হিন্দু আইনে নারী পুরুষের বৈষম্য ধীরে ধীরে কমিয়ে ফেলা হয়েছে কিন্তু মুসলিম আইনে নারীর অধিকার এখনও বড় একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন। শাস্ত্র অনুসরণ করে ‘পারিবারিক আইন’ তৈরি হয় যে রাষ্ট্রে, সে রাষ্ট্রকে ‘সেকুলার’ বলি কী করে! সম্প্রদায় ভিত্তিতে যে রাষ্ট্রে ভিন্ন ভিন্ন দেওয়ানি বিধি থাকে, কী করে তবে সেই রাষ্ট্রকে ‘অসাম্প্রদায়িক’ বলি! নারী পুরুষের সমানাধিকার স্বীকৃত নয় যে রাষ্ট্রে, সেই রাষ্ট্রকে ‘গণতন্ত্র’ বলি কী করে!
অনেকে বলে, সতীদাহ, মুসলিম পারিবারিক আইন, এবং আরও অনেক লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে ভারতের নারীরা দীর্ঘ দীর্ঘকাল আন্দোলন করেছেন। এ বিষয়ে আমার দ্বিমত আছে। ভারতবর্ষে, সত্যিকার অর্থে, আমার বিশ্বাস, কোনও শক্তিশালী নারীবাদী সংগঠন ছিল না, কোনও নারীবাদী-আন্দোলনও হয়নি, এ যাবৎ নারীর পক্ষে যা কিছুই হয়েছে, হয়েছে সমাজসংস্কারক শিক্ষিত পুরুষের করুণায়। অশিক্ষার অন্ধকারে পুরে সংসারখাঁচায় বন্দি করে রাখার পুরুষতান্ত্রিক ষড়যন্ত্রের শিকার নারী, এই নারী তার অধিকারের ব্যাপারে অচেতন, এই নারী স্বাধীনতার স-ও জানে না। কিছু পাওয়ার জন্য যাদের কঠিন সংগ্রাম করতে হয়নি, তারা জানে না পাওয়ার অর্থ কী। কোনওরকম আন্দোলন ছাড়াই যারা নানারকম অধিকার পেয়ে যায়, তাদের পক্ষে অধিকারের গুরুত্ব বোঝা কঠিন, প্রাপ্য অধিকার আদায় করার জন্য আন্দোলন করাও কঠিন। নারীবিরোধী আইনের অন্যায় অত্যাচারে বছরের পর বছর ধরে নারী অসহনীয় দুর্ভোগ পোহাতে থাকলেও, ভয়াবহ গণধর্ষণের শিকার তারা হলেও, গণহারে তাদের খুন করা হলেও খুব কম নারীই পথে নামে প্রতিবাদে। ভারতের নারীরা হাত গুটিয়ে বসে থাকে কোনও মহাপুরুষ এসে তাদের সব সমস্যার সমাধান করে যাবে এই আশায়।
আসলে, সে সংস্কৃতির কোনও দেশে কোনও সমাজে সংস্কৃতি হিসেবে সম্মান পাওয়া উচিত নয়, যে সংস্কৃতি মানুষের মুক্তচিন্তা এবং স্বাধীনতার ক্ষতির কারণ হয়, যে সংস্কৃতি নির্মমভাবে মানুষের অধিকার হরণ করে। মানুষের কল্যাণের জন্যই সংস্কৃতি। অকল্যাণকর কিছু ঘটলে সে সংস্কৃতির হয় আমূল সংস্কার হোক, নয় তা ছুড়ে ফেলা হোক আবর্জনায়। পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক সংস্কৃতিই পুরোনো হয়ে পচে গলে মরে গেছে। মানুষ এগিয়ে গেছে সামনে।
নারীর অধিকার এবং বহুসংস্কৃতির সমাজকে একই সঙ্গে কী করে টিকিয়ে রাখা যায়, এই প্রশ্ন সামনে। আমার বক্তব্য হল, যে করেই হোক অধিকার টিকিয়ে রাখতে হবে, এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে যদি সংস্কৃতি চলতে পারে ভালো, তা নয়তো পিছিয়ে পড়বে। পড়ুক। নারীর প্রধান ও প্রথম দায়িত্ব নারীর অধিকারকে বাঁচিয়ে রাখা।
সূত্র: জেনডার্ড সিটিজেনশিপ, অনুপমা রায়
০২. বাঙালি পুরুষ
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্মদিনে বেশ অনেকে গৌরব করে বলেছে যে সুনীলের জীবনে বহু নারীর সমাগম ছিল, আমি বসে ভাবছিলাম, আজ কি কোনও লেখিকাকে নিয়ে এমন কথা কেউ বলতে পারবে যে তার জীবনে পুরুষ ছিল অনেক, পুরুষদের সঙ্গে প্রচুর প্রেম করেছে সে, চমৎকার সব কবিতা লিখেছে পুরুষদের নিয়ে, তার বহু-পুরুষ-গমন নিয়ে গৌরব কি করতে পারবে কেউ, যেমন গৌরব সুনীলের বেলায় করা হয়! সুনীল বা অন্য যে কোনও পুরুষের বেলায়!
