আবার কয়েক বছরের নৈঃশব্দ। পুরুষহীন জীবন। লেখায় পড়ায়, দর্শনে শিল্পে, বন্ধুত্বে, ভ্রমণে বুঁদ হয়ে থাকা। একসময় সুদূর ইওরোপের বাস থেকে মাঝে মধ্যেই এই বাংলায় আসা যাওয়া শুরু হয়। প্রিয় শহর, প্রিয় মানুষ। ভালোবাসায় ভরে থাকে মন। যেহেতু হৃদয়ের দুয়ার খোলাই থাকে, ঝড়ের মতো ঢুকে পড়ে এক বাঙালি পুরুষ। এ প্রেম সেই কিশোরবয়সের প্রেমের মতো। না ছুঁয়ে, না শুয়ে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন আমি রিসার্চ করছি। মন কী আর বসে ওতে। বাংলা তখন হৃদয়, বাঙালি তখন স্বপ্ন। বয়সে কুড়ি বছর বড়, অথচ তাকে তুই তোকারি প্রেমিক করে ফেলি কদিনেই। প্রেম ইমেইলে, ফোনে। প্রতিদিন কেমব্রিজ কলকাতা, কলকাতা কেমব্রিজ। প্রতিদিন সুপ্রভাত, প্রতিদিন শুভরাত। প্রেম কবিতার শব্দে অক্ষরে। প্রেমের তোড়ে জীবন ভেসে যায়। আর যেদিন প্রেমিকের সঙ্গে মিলবো বলে ছুটে আসি, সারা শরীর কাঁপছে মিলন লাগি, প্রেমিক এসে চুমুর নামে ঠোঁট কামড়ালো, আদরের নামে বুক খামচালো। তারপর গালে চিমটি কেটে টা-টা বলে চলে গেল, ওটুকুই তার প্রেম। আমি হাঁ হয়ে রইলাম! ফরাসি প্রেমিক পালকের মতো স্পর্শ করতো শরীর, আর এ কেমন স্পর্শ করা! যে সমাজে যৌনসামগ্রী ছাড়া মেয়েদের অন্য কিছু ভাবা হয় না, সেখানে এমন হিংস্রতাই তো স্বাভাবিক। তারপরও প্রেম বাধ মানে না, আকুল হই প্রেমিকের জন্য। না, দিন রাতের পাগল করা প্রেমে সে নেই। সে সন্ধেয় বা বিকেলে একটুখানির তরে দেখতে আসে, শহরের সংস্কৃতিতে পরকীয়া প্রেমের এমনই নাকি নিয়ম। প্রেমকে আমি চিরকালই প্রেম বলে মানি বলে বড় বিস্মিত হই পর আপনের শহুরে সংত্তায় আর ব্যাখ্যায়। সবচেয়ে স্তম্ভিত হই দেখে যে, এতকাল প্রেমের জলে আমাকে আকণ্ঠ ডুবিয়ে রেখে আমার প্রেমিক-পুরুষ অক্ষমাযোগ্য অপরাধ করতে এতটুকু দ্বিধা করেনি একটি সত্য লুকিয়ে, যে, সে উত্থানরহিত।
সে বন্ধু হয়ে রইল। কিন্তু চল্লিশ ছোঁয়া শরীরে তো মুহূর্মুহু বান ডাকছে। আমার কুড়ির, আমার তিরিশের শরীরেও বুঝি এত তীব্র তৃষ্ণা ছিল না। আবারও প্রেমের উতল হাওয়া আমাকে ভিজিয়ে ভাসিয়ে এক কবির মুখোমুখি এনে দাঁড় করায়। রক্ষণশীল শহরটির সংস্কার গুঁড়ো করে দিয়ে কবিকে নিয়ে যেমন ইচ্ছে উড়ি ঘুরি। কবি আমার সকাল দুপুর বিকেল। কবি আমার সন্ধে, আমার রাত। কবিকে প্রেম বুঝিয়ে বত্রিশ কলা শিখিয়ে যখন পরম প্রেমিক করে তুলেছি, দেখি কবির সারা শরীরে যৌনরোগের দাগ। জগত আমার লাটিমের মতো ঘোরে । হাতুড়ি পিটিয়ে আমাকে যেন কে ইস্পাত করতে চায়, পারে না। কবি আনন্দ আমাকে দেয় ঠিকই, যন্ত্রণা দেয় ঙ্গিগুণ। সেই প্রথম-জীবনের মতো কাঁদি আমি। না, কবি প্রেম জানে না। আমার কষ্টের দিকে ফিরে তাকানোর হৃদয় তার নেই। আমি এমনই রক্তাক্ত তখন, যে, এক শীত শীত রাতে হাতে উষ্ণ হাত রাখে এক পুরুষ, আর নিমেষে নদী হয়ে উঠি। অন্ধকারে সে স্পর্শ আমাকে ভীষণ স্রোতার্ত করে। বুঝি, ভালোবাসি। অদ্ভুত এই পুরুষ অবোধ বালকের মতো আমাকে কামগন্ধহীন প্রেমে জড়িয়ে রাখতে চায়। কেন চায়, কী চায়, কিছু তার বুঝি না। আমি কেন ঘন কুয়াশায় হাঁটবো তার সঙ্গে, যখন মেঘ সরিয়ে রোত্রুর আনবো বলে পণ করেছি!
