বারণ সত্ত্বেও যারা ভাঙে, যারা দাবি জানায়, নিজের অধিকারের কথা জোর গলায় বলে, ছিনিয়ে নেয়, কেড়ে নেয়, পেছনে তাকায় না, লোকের থুথু ঘৃণাকে মোটেও পরোয়া করে না, বৈষম্যের প্রতিবাদ করে, অঘটন ঘটায়, তারা চিরাচরিত বাঙালি নারীর শ্বাসরুদ্ধকর জীবনের ছক থেকে বেরিয়ে আসা মেয়ে। তারা বাঙালি নারীর ওই ঘোমটা পরা সিঁদুর পরা পুরুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তি হওয়া চেহারাটি ছুড়ে দিয়ে নতুন চেহারা আনছে। তারা সংখ্যায় খুব কম। কিন্তু তারা যদি নারীর নিত্য নিষ্পেষণ থেকে নারীকে বাঁচায়, তাবৎ নারীকে সচেতন করে তোলে, নারী যেন ঘোমটা খুলে সিঁদুর মুছে বলে ওঠে, ‘পুরুষের সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক থাকলেও আমাদের পরিচয় পুরুষের মা বোন কন্যা বা দিদিমা ঠাকুমা জেঠিমা কাকিমা নয়, আমরা পৃথক অস্তিত্ব, আমরা পুরুষের বা পুরুষ শাসিত সমাজের সম্পত্তি নই, আমরা মানুষ। আমরা মানুষের অধিকার নিয়ে বাঁচি, আমাদের স্বাধীনতার পথে ধর্ম, সংস্কৃতি, রীতি, আইন কিছু বাধা হয়ে দাঁড়ালে সেই বাধা আমরা পায়ে মাড়িয়ে যাই’ — তবেই না পুরুষতন্ত্র-অংকিত নতমুখী-সেবাদাসী-বাঙালি-নারী মানুষের মতো মানুষ হয়ে উঠবে। বাঙালি নারীর নতুন সংত্তা তৈরি হবে, প্রতিবাদী, বুদ্ধিমতী, সমতায় বিশ্বাসী, সবল, সচেতন, সাহসী, দৃঢ়, দুর্বিনীত । বাঙালি হয়ে তখন গৌরব হবে আমার।
০৮. আমার প্রেমিকেরা
প্রেম শব্দটি আমার শৈশব কৈশোরে নিষিদ্ধ একটি শব্দ ছিল। সবে প্রেম করার বয়সে পড়লাম, কিশোর যুবকরা আমার দিকে ফিরে ফিরে তাকায়, আমারও ইচ্ছে করে ওদের দেখতে, তখন প্রেম নিষিদ্ধ। আর যা কিছুই করি, প্রেম যেন না করি। অথচ সিনেমা দেখছি, প্রেম। থিয়েটার দেখছি, প্রেম। গল্প উপন্যাস পড়ছি, প্রেম। গান শুনছি, প্রেম। সবখানে প্রেম কিন্তু জীবনে প্রেম চলবে না। যে যত প্রেমহীন জীবন কাটাবে, সে তত ভালো। এভাবে এই পরিবেশে বড় হয়েছি আমি। নিষিদ্ধ জিনিস বলেই বোধহয় আগ্রহ জাগতো প্রেমে। প্রেম করছি বলে বাবার মার খেতে হত অনেক। বাবা চাবুক দিয়ে পেটাতেন, ঘরবন্দি করতেন, ভাত বন্ধ করতেন, দিনরাত ‘ছাত্রাণাম অধ্যয়নং তপঃ’ বলা বাবা এমনকী আমার ইস্কুল কলেজও বন্ধ করে দিতেন।