বাঙালি পুরুষের সঙ্গে আমার শেষ প্রেম আজ থেকে দেড় যুগেরও বেশি আগে। নির্বাসিত জীবনে প্রেম দুএকবার এসেছে। ভিন ভাষায় প্রেমের অনুভব প্রকাশ করা যে সম্ভব হতে পারে তা আমার কল্পনারও অতীত ছিল। কিন্তু দেখলাম, সম্ভব। প্রাচ্যের এবং পশ্চিমের পুরুষের মানসিকতা একটা সময়ে গিয়ে একই রকম ঠেকে, একই রকম ম্যাগালোম্যানিয়া রোগে ভোগা, কিন্তু আচার আচরণে এক নদী তফাত। বেশির ভাগ বাঙালি পুরুষ মনে করে প্রেম করতে হলে সাতজন নারীর সঙ্গে প্রেম করতে হয়। এবং এর নাম বুঝি আধুনিকতা। সাতজনের সঙ্গে যা করা হয় তার নাম ফষ্টিনষ্টি হতে পারে, প্রেম নয়, আধুনিকতা তো নয়ই। একজন নারীর সঙ্গে প্রেম করে যে দীর্ঘ দীর্ঘ বছর সুখে অতিসুখে কাটিয়ে দেওয়া যেতে পারে, এ বিষয়ে তাদের ধারণা প্রায় নেই বললেই চলে। আধুনিকতা নয়, এর নাম আমি বলি প্রাচীনতা। রাজা বাদশাহ বা জমিদারদের জীবন যেরকম ছিল, উপপত্নীতে হারেম ছেয়ে থাকত, সেই প্রাচীন পুরোনো জীবনটি প্রায় সব পুরুষই যাপন করতে চায়, প্রকাশ্যে না পারলে লুকিয়ে, লুকিয়ে না পারলে মনে মনে। ভারতবর্ষের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পুরুষদের বীভৎস রকম সুবিধে দিয়ে আসছে। এইসব সুবিধে তাদের এত বেশি আকাশে উঠিয়ে দিয়েছে যে নিচের দিকে চাইলে কীটপতঙ্গের মত, তুচ্ছ খড়কুটোর মত দেখায় নারীদের, কিছুতে আর তাদের মানুষ বলে বোধ হয় না। যে সমাজে নারী বঞ্চিত, লাঞ্ছিত, জীবনভর নির্যাতিত, যে সমাজে নারীদের যৌনসামগ্রী ছাড়া আর কিছু মনে করা হয় না, সেই সমাজ থেকে হঠাৎ গিয়ে পড়েছি পশ্চিমের আধুনিক সমাজে, যেখানে পুরুষ এবং নারীর কোনও ভেদ খালি চোখে বোঝা তো অসম্ভবই, তলিয়ে দেখলেও কোনও সুতো পাওয়া যায় না। পৃথিবীতে নারী পুরুষের সমানাধিকার যে দেশগুলোয় সবচেয়ে বেশি, সেসব দেশে বাস করতে গিয়ে দেখেছি পুরুষেরা একজনের সঙ্গে প্রেম করে, তার সঙ্গেই জীবন যাপন করে, ঘুরে ঘুরে সাত রমণীর সঙ্গে শুতে যায় না। যদি ভালোবাসা উবে যায়, তবে সম্পর্কের ইতি ঘটিয়ে দেয়। নতুন করে পরে হয়তো কাউকে ভালোবাসে। নতুন কোনও সম্পর্ক তৈরি করে, তৈরি করে যাকে সত্যিকার ভালোবাসে, তাকে নিয়ে। বিয়ের কাগজ ওসব দেশে কোনও জরুরি কাগজ নয়, যে জিনিসটি সম্পর্ক টিকিয়ে রাখে, তা কোনও কাগজ নয়, পত্র নয়, সমাজের রক্তচক্ষু নয়, তার নাম হল ভালোবাসা। নিখাদ ভালোবাসা। ভালোবাসা না থাকলে পশ্চিমে বিচ্ছেদ হয়, এ দেশে ভালোবাসা না থাকলেও বিচ্ছেদের প্রশ্ন ওঠে না। ওঠে না নারী অসহায় বলে, পরনির্ভর বলে, সন্তান লালন পালনের ভার নারীর ওপর বর্তায় বলে, সংসার সাজিয়ে রাখার জন্য নারী সুন্দর সামগ্রী বলে, ভালো পোশাক পরা সাজগোজ করা উন্নতমানের দাসী বলে।
