সুন্দর, অমনি ওই শরীরের মতো বুকপেটকটিউরুনিতম্ব বানানোর আয়োজন শুরু হয়ে যায়। ট্রেডমিল, এক্সারসাইজ বাইক, লাইপোসাকসান, প্লাস্টিক সার্জারি, সিলিকন ব্রেস্ট। বাজার ছেয়ে যায় পণ্যে, সেই পণ্যের ওপর সঙ্গে সেক্স নারীর দল হুমড়ি খেয়ে পড়ে অথবা তাদের ধাক্কা দিয়ে হুমড়ি খাওয়ানো হয়। নারীকে সুন্দরী হতে হবে। সুন্দরী না হলে এই সমাজে তার কোনও মূল্য নেই। সুন্দরী না হলে তার বন্ধু থাকবে না, বান্ধব থাকবে না, প্রেম হবে না, বিয়েও হবে না ভালো, ভালো চাকরি জুটবে না, কাজকম্মের ফল পাবে না, একঘরে হয়ে পড়ে থাকতে হবে। নারী তাই প্রাণপণে পণ্য হতে চায়। যেন সে বিকোয় ভালো। যেন তার শরীরটি ভালো খায় লোকে। বাজারের চাহিদা অনুযায়ী নিজেকে প্রস্তুত করতে নারী হঠাৎ শেখে না। শেখে জন্ম থেকেই। বাড়ির আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে শেখে, বাইরে পা বাড়িয়েই শেখে। রেডিও টেলিভিশনে শেখে, পত্র পত্তিকায় শেখে। মেয়েদের ম্যাগাজিন পড়ে আরও বেশি শেখে। মস্তিষ্কের কোষে কোষে ঢুকে যায় এ জাতীয় শিক্ষা। ফলে, নারীর অধিকার সম্পর্কে জ্ঞান বুদ্ধি ধারণ করার ক্ষমতা পুরুষের চেয়ে নারী অনেক কম রাখে।