এই সকল কথা যদি তোমরা একটু ভাবিয়া দেখ, তাহা হইলে প্রাণীরা কেমন ধাপে ধাপে উন্নতির দিকে চলিয়াছে তাহা বেশ বুঝিতে পারিবে। আমরা চতুর্থ শাখার যে দুই-একটি প্রাণীর পরিচয় দিব, তোমরা তাহাদের দেহের আরো উন্নতির কথা শুনিবে। কিন্তু বড়ই দুঃখের বিষয়, এই প্রাণীদের প্রায় সকলেই সমুদ্রে থাকে। আমাদের দেশে সমুদ্র নাই, কাজেই তাহাদিগকে খোঁজ করিয়া লইয়া তোমরা পরীক্ষা করিবার সুবিধা পাইবে না। যাহারা সমুদ্রের ধারে বাস করে, এই সকল প্রাণী তাহারা সর্ব্বদাই দেখিতে পায় এবং দেখিয়া শুনিয়া পরীক্ষা করিতে পারে।
তারা-মাছ
চতুর্থ শাখার প্রাণীদের মধ্যে তারা-মাছই প্রধান। আমি জ্যান্ত তারা মাছ কখনো চোখে দেখি নাই, তোমরাও হয় ত দেখ নাই। ইহারা সমুদ্রের জলে বাস করে। মান্দ্রাজের উপকূলে ইহাদের সন্ধান পাওয়া যায়। আটলান্টিক্ মহাসাগরের ঠাণ্ডা জলেই কিন্তু তারা-মাছ অনেক থাকে। এই প্রাণীদের বাংলায় কোনো নাম নাই। ইংরাজিতে Star Fish বলে, তাই আমরা ইহাদিগকে তারা-মাছ বলিলাম।
তারা-মাছের মুখ আছে, পেট আছে, নিশ্বাস টানিয়া লইবার যন্ত্র আছে, পা দিয়া চলিয়া যাইবার শক্তি আছে, আবার বাহির হইতে কোনো আঘাত পাইলে তাহা বুঝিয়া নড়াচড়া করিবার ক্ষমতাও আছে। ইহারা নিতান্ত ছোটো প্রাণী নয়। তাহা হইলে দেখিতেছ, কুকুর, বিড়াল, মানুষ প্রভৃতি জন্তুরা দেহের নানা অংশ দিয়া যেমন জীবনের নানা কাজ করে, ইহারাও কতকটা সেই রকমেই জীবন কাটায়। কিন্তু তথাপি ইহারা বড় বড় জন্তুদের চেয়ে অনেক নিকৃষ্ট। যে-সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থাকিলে প্রাণীরা খুব উন্নত হয়, তাহারি একটু একটু আভাস ইহাদের শরীরে পাওয়া যায় মাত্র।
এখানে একটি তারা-মাছের ছবি দিলাম। আকাশের নক্ষত্র হইতে যেমন আলোর রেখা বাহির হয়, ইহার শরীর হইতে সেই রকম হাতের মত পাঁচটি অংশ বাহির হইয়াছে। শরীরের আকৃতি কতকটা তারার মত। এই জন্যই ইহাদিগকে তারা-মাছ বলা হয়। ইহারা সমুদ্রের তলে, সমুদ্রের অল্প জলে, পাথরের গায়ে বা পাথরের ফাটালে লুকাইয়া বাস করে। শরীরটা এক-কোষ প্রাণীদের মত নয়, ইহাতে মাংস এবং হাড়ের মত শক্ত চূণো পাথর দুইই আছে। চূণো পাথরগুলি শরীরের মধ্যে মাংস দিয়া ঢাকা থাকে। কিন্তু সেগুলি পরস্পর জোড়া থাকে না, কাজেই ইহারা যেমন ইচ্ছা সাপের মত শরীরটা নোয়াইতে পারে; একটুও আড়ষ্ট ভাব নাই। তা ছাড়া গায়ের উপরে সজারুর কাঁটার মত অনেক কাঁটাও লাগানো থাকে; শত্রুরা এই কাঁটার ভয়ে কাছে ঘেঁষিতে পারে না। শুঁয়ো পোকারা যেমন অনেক ছোট ছোট পায়ের মত অংশ দিয়া চলিয়া বেড়ায়, ইহারাও সেই রকমে চলে। কিন্তু ইহাদের পা দেহের নীচে লুকানো থাকে, চলিবার সময় সেগুলিকে বাহির করিয়া ইহারা চলাফেরা করে।