মিথ্যের ওপর, জোড়াতালির ওপর দাম্পত্য সম্পর্ক টিকে থাকে। হৃদয়ে প্রেম নেই, অসন্তোষ আছে, ঘৃণা আছে, অথচ কেবল অভ্যেসের কারণেই বাঙালি পুরুষেরা পুরো জীবন কাটিয়ে দেয় স্ত্রীর সঙ্গে। স্ত্রীকে ভালোবাসা এবং কেবল স্ত্রীসঙ্গেই তুষ্ট থাকা, তারা মনে করে, খুব একটা গৌরবের কাজ নয়, এতে পৌরুষ উজ্জ্বল হয় না। সাধারণ মানুষ তো নয়ই, অসাধারণ মানুষও সত্যিকার শ্রদ্ধা করতে শেখেনি নারীকে, না শিখলে যা হয়, নারীর সম্মান অসম্মানের তোয়াক্কা কেউ করে না। শিল্পী সাহিত্যিক পুরুষদের সঙ্গে আমার বন্ধুতা শত্রুতা সবকিছু। এদের দেখেছি, আহা নারীর প্রেমে যেন জীবন দিয়ে দেবে এমন। খুঁজে পেতে দেখা যায়, একই সেক্স কয়েকজন নারীর জন্য তারা একই রকম হা পিত্যেশ করছে। বিশ্বস্ততা বা ফেইথফুলনেস, যেটা নারী পুরুষের সম্পর্কের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পশ্চিমে, এই প্রাচ্যে এই ভারতবর্ষে এই বাংলায় সবচেয়ে অপ্রয়োজনীয়, সবচেয়ে অবান্তর, সবচেয়ে নগণ্য বিষয়। তবে বিশ্বস্ত এক পক্ষকে থাকতে হবে, সে হল ‘স্ত্রীজাতি’কে। স্ত্রীজাতি স্বামীর নাম উচ্চারণ করবে না, বারণ। স্ত্রীজাতি তাদের স্বামীদের আমার কর্তা বলে সম্বোধন করবে, নিয়ম। স্ত্রীজাতি স্বামীর ব্যক্তিগত সম্পত্তি স্বামীর ঘামেভেজা রুমালের মতো, দুর্গন্ধ অন্তর্বাসের মতো, অন্য পুরুষের ব্যবহার-অযোগ্য।
অল্প ক’জন বাঙালি পুরুষের সঙ্গে আমার যৌন সম্পর্ক ঘটেছে, এতেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। অন্য নারীর অভিজ্ঞতাও আমার অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করেছে। পশ্চিমের পুরুষেরা তাদের সঙ্গীর শীর্ষসুখের ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন, স্ত্রীকে সাত আকাশে উড়িয়ে পুলকপ্রপাতে ভাসিয়ে তারপর সুখের সমুদ্রে নিজের নৌকোখানি ছেড়ে দেয়। কিন্তু বাঙালি পুরুষ তাদের স্ত্রী নিয়ে মোটেও ভাবিত নয়। স্ত্রীকে শরীরের সাঁড়াশি দিয়ে আটকে রেখে, যেন বাঘে এইমাত্র একটা নরমসরম