কিশোরবয়সে দুএকটি ছেলেকে আমার বেশ লাগতো। দূর থেকে একটু দেখা, আর মাঝে মাঝে ভালোবাসি-চিরকুট জীবন ভরিয়ে রাখতো। প্রেম কী করে করতে হয় শিখেছি ছোটদার কাছ থেকে। ছোটদা আমার চেয়ে আট বছরের বড়। পাড়ার এক মেয়ের সঙ্গে প্রেম করতো। সেই মেয়েকে লেখা ছোটদার প্রেমের চিঠিগুলো আমি লুকিয়ে লুকিয়ে পড়তাম। ছোটদা বাড়ির বাইরে বেরোলেই তার টিনের ট্রাঙ্ক খুলে চিঠি বার করতাম। টিনের ট্রাজ্ঞে পুরোনো খবরের কাগজ পেতে ছোটদা তার নানান জিনিস রাখতো, চিঠিগুলো থাকতো সেই পুরোনো খবরের কাগজের তলায়। প্রতিদিনের চিঠি ওখানে জমা হয়ে থাকতো, ছোটদা সুযোগ সুবিধে পেলে মেয়ের জানালায় গিয়ে কেউ যেন না দেখে চিঠি চালান করতো। প্রেম পরে ছোটদা আরেকজনের সঙ্গে করেছে, ওকেও ওরকম চিঠি লিখতো। কত যে সে ভালোবাসে ডলি পালকে বা গীতা মিত্রকে, তার অসাধারণ বর্ণনা থাকতো চিঠিতে। ওসব চিঠি পড়েই প্রেম কী জিনিস, বুকের কাঁপন কী জিনিস, নির্ঘুম রাত কী জিনিস আমি জেনেছি। ওই সময়েই বড়দার তোশকের তলায় রাখা বড়দের পত্রিকা ‘কামনা’ পড়ে যৌনতায় আমার হাতে খড়ি।
ওই কিশোরবয়সেই আমার লেখালেখি শুরু হয়ে যায় পত্রিকায়। শিল্প সাহিত্য সিনেমা সবকিছুর মিশেল পত্রিকাগুলো খুব জনপ্রিয় ছিল তখন। তখন পত্রমিতালির রমরমা অবস্থা। আমি যেই না কিছু লিখি পত্রিকায়, অমনি পত্রমিতালির আমন্ত্রণ জানিয়ে আমার ঠিকানায় দুশ চিঠি। সবই তাজা তাজা যুবকদের। অনেকে ছবি পাঠাতো। যাদের ছবি বা হাতের লেখা বা চিঠির ভাষা পছন্দ হত তাদের উত্তর লিখতাম, কেউ দুদিনেই বন্ধু হত, কেউ নিমেষে বড় ভাই হয়ে উঠত, রাজ্যির উপদেশ বর্ষণ করতো। দূরের দূরের শহরে অচেনা যুবকদের কাছে চিঠি লিখতে লিখতেই একদিন প্রেমের চিঠি লিখতে শুরু করি। এক কবির কাছে। তখন আমি নিজেই ছোট একটি কবিতা-পত্রিকার সম্পাদক এবং প্রকাশক। বয়স সতেরো। কবি যেহেতু প্রেম নিবেদন করেছে, আমাকেও সে প্রেমে সাড়া দিতে হবে, ব্যাপারটি এমন। মাথায় ছোটদার প্রেমের চিঠিগুলো আর সন্ধে হলেই শিস দিয়ে পাশের বাড়ির জানালায় ভেসে ওঠা মেয়ের দিকে তার তাকানো। কবিকে আমি তখনও দেখিনি, কবির বয়স কত, বাড়ি কোথায়, কী পড়ে কী করে কিছুই জানি না, আর কথাচ্ছলে ‘জীবন’ চাইলো সে, অমনি আমিও বলে বসলাম, ‘এ আর এমন কী, নাও।’