পুরুষদের আমি অকাতরে দিয়েছি । সে প্রতারক হোক, প্রেমিক হোক, বুঝে বা না বুঝে অকৃঙ্গিম প্রেম দিয়েছি। যখন মাঝে মাঝেই রাতের হুহু হাওয়া আমার নির্জন জীবনকে খেলাচ্ছলে ছুঁয়ে যায়, বড় একা লাগে। লেখালেখির একটি জীবন আছে আমার, সে জীবনটিতে চূড়ান্ত ব্যস্ততা, লক্ষ মানুষের আনাগোনা। আরেকটি জীবন একান্তই ব্যক্তিগত। এই জীবন, জীবনের শুরু থেকে, আমি একরকম একাই যাপন করছি। হঠাৎ হঠাৎ হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো কেউ আসে, নিঃশব্দে চলেও যায়। হাতে গোনা ক’জন পুরুষকে আমি প্রেমিক নামে ডাকি, কিন্তু সম্বিৎ ফিরে পেলে এমন নয় যে স্বগোতক্তি করি না এই বলে, যে, আমার প্রেমিক হওয়ার যোগ্য আদৌ তারা নয়। প্রেমিকেরা অনেকে অনেক কারণে আমার সান্নিধ্য চেয়েছে। কেউ আমাকে ভালোবেসে আমাকে চায়নি। কেউ নামের জন্য, কেউ বিজ্ঞের জন্য, কেউ যশখ্যাতির জন্য, কেউ শরীরের জন্য, কেউ হৃদয়ের জন্য। কেবল ভয়ংকর চাই চাই দেখেছি চারদিকে। আমার নিজের চাওয়া হেলায় ফেলায় তুলোর মতো উড়ে গেছে উদাস হাওয়ায়।
তারা ঠগ। প্রতারক। হিপোক্রেট। ভীতু। ভণ্ড। তারা প্রেমিক ছিল কি একজনও? আজ বেলায় এসে, দুখের দিনগুলোকেও যে সুখের দিন ভেবে সুখ পেতাম, টের পাই। হৃদয় নিংড়ে প্রেম দিয়েছি, যাদের দিয়েছি, বুঝি তারা পুরুষ ছিল সবাই, প্রেমিক ছিল না।
০৯. রেখে ঢেকে আর নয়
রেখে ঢেকে আর নয়, জাত যাক, সে তো দুবেলাই যায়
তবু এই সত্য মানি, আমি ছাড়া কেউ নেই আমাকে বাঁচায়
ভার্জিনিয়া উলফ লিখেছিলেন খুব জরুরি একটি বই, ‘অ্যা রুম অফ ওয়ানসয়োন।’ উনিশ’শ উনত্রিশ সালে। বাপের বাড়ি স্বামীর বাড়ি ভাইয়ের বাড়ি মামার বাড়ি ছেলের বাড়ি ইত্যাদি নানা রকম বাড়িতে মেয়েদের বাস। মেয়েদের নিজের বাড়ি নেই, অন্যের বাড়িতে তাদের বাস করতে হয়। মেয়েদের টাকা পয়সা নেই, নিজের রুচি মতো জীবনযাপন নেই, প্রাইভেসি নেই। একেবারে নিজের, একার, অন্য কারও বিরক্ত করা নেই, নাক গলানো নেই, এমন ঘরের প্রয়োজন মেয়েদের প্রচণ্ড, এ কথা ভার্জিনিয়া উলফ সেই কত আগে বলেছেন। আজ না হয় পশ্চিমে মেয়েরা একা বাস করার সুযোগ এবং পরিবেশ পাচ্ছে। মেয়েরা স্বনির্ভর এখন আগের চেয়েও অনেক, সংস্কারের ভূত অনেকটাই সমাজ থেকে সরেছে। কিন্তু পুবের হাল বড় করুণ। পুবের মেয়েদের এখনও পিতৃতন্ত্র, ধর্ম আর সাতশ’ রকম সংস্কারের যাঁতাকলে পিষে মারা হচ্ছে। সমাজ-সংস্কারকরা মেয়েদের শিক্ষার এমনকী স্বনির্ভরতারও ব্যবস্থা করেছেন, তাই বলে কি অবস্থা কিছু পাল্টেছে! ক’জন মেয়ে আজ নিজের ঘরে বা নিজের বাড়িতে সম্পূর্ণ নিজের মতো করে, একা এবং সম্পূর্ণই একা জীবন যাপন করছে! নিজের উপার্জনে নিজের বাড়ি, নিজের সংসার, নিজের উড়ে বেড়ানো ঘুরে বেড়ানো, নিজের যা ইচ্ছে তাই, নিজের স্বাধীনতা স্বেচ্ছাচার ক’জন মেয়ের আছে! কেউ কেউ যারা যাপন করতে যায় এমন জীবন, তাদের কিন্তু ঝাঁক ঝাঁক পুরুষ অহর্নিশি পরামর্শ এবং উপদেশ বর্ষণ করে চলে। সুতরাং একা থাকার আনন্দ শেষ পর্যন্ত মেয়েরা সত্যিকার উপভোগ করতে পারে না।