অনেক প্রাণীরই মুখ শরীরের উপরের দিকে বা পাশে থাকে। কিন্তু তারা-মাছের মুখ একবারে দেহের তলায় দেখা যায়। ছোট মাছ, গুগ্লি বা শামুক কাছে পাইলে ইহারা সেই ছোট পা বাহির করিয়া অতি ধীরে ধীরে শিকারের কাছে যায় এবং তাহাকে শরীরের তলায় ফেলিয়া তাহার সার ভাগ চুষিয়া লয়। খাওয়া শেষ হইলে দেখা যায়, শিকারের হাড়গোড় খোলা সব পড়িয়া আছে, কিন্তু শরীরের সারবস্তুটা নাই।
যখন তারা-মাছ বড় বড় শামুক বা সমুদ্রের শঙ্খ শিকার করে তখন ইহাদের ছোট মুখের ভিতরে ঐ রকম বড় শিকারের জায়গা হয় না। এই অবস্থায় তারা-মাছ যা করে তাহা বড় মজার। ইহাদের পাঁচটা হাতের ভিতরে পাক-যন্ত্রের পাঁচটা থলি থাকে। বড় শিকারের গায়ের উপরে উঠিয়া ইহারা সেই পাঁচটা হাত হইতে থলি বাহির করে এবং সেইগুলি দিয়া শিকারকে জড়াইয়া ধরে। শিকারের দেহে যে সারবস্তু থাকে, তারা মাছেরা শিকারকে না গিলিয়াই এই রকমে হজম করিয়া ফেলে।
যাহার পাঁচটা অঙ্গে পাকযন্ত্রের থলি সে জানোয়ার কি রকম ভয়ানক একবার ভাবিয়া দেখ। ইহাদের এই রকম পাকযন্ত্রের উৎপাতে সমুদ্রের শামুক ঝিনুকের দল সর্ব্বদাই ভয়ে ভয়ে থাকে।
আগে যে ছবি দেওয়া হইয়াছে, তাহা তারা-মাছের উপর পিঠের চিত্র। এই পিঠে মুখ থাকে না। প্রত্যেক হাতে শিকড়ের মত যে শুঁয়ো বাহির হইয়াছে, ঐ গুলি ইহার গায়ের কাঁটা। তার পরে, দুইখানি হাতের মাঝামাঝি যে কালো দাগটি দেখিতেছ তাহা জল-প্রবেশের পথ। তোমাদের বাগানের গাছে জল দিবার বোমার নলে যেমন ঝাঁঝরি লাগানো থাকে, তারা-মাছের দেহে জল-প্রবেশের পথে সেই রকম ঝাঁঝরি আছে। এই ব্যবস্থায় জলের কাটাকুটা শরীরে প্রবেশ করিতে পারে না।
তারা-মাছ কি রকমে তাহার পা নড়াইয়া চলাফেরা করে, এখন তাহার কথা বলিব। ইহারা যে উপায়ে চলিয়া বেড়ায়, তাহা অন্য কোনো প্রাণীতে দেখা যায় না, এই জন্যই তাহার কথা বলিতেছি। ইহাদের সকলি অদ্ভুত।
রবারের সরু নল যদি ভালো করিয়া গুটানো যায়, তবে তুমি তাহা হাতের মুঠার মধ্যে বা বাক্সের মধ্যে অনায়াসে রাখিতে পার। কিন্তু সেই নল যখন জলে ভর্ত্তি করা যায়, তখন তাহাকে আর মুঠার মধ্যে রাখা যায় না,—তখন নল ফুলিয়া খাড়া হইয়া উঠে। তারা মাছদের সেই ছোট পা গুলি এক একটা খুব সরু নলের মত জিনিস, সেগুলির আগাগোড়াই ফাঁপা। কিন্তু নলের দুই মুখই বন্ধ থাকে না; ইহার যে দিক্টা গায়ে লাগানো থাকে, সেটা খোলাই থাকে এবং অন্য মুখটা একেবারে বন্ধ দেখা যায়।