হরিণ ধরেছে, তড়িঘড়ি নিজের খাওয়াটা খেয়ে নেয়। এভাবেই তৃপ্ত হয় নিঃসাড় নারীর ওপর পুরুষের মনের কোণে লুকিয়ে থাকা ধর্ষণের স্বাদ নেওয়ার গোপন কামনা। শক্তি খাটিয়ে শরীরের তলে চেপে পিষে যেন কোনও কোলবালিশের ওপর নিজের বীর্য পতন ঘটিয়ে পাশ ফিরে পুরুষের পরমানন্দে ঘুমিয়ে পড়াকে সংসারে কার সাধ্য নিন্দা করে! যে কোনও সভ্য সমাজে কোনও স্বামী যদি স্ত্রীর ইচ্ছের বাইরে তার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে, সেই সম্পর্ককে যাহা বলা হয় তাহা সম্বন্ধে অধিকাংশ বাঙালি পুরুষ আদৌ অবগত নহেন, তাহার নাম ধর্ষণ। এবং ধর্ষণের শাস্তি স্বামী নামক ধর্ষকদের অন্য যে কোনও ধর্ষকের মতই মাথা পেতে বরণ করতে হয়। অধিকাংশ বাঙালি পুরুষ অবাধ যৌনসম্পর্কে পারদর্শী বলে নিজেদের যৌনবিশারদ মনে করে, তারা কিন্তু জানেই না নারীর যৌনাঙ্গের যাবতীয় শিল্প/বিজ্ঞান সম্পর্কে খুঁটিনাটি, কোথায় স্পর্শ করলে নারী খরদাহে পোড়ে, কোথায় করলে জলোচ্ছ্বাসে ভাসে তা কে কবে জানতে চেষ্টা করে! রমণের জন্য রমণী রক্তিম হল কি না তা বোঝার ইচ্ছেও কারও হয় না। পুরুষ বোঝে কেবল তার নিজের সুখ, নিজের আনন্দ। বাঙালি পুরুষেরা নিজেকে কদর্যভাবে ভালোবাসে, যদিও বলে, কাব্য করে, কোনও নারীকে সত্যিকার কিন্তু তারা ভালোবাসে না।
পুবের দেশগুলোয় একটা কথা খুব চালু আছে, ‘পশ্চিমে ফ্রি সেক্স চলে’। আমার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে আমি বলছি, পশ্চিমে আমি কোনও ফ্রি সেক্স দেখিনি, ফ্রি সেক্স দেখেছি পশ্চিম বাংলায়, দেখেছি বাংলাদেশে। এখানে যৌন উত্তেজনার তীব্রতায় যে কারও ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পুরুষেরা দ্বিধা করে না। পশ্চিমে সেক্সের জন্য একটা বড় জিনিসের দরকার হয়, সে হল ভালোবাসা। অন্তত ভালো তো লাগতে হবে। আরও একটা জিনিসের দরকার হয়, তার নাম সততা। পশ্চিমে যে ব্যতিক্তম কিছু দেখা যায় না, তা নয়। সাইকোপ্যাথ সব দেশেই থাকে। কোথাও কম, কোথাও বেশি। বাঙালি কোনও সাইকোপ্যাথকে কি সত্যি সত্যি সাইকোপ্যাথ বলা হয়! হয় না। বরং অনেক সময় তাদের বুদ্ধিজীবী বলা হয়ে থাকে। আমাদের বুদ্ধিজীবীরা যা ইচ্ছে তাই করার অধিকার রাখেন বলে মনে করেন, এই হল সমস্যা। বুদ্ধিজীবীরা সাধারণত পুরুষ, তাঁরা অন্যায় করলে সে অন্যায়কে অন্যায় বলে মনে করা