প্রেম এরপর দুপুরের ঝিরঝিরে হাওয়ার মতো জীবনে পরশ বুলিয়ে যায়। পালকের মতো সামান্য ছোঁয়া। কেউ একদিন মুগ্ধ চোখে তাকিয়েছিল, কেউ একদিন হাত ধরে হাঁটলো, কেউ একদিন শুধু কানে কানে একটি গান শুনিয়ে গেল। তারপর দীর্ঘ দীর্ঘ সময় জুড়ে উতল যৌবন জুড়ে একা থাকা। যে একা থাকা নিজের প্রতি আমার আত্মবিশ্বাস, আমার শ্রদ্ধা সহস্রগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। আমাকে দৃঢ় করেছে আরও, দুর্বিনেয় করেছে। স্বনির্ভর একজন চিকিৎসক-লেখক একা বাস করছি। নারীর স্বাধীনতার জন্য আগুন আগুন লেখা লিখছি। দেশ উত্তাল। কিন্তু হৃদয়ের দুয়ার হঠাৎ হাট করে খুলে যায় কোনও ফাগুন হাওয়ায়। চোখের সামনে আশ্চর্য সুন্দর এক যুবক দেখি একদিন। যুবকের দীর্ঘাঙ্গ, যুবকের চুল চোখ নাক ঠোঁট চিবুক আমাকে টানে, ফিরে ফিরে দেখি যুবককে। একদিন তো এত অপলক তাকিয়ে ছিলাম, যে, লজ্জায় যুবক বারবার চোখ সরিয়ে নিচ্ছিল। চোখে আমার মুগ্ধতা, আমার মুগ্ধতার একশ তীর গিয়ে তার গায়ে কি বিঁধছিল না! একদিন কমলার রসের সঙ্গে কয়েকফোঁটা ভদকা পান করে মাতাল হলাম। আর যেই না টলোমলো পা, যুবক তার হাত দিল বাড়িয়ে। সেই স্পর্শ আমাকে আরও বেশি মাতাল করলো, আমার প্রতি অঙ্গ তার প্রতি অঙ্গ লাগি কাঁদিল। সেই শুরু তীব্র তীক্ষ্ণ দুর্দমনীয় প্রেমের। সেই প্রথম কোনও বিবাহিত পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক হল আমার। না, আমার কোনও উপায় ছিল না তাকে না ভালোবেসে। সারা শহর তাকে নিয়ে ঘুরছি। রাস্তায় হাত ধরে হাঁটছি। বন্ধুদের আত্তায় আমি, সঙ্গে সে। বাড়িভর্তি স্বজন আত্মীয়, যুবককে নিয়ে আমি নিভৃত নির্জন ঘরে। হ্যাঁ, যুবকের সঙ্গে আমার প্রেম, তাকে নিয়ে আমি মগ্ন হব, মঙ্গ হব। কার কী বলার আছে! না, কারওর নেই। আমার স্বাধীনতাকে এত তীব্র করে উপভোগ আগে আর করিনি। আমার সৌন্দর্য, ব্যক্তিত্ব, আমার অধিকারবোধ, আমার মনুষ্যত্ব, মানবতা, আমার প্রাণময়তার কাছে যুবক বড় ম্লান। যুবকের সঙ্গে প্রেম এবং নিশ্চিত পৃথকবাস আমাকে প্রশান্তি দিয়েছে প্রচুর। আমার জীবন যাপনে, আমার লেখায়, রেখায়, আমার নান্দনিক যা ইচ্ছে তাই-এ প্রেমিকের অবাধ প্রবেশ নেই, তার নাককানমাথা গলিয়ে দেবার নেই। কিন্তু যখন প্রেম জাগছে, আমি তাকে চুমু খাচ্ছি, পালজ্ঞে শুইয়ে গায়ে তার প্রেমের পালক বুলোচ্ছি, স্রোতে নামিয়ে ভিজিয়ে ভাসিয়ে একাকার করছি, তুমুল তুফানে হারাচ্ছি। তাকে প্রেমিকে নির্মাণ করি আমার ত্যাগে নয়, বিসর্জনে নয়, প্রেমে। প্রেমিক আমাকে ছাড়া বাঁচবে না, এমন। জগতে তার আমি ছাড়া কেউ নেই, তখন এমন। আর সেসময়ই আমার লেখা, আমার নীতি আদর্শ, সমতার জন্য আমার লড়াইএর বিপরীতে জমা হচ্ছে লোক। শঠবাদ, পুরুষবাদ, মৌলবাদ আমার ফাঁসি চেয়ে মিছিল করছে, আমার রক্ত নিতে ধেয়ে আসছে, সেদিন একদিন প্রাণ বাঁচাতে পালাচ্ছি আমি, রাতের চাদর মুড়ে দৌড়োচ্ছি। তখন প্রেমিককে খুঁজি, কোথায় সে? না সে নেই। নিরাপদ দূরত্বে সে তার বিবাহিত জীবন যাপন করছে। বিশ্বাস ধ্বসে পড়ে প্রবল ভূমিকম্পে ন-তলা দালানের মতো।