কবির প্রেমে সাতসমুদ্র সাঁতার কাটা শেষ হলে কবির সঙ্গে দেখা হয়, প্রথম দেখা। চোখ তুলে তাকাতে পারিনি লজ্জায়। ভাববাচ্যে দুতিনটে বাক্য উচ্চারণ করে দৌড়ে বাড়ি ফিরেছি। পছন্দ হয়নি কবির দৈর্ঘ্য প্রস্থ। দাড়িগোঁফ। কিন্তু না হলেও মাথায় তো ‘প্রেম’ ব্যাপারটি, যার প্রতি তীব্র আমার আকর্ষণ। আমি তখন তন্বী সুন্দরী, আমি তখন কবিতা লিখি, মেডিক্যালের প্রথম বর্ষ। কবির কবিতা আমি ভালোবাসি। আর ভীষণভাবে ভালোবাসি প্রেম। ওই প্রেম আর কবিতার কাছে পরাজিত হয় কবির বাইরের রূপ। হলে কী হবে, লজ্জাবতী নারী তো চোখে চোখ রাখে না। পাঁচ বছর সময় লেগেছে প্রেমিককে তুমি বলে সম্বোধন করতে। শুয়েছি বিয়ে করারও কয়েক বছর পর। বিয়ে করেছি গোপনে, নোটারি পাবলিকের কাগজে। বাড়ির কেউ জানে না। বাবা জানলে খুন করবেন, এটা অনুমান করেছিলাম বলেই গোপন রেখেছিলাম বিয়ের খবর। আমি ডাক্তারি পড়ছি, আর আমার প্রেমিক এক উদাস বাউত্রুলে, পথে পথে ঘোরে আর আত্তা দিয়ে বেড়ায়। কবি আর আমি দুজন দু’শহরে। রাত জেগে জেগে কবির কাছে চিঠি লিখি। কবির চিঠি আসে প্রতিদিন, চিঠিগুলো বারবার পড়ি। চিঠি তো নয়, যেন কবিতা। হলুদ রঙের খামে সেসব চিঠি। খাম হাতে নিতেই বুকের ভেতর কী রকম যেন করতো। সেই ‘কীরকম করা’টি ঠিক কী রকম, তা আজও আমি বুঝিয়ে বলতে পারি না। চিঠিগুলো না পড়ে অনেকক্ষণ হাতে রাখতাম, চিঠি থেকে কী যেন কী উঠে এসে আমাকে শীতল করতো। জলপতনের শব্দ টের পেতাম। ঝেঁপে কোথাও বৃষ্টি নামতো! অপেক্ষার প্রহর একদিন ফুরোয়। একদিন আমি আমার স্বজন বন্ধুদের কাঁদিয়ে ভাসিয়ে কবির হাত ধরে বেরিয়ে যাই। ছোটদাও ঠিক এরকম করেছিল, গীতা মিত্রর জন্য বাড়িঘর সব ছেড়েছিল। সংসারে ছোটদা যা যা করেছে প্রেমে পড়ে, আমিও ঠিক তাই তাই। ছোটদার ওই টিনের ট্রাজ্ঞে লুকোনো চিঠিগুলোর মধ্যেই এমন তীব্র প্রেমের বীজ অত্রুরিত ছিল যে সে মহীরূহ হয়ে ছোটদাকে যেমন আঁকড়েছিল, একইরকম আমাকেও। কিন্তু আষ্টেপৃষ্টে আমাকে এমনই বেঁধেছিল ওই প্রেম যে আমি দেখতে পাইনি প্রেমিক আসলে ভালো আমাকে বাসে না, যেখানে সেখানে রমণী পেলেই রমণ করে আর ক্তমাগতই আমাকে মিথ্যে বলে। তার কাছে প্রেমিকার এবং গণিকার শরীরে কোনও পার্থক্য নেই। সে শুধু প্রথামতো একটি স্ত্রী চায়, স্ত্রীর সেবা চায়, আর রাতে রাতে বিনে পয়সার নিশ্চিত সম্ভোগ চায়। প্রেমিকের শরীরে যৌন ব্যাধি, যে ব্যাধিতে আমাকে সংক্তামিত করতে সে সামান্যও দ্বিধা করে না। না, সে প্রেমিক ছিল না, ছিল শুধুই পুরুষ। যে কোনও পুরুষ। আমিই কেবল বধির বোকা বালিকা প্রেম প্রেম বলে উন্মাদ হয়েছিলাম।