হয় না। সত্তর পার করেও বুদ্ধিজীবীরা সতেরো বছরের কিশোরীর বুকে থাবা বসাতে সংকোচ করেন না। ওই থাবাকে লোকে নিজগুণে ক্ষমা করে দিয়ে বলে যে, এ কবিতা বা উপন্যাস লেখার বা কোনও শিল্প গড়ার বা বুদ্ধিবৃত্তির প্রেরণা আহরণ করা বৈ কিছু নয়। শিষ্যরা মাথা নেড়ে সায় দেয়। এখানে এই গুরু শিষ্যের দেশে, সাধারণের চেয়ে দু-ইঞ্চি ওপরে উঠেই যে কেউ গুরু বনে যেতে পারে, আর বাজারে হাত বাড়ালেই অগুনতি শিষ্য। বলো যে পৃথিবীটা চ্যাপ্টা। শিষ্যরা সমস্বরে বলবে, ঠিক ঠিক। শুনেছি পুরুষ-শিষ্যরা তাদের স্ত্রীদের প্রায়ই উপঢৌকন হিসেবে দেয়, চেখে টেখে ঢেঁকুর তুলে গুরু অবশ্য যার মাল তাকে ফেরত দেন, কিন্তু আবার চাখার আবার মাখার একটি অলিখিত চুক্তি করে নিয়েই তবে দেন। ব্যাপারটি এরতরফা নয়, গুরুরা ফাঁক পেলেই শিষ্যদের নানারকম সুবিধে দান করে যারপরনাই উদারতা দেখিয়ে থাকেন।
বাঙালি পুরুষের কি নীতি বলে কিছু নেই! হ্যাঁ অনেকের নীতি আছে। অধিকাংশ নীতি প্রদর্শন করছে বাইরে, ভেতরে যদিও দুর্নীতির আখড়া। আমি প্রত্যেকের কথা বলছি না। বলছি অনেকের কথা। বলছি অধিকাংশের কথা। স্ত্রীদের তাঁরা বাড়ির লোক বলেন। ঘরের বউ বলেন। বাড়িঘর পাহারা দেওয়ার জন্য, বাড়িঘরের কাজকম্ম সারার জন্য বাড়িতে থাকে বলে বউএর সঙ্গে সম্পর্ক ঘরের, বাড়ির। বাড়ির বাইরে যে বউকে নিয়ে তাঁরা বেরোন না তা নয়, বেরোন, তবে ওই বেরোনো বন্ধুকে নিয়ে বেরোনোর মত নয়, অনেকটা কাঁধে পাহাড় নিয়ে বেরোনোর মতো। লক্ষ্য করেছি স্ত্রীদের পাশাপাশি হাঁটার অভ্যেস পুরুষের নেই। স্বামী আগে হাঁটবে, স্ত্রী হাঁটবে পিছনে। সপ্তপদীর হণ্টন থেকেই বুঝি শুরু হয়ে যায় সুখী বিবাহের এই শর্ত। পুরুষ তার প্রেমিকা নিয়ে অবশ্য পাশাপাশি হাঁটে তবে ততদিন হাঁটে যতদিন না প্রেমিকাকে হাতের মুঠোয় পাওয়া হয়। যতদিন পাবো পাবো, ততদিন পাশাপাশি। পাওয়া হয়ে গেলেই আমি সামনে, তুমি পিছনে।
প্রেমের গুরু রবিঠাকুরই যদি প্রেমিকাকে নিয়ে পাশাপাশি হাঁটতে না পারেন, তবে আর আমাদের রমেন রঞ্জনের দোষ কী! পাওয়া হোক বা না হোক, রবীন্দ্রনাথের বেলায় কিন্তু অবশ্য সামনে পিছনের ব্যাপার ছিল না, যা দেখেছি যা শুনেছি সবই হল, আমি উঁচুতে, তুমি নিচুতে। আমি চেয়ারে, তুমি আমার পায়ের কাছে।
বাঙালি পুরুষের মধ্যে স্ত্রীকে পরম বন্ধু এবং প্রেমিকা ভাবার রেওয়াজ নেই। তাঁরা স্ত্রীকে কিছু স্বাধীনতা দান করে বাইরে বলে বেড়ান যে স্বাধীনতা দিয়েছেন। যেন স্বাধীনতা কাউকে দেবার জিনিস, যেন এ মানুষের জন্মগত অধিকার নয়! বাঙালি পুরুষ আলাদা নয়। সব রক্ষণশীল, সব পুরুষতান্ত্রিক সমাজে প্রায় এরকমই নিয়ম। কিন্তু বাঙালি পুরুষ শিক্ষিত হয়েও, শিল্পী হয়েও, সাহিত্যিক হয়েও, বুদ্ধিজীবী হয়েও পুরুষতন্ত্রের আরাম ভোগ করার জন্য পাগলপ্রায়।
বলা হয়, পশ্চিমের পুরুষের হৃদয় বলে তেমন কিছু নেই, প্রেমে বাঙালিই পড়ে, বাঙালিরই হৃদয় আছে, বাঙালিই কাঁদে। সম্পূর্ণ ভুল কথা। প্রেমের সম্পর্ক ভেঙে গেলে পশ্চিমী নারী পুরুষ উভয়কেই আমি উন্মাদের মত কাঁদতে দেখেছি। একদিন দুদিনের কান্না নয়, মাসব্যাপী কান্না। বছরব্যাপী কান্না। ছুরিতে হাত পা কাটতে দেখেছি। বিষ খেতে দেখেছি। মেট্রোর তলায় ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখেছি। মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞর কাছে দৌড়োতে হয় ভগ্ন হৃদয়ের প্রেমিক প্রেমিকাকে। পৃথিবী ঘুরে অনেক হৃদয়বান প্রেমিক দেখেছি, বাঙালি পুরুষের মতো পাষণ্ড প্রেমিক কমই দেখেছি। বাঙালি পুরুষের মতো অপ্রেমিকও আমি কম দেখেছি।
০৩. নারী শরীর
নারী শরীর নিয়ে এতকাল পুরুষেরা লিখেছেন, এঁকেছেন, গড়েছেন তাঁদের মনের মাধুরী মিশিয়ে। নারীর অধিকার ছিল না নারীর শরীর নিয়ে লেখার। মন নিয়ে লিখতে পারে, কিন্তু শরীর নিয়ে নয়। কিন্তু নারী-লেখক-কবিরা এখন পুরুষের তৈরি করা গণ্ডি ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছেন। তাঁরা তাঁদের শরীর নিয়ে তাঁদের মতো করে লিখছেন। নারীর শরীর যে পুরুষের সম্পত্তি নয়, অথবা পুরুষ-লেখক-কবিদের অধিকৃত বিষয় নয়, তা নারী-লেখক-কবিরা যদি অনুধাবন করতে পারেন, তবে সাহিত্যের জগতে খুব বড় একটি পরিবর্তন দেখা দেবে। বাঙালি সমাজ কুৎসিত পুরুষতন্ত্র দ্বারা এখনও আক্তান্ত, কিন্তু বাংলা সাহিত্যে পুরুষতান্ত্রিক নিয়মনীতিগুলো ভাঙার চেষ্টা সামান্য হলেও চলছে, সম্ভবত বাঙালি নারী-লেখক-কবিদের অনেকেই সুশিক্ষিত এবং স্বনির্ভর এবং নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন বলেই। কিন্তু সমাজে এখনও নারী অসহায়, এখনও নারী পণ্য, ভোগ্যপণ্য, যৌনসামগ্রী হিসেবেই চিহ্নিত। নারী ইস্কুল কলেজে যাচ্ছে, কিন্তু সত্যিকার শিক্ষিত হচ্ছে না। নারী উপার্জন করছে, কিন্তু পুরুষের ওপর নির্ভরশীলই থেকে যাচ্ছে। বেশির ভাগ নারীই পুরুষতন্ত্রের ধারক এবং বাহক। বেশির ভাগ নারীই জানে না যে তারা নির্যাতিত। বেশির ভাগ নারীই ভয় পায় বন্দিত্ব থেকে মুক্তি পেতে। নারীর জন্য এই অসহায় অবস্থাটি সৃষ্টি করেছে এই পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা। নারী এই সমাজে পুরুষের দাসী। খালি চোখে দাসীকে দাসী বলে মনে হয় না যদিও, সম্পর্কের গভীরে গেলেই বোঝা যায় যে দাসী। নারী যখন প্রেমিকা, সে দাসী, নারী যখন স্ত্রী, তখনও সে দাসী। উন্নতমানের দাসী। পুরুষ প্রেমিক বা স্বামীর আদেশ নির্দেশ মেনে চলতে হয় তাকে। পুরুষ যেভাবে চায়, নারীর সেভাবে নিজেকে গড়তে হয়। সাজসজ্জা, আচার ব্যবহার, দোষগুণ সবকিছুর ধারণাই পুরুষের তৈরি করা। প্রেম ভালোবাসা পুরুষের জন্য অস্ত্র, নারীকে দুর্বল করার। প্রভু এবং দাসীতে প্রেম হয় না। পণ্যের সঙ্গে আর যাই হোক, প্রেম হতে পারে না। নারী নিজের যৌনইচ্ছের কথা প্রকাশ করলে তাকে ছি ছি করে সমাজের সকলে। নারীর যৌনকামনা থাকতে নেই, থাকলে সে নির্লজ্জ, সে নষ্ট, সে বেশ্যা। নারী তার শরীর সাজাবে পুরুষের জন্য, নিজের জন্য নয়। নারী বেঁচে থাকবে পুরুষের জন্য, নিজের জন্য নয়। এরকমই তো নিয়ম। ক’জন নারী জানে সঙ্গমে শীর্ষসুখ বলে একটি ব্যাপার আছে! খুব কম নারীই জানে। বেশির ভাগই মনে করে যৌনতা পুরুষের জিনিস। নারী শুধু পুরুষের আনন্দের জন্য ব্যবহৃত হবে। শরীর নারীর, কিন্তু এতে অধিকার পুরুষের। নারী এক হাত থেকে আরেক হাতে সমর্পিত হয় সারাজীবনই। তার মালিক বদলায়। পিতা থেকে প্রেমিকে, প্রেমিক থেকে স্বামীতে, স্বামী থেকে পুত্রতে। নারীর জীবন তো নারীর নয়। বিভিন্ন সম্পর্কের পুরুষের কাছে নারী বাঁধা, শৃঙ্খলিত। এই যখন অবস্থা আমাদের সমাজের, তখন নারী-লেখক-কবিরা যখন নিজের শরীরের ওপর নিজের অধিকারের কথা লেখেন, যৌনস্বাধীনতার কথা লেখেন, তা হয়তো সমাজের সত্যিকার রূপকে তুলে ধরে না, কিন্তু একধরনের বিপ্লব, সেটি ছোটখাটো হলেও, কাগজে কলমে হলেও, ঘটায়। অনেকটা আগুনের স্ফুলিঙ্গের মতো, কেউ জ্বালিয়ে দিল, এখন কেবল ছড়িয়ে পড়লেই হলো। যে মেয়েরা লেখক-কবি নয়, তাদের মধ্যে আগুন নেই তা নয়, কিন্তু তাদের আগুন তাদের মধ্যেই থেকে যায়, প্রকাশ হয় না খুব। তাই সমাজ পরিবর্তনে শিল্পী সাহিত্যিকরা সবসময়ই খুব বড় ভূমিকা রাখে।