সেদিন গুন্টার গ্রাসের পাঠ মন দিয়ে শুনেছিলাম। আমি কি জার্মান জানি। জানি, তারপরও শুনেছি। হাজার হাজার মানুষ শুনেছে, দাঁড়িয়ে, বসে। তিল ধারণের জায়গা ছিল না। কী আশ্চর্য। মানুষ তাঁর সঙ্গে একমত নয়, কিন্তু মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছে। কেউ চিৎকার করে উঠছে না, কেউ গালি দিচ্ছে না, কেউ সামান্য শব্দ করছে। না। পিন পতন নিস্তব্ধতার মধ্যে তিনি বই থেকে পাঠ করলেন। কতক্ষণ? দুঘণ্টা? হ্যাঁ দুঘন্টাই। আমার মতো অস্থির মানুষও একটিও জার্মান শব্দ না বুঝে দুঘণ্টা বসে রইলাম। আসে কিছু কিছু সময় মানুষের জীবনে, যখন চারপাশের সব কিছু অনুভব করা যায়, ভাষা বোঝার দরকার হয় না।
গুন্টার গ্রাস আজ মারা গেছেন। বয়স হয়েছিল ৮৭। ভালো যে নোবেল কমিটি এত বড় লেখককে নোবেল প্রাইজটা দিয়েছিলেন। নোবেল না পেলেও গুন্টার গ্রাস গুন্টার গ্রাসই থাকতেন, নোবেল কমিটিকে লজ্জায় মাথা হেঁট করতে হতো।
গুন্টার গ্রাসের অতুলনীয় প্রতিভাকে শ্রদ্ধা করি। কিন্তু আজও জানি না তিনি কেন এত দীর্ঘদিন লুকিয়ে ছিলেন যে তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি বাহিনীর এসএস ছিলেন।
গুলাম আলী
গুলাম আলির বোম্বে প্রোগ্রাম বাতিল, পুনে প্রোগ্রাম বাতিল। বাতিল করার পেছনে কে? হিন্দু মৌলবাদী দল শিব সেনা। কেন? পাকিস্তানিরা ভারতীয়দের মারছে, সুতরাং ওদের টেররিজম বন্ধ না হলে ওদের কেউ এদেশে গাইতে পারবে না। আমার কথা,গুলাম আলি গায়ক মানুষ, ওর দোষটা কী, ও তো ভারতে বোমা মারতে আসিনি, বেচারা গান গাইতে এসেছে। কেউ কেউ বললো গুলাম আলি হিন্দুদের কাফের বলেছে। আমার কথা যা ইচ্ছে তাই বলুক, সাংস্কৃতিক আদান প্রদান বাড়লে দুদেশের সম্পর্ক ভালো হবে, একদিন মারামারিটাও বন্ধ হবে। কে শোনে কার কথা। টুইটারে আমাকে তো শিবসেনার ভক্তরা বললো, তুই অত গুলামের হয়ে লড়ছিস কেন, ভারতকে হিন্দু সৌদি বলছিস তো, ভারত থেকে তুইও বেরিয়ে যা।
আমি না হয় বেরিয়ে গেলাম। কিন্তু অন্যায় দেখলে কথা তো আমি কইবোই। পৃথিবীটাকেই যখন আমার নিজের একটা গ্রাম মনে করি, ছায়াপথটাকে রাজ্য, আর ইউনিভার্সটাকে দেশ, তখন কোথাও গড়বড় হলে আমি চিল্লাবো না তো কে চিল্লাবে!
হঠাৎ শুনি পশ্চিমবাংলার মমতা বিবি গুলাম আলিকে কলকাতায় গাইতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। এক শিল্পীকে লাথি মারো, আরেক শিল্পীকে আমন্ত্রণ জানাও। কারণটা কী? কারণটা হলো উর্দুভাষী অশিক্ষিত কূপমণ্ডুক ইমামের দল, যাদের টাকা পয়সা দিয়ে, যা ইচ্ছে তাই করার ক্ষমতা দিয়ে পুষছেন তিনি তারা তাদের অশিক্ষত শিষ্যদের বলে দেবে বিবিকে ভোট দিও, ভোট-পাগল বিবি ইমামদের খুশি করতে তাই গুলাম আলিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। ইমামরা পাকিস্তানি মুসলিম গুলাম আলিকে পেয়ে আহ্লাদে আটখানা হবে, কারণ মনে মনে পাকিস্তানই তো তাদের আসল স্বদেশ, মুসলিম ভ্রাতৃত্বই তো তাদের আসল ভ্রাতৃত্ব!