এরপর উত্তর ইওরোপের শীতার্ত নির্বাসন জীবন। একাকীত্বের সুঁই বিঁধছে আমার সর্বাজ্ঞে। বছরের পর বছর উড়ে যাচ্ছে উদাসী হাওয়ায়। এক দেশ থেকে আরেক দেশ। খ্যাতির মধ্যে খাবি খাচ্ছি। কিন্তু হৃদয়ে খরা। শরীর শ্যাওলা পড়া। ওই শ্যাওলা পড়া শরীর এক নির্জন দুঃসহ রাতে পুরুষের স্পর্শে কাঁপলো ভীষণ। সামান্য ঘনিষ্ঠতায় আমার একত্রবাস শুরু। কিন্তু কদিনেই আমি বুঝি আমি পুরুষ চাই না, আমি প্রেম চাই। প্রেম পেতে পেতে বছর গড়ালো। ফরাসি এক যুবক, বয়সে বছর ছয়েকের ছোট। উতল প্রেমে দুজন ভাসলাম। তখন আমি প্যারিসবাসী, তখন আমি প্রেমের শহর, আমি তিরিশের শেষদিক। ফরাসি প্রেমিক তুলুজ শহর থেকে ছুটিছাটায় ছুটে ছুটে প্যারিস আসে। সেইন নদীর পাড়কে আমরা চুমু খেতে খেতে স্নিগ্ধ করি। বিমানে, গাড়িতে, বাসে, নৌকোয়, বারে রেস্তোরাঁয়, পথে ঘাটে পরস্পরকে গাঢ় আলিঙ্গন করে গভীর গহন চুমু খেয়ে যাচ্ছি। না কাউকে দেখাতে নয়। কেউ যে আছে আমাদের চারপাশে তা তো ভুলে যাই। আমরা তো জগত ভুলে ছিলাম। প্রেম এমনই। অন্ধ করে রাখে। বাঙালি পুরুষের কাছ থেকে প্রেমের যে পাঠ নিয়েছিলাম, তা ফরাসি প্রেমিক প্রমাণ করে দেয় যে, নির্ভুল নয়। সারা শরীর যে প্রেমে, যে শ্রদ্ধায় স্পর্শ করে প্রেমিক, দেখে মুগ্ধ হই। না, প্রেম যে এত সুন্দর, এত যে সমতার, এত গৌরবের, আগে জানিনি। তার চুম্বন, তার আলিঙ্গন, তার পূর্বরাগ আমাকে প্রেমের অন্য ভুবন চেনায়। যে ভুবনের ঙ্গিসীমানায় কোনও বাঙালি পুরুষ আমাকে নেয়নি আগে। যৌনতা যে একটি অসামান্য শিল্প, এর আগে আমি শিখিনি। আমার নির্জনতা চুরচুর করে ভেঙে ফরাসি প্রেমিক সত্যি আমাকে একটি আকাশ দিয়েছিল। আমাকে শিখিয়েছিল সত্যিকারের শরীরী-প্রেম। কিন্তু মুশকিল হল, প্রেমিক আমাকে চায়। তার একার করে চায়। চায় আমি তার সঙ্গে একত্রবাস করি। প্যাশনপূর্ণ প্রেম তার, প্রচণ্ড প্রেম। আমাকে না পেলে সে আত্মহত্যা করবে। তার জীবনের কোনও আর অর্থ রইল না। না, আমি বলে দিই, প্যারিস ছেড়ে কেবল তার সঙ্গে বাস করার জন্য তুলুজে যাবো না। তুমি বরং চলে এসো প্যারিস। অথবা এভাবেই হবে প্রেম পৃথকবাসে। প্রেমিক তা মানে না। মনে করে আমি তাকে তুচ্ছ করছি। অভিযোগ করে সে আমার টয়বয়, অন্য কিছু নয়। আকুল হয়ে কাঁদে। তুমি তো বিখ্যাত, তুমি কেন আমার মতো অখ্যাত কাউকে ভালোবাসবে! ভালোবাসা কি খ্যাত অখ্যাত দেখে হয়! কে শোনে আমার কথা! প্রেমিক কাঁদে ঠিকই, কিন্তু পরক্ষণেই দাঁতে দাঁত চেপে আমাকেই শুয়োরের বাচ্চা বলে। পুরুষের আদেশ না মানলে পুরুষ ছিঁড়ে কামড়ে খেতে পারে। প্রেমেও তত নয়, নিয়ন্ত্রণে যত সুখ পুরুষের। একদিকে তার ঈর্ষা, হীনম্মন্যতা আর অন্যদিকে আমার দৃঢ়তা আমাদের সম্পর্ককে এক টানে বিচ্ছেদের পাড়ে দাঁড় করিয়ে দিল। প্রেমের জন্য জীবন উৎসর্গ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। বিশাল একটি পৃথিবী আমার সামনে, কোনও ক্ষুদ্র গঙ্গিতে শখ করে বাঁধা পড়বো, না হয় না তা। আর প্রেম প্যাশন যৌনতার যাবতীয় সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম শিল্প বাদ দিলে পুব-পশ্চিমের সব পুরুষই একটি মানসিকতার কাছে আত্মসমর্পণ করে, তারা বুঝি নারীর চেয়ে বেশি কিছু, বড় কিছু। এই মিথ্যের সঙ্গে আপোস করবো কেন আমি?