তসলিমার বই উদ্বোধন বন্ধ করো, তসলিমার মেগা সিরিয়াল বন্ধ করো, তসলিমার এন্ট্রি বন্ধ করো রাজ্যে, তসলিমার লেখা যেন কেউ না ছাপায় মিডিয়াকে সাবধান করে দাও, তসলিমার বই যেন কেউ প্রকাশ না করে পাবলিশারদের হুমকি দিয়ে দাও, তসলিমার গল্প নিয়ে ফিচার ফিল্ম কেউ যেন না বানায় টালিগঞ্জে জানিয়ে দাও –এসব কাজ মমতা বিবি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই করে গেছেন। কেন তসলিমার প্রতি তাঁর এত ঘৃণা? তসলিমার ৪০টা বইয়ের তো লক্ষ লক্ষ পাঠক পশ্চিমবাংলায়, তবে? তাকে ভালোবাসার, শ্রদ্ধা করার লোকেরও তো অভাব নেই, তবে? মুশকিলটা হলো, তাঁর পেয়ারের ইমামরা তসলিমাকে ঘৃণা করে। ইমামরা ঘৃণা করে কারণ ইসলাম ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন করেছিল তসলিমা, কারণ মেয়েদের অধিকারের দাবি করেছিল তসলিমা। মমতা বিবি মুসলিম মৌলবাদীদের গুলাম সেজেছেন। মৌলবাদীরা কাউকে ঘৃণা করলে তিনিও তাকে ঘৃণা করেন। নিজের বোধবুদ্ধি গঙ্গার জলে অনেক আগেই বিসর্জন দিয়েছেন। তসলিমাকে পারলে চাপাতি দিয়ে কোপাবেন তিনি।
আজ গুলাম আলিকে কোনও কারণে কলকাতার মুসলিম মৌলবাদীরা পছন্দ না করলে গুলাম আলিকেও মমতা বিবি নিষিদ্ধ করবেন কলকাতায়। চ্যালেঞ্জ।
গৃহকর্মীদের নির্যাতন করছে গৃহকর্ত্রীরা!
কিছু কিছু তথ্য শুনলে আঁতকে উঠি, যেমন বাংলাদেশের গৃহকর্মীদের গড় বেতন ৫১০ টাকা। শুধু ঢাকা আর চট্টগ্রাম শহরে গৃহকর্মীর সংখ্যা কুড়ি লাখ, এদের মধ্যে ৮৩ শতাংশ নারী, অনেকে শিশু। যৌন নির্যাতনের শিকার শতকরা ১৬.৬৭। ২০০১ থেকে ২০১০- এই দশ বছরে নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছে ৩৯৮ জন গৃহকর্মী, আহত হয়েছে ২৯৯ জন। আমার মনে হয়, নির্যাতনের শিকার আর ধর্ষণের শিকার আরও বেশি গৃহকর্মী। সঠিক সংখ্যাটি হয়তো লুকিয়ে রাখা হচ্ছে। তারপরও ভালো তো কিছু লোক আছে দুনিয়ায়, ভালো সংগঠনও আছে। তারা গৃহশ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, গৃহশ্রমিকদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি ও শ্রম আইনে তাদের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করার দাবি জানাচ্ছে। জানি না আদৌ গৃহকর্মীরা তাদের প্রাপ্য সেই অধিকার পাবে কি না।
গৃহকর্মীদের ওপর অত্যাচার গরিবের ওপর ধনীর অত্যাচার। গৃহকর্মীরা যেহেতু সাধারণত নারী, তাই গৃহকর্মীদের বিরুদ্ধে যে নির্যাতন চলে, তা নারী নির্যাতনের অংশও, গার্হস্থ্য হিংস্রতার বা ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের অংশও। সমতার সমাজ যতদিন না গড়ে উঠবে, যতদিন না ধনী আর গরীবের মাঝে ফারাকটা কমবে, ততদিন নির্যাতন চলবে। তবে গৃহকর্মীরা এখন সংখ্যায় অগুনতি নয় বলে তাদের অবস্থার উন্নতি চোখে পড়ে। ছোটবেলায় দেখতাম, চাইলেই আশেপাশের বস্তি থেকে কাজের মেয়ে জোগাড় করে আনা যায়। সেইসব মেয়েকে দিয়ে অমানুষিক পরিশ্রম করানো হতো। মশলা বাটা,পানি টানা,কাপড় ধোয়া, ঘর মোছা। বিনিময়ে হয়তো শুধু দুবেলা ভাত জুটতো। আমাদের বাড়িতে কাজ করতো অল্প বয়সী কিছু মেয়ে। ওরাও হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে পেতো সামান্য কটা টাকা। মণি নামের এক কিশোরী কাজ করতো, ওর মাইনে ছিল মাসে পাঁচ টাকা। ভোর থেকে মধ্যরাত মুখ বুজে কাজ করতো। এদিক ওদিক তাকাবার অবকাশ ছিল না। ওরা প্রায়ই মার খেতো। মার খাওয়াটা ওদের জন্য খুব স্বাভাবিক ছিল। শুধু চড় থাপ্পড় নয়, রীতিমত লাঠিসোটার মার। মার খেয়েও মেয়েরা থাকতো বাড়িতে। দারিদ্র মানুষকে কত যে আপোস করতে শেখায়, কত যে নির্মমতা মানুষ মেনে নিতে বাধ্